‘রাহুলজি’কেই চান তারা

ক্ষমতায় গেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন- নির্বাচনের আগে ঘোষণা না দিলেও ভারতের আমেথির মানুষজন মনে করে রাহুল গান্ধীই হচ্ছেন দলের ভবিষ্যৎ ‘প্রাইম মিনিস্টার ইন ওয়েটিং’।

সুমন মাহমুদ আমেথি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2014, 05:27 AM
Updated : 3 May 2014, 05:52 PM

মাঠ পর্যায়ের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস মিলেছে। তারা মনে করেন, ভারতের নেতৃত্ব দেয়ার সময় হয়ে গেছে ‘রাহুলজির’।

লখনৌ থেকে ১০৪ কিলোমিটার দূরে উত্তর প্রদেশের ‘আমেথি’ আসনটি ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত স্থান। ভারতের নেতৃত্ব দেয়ার বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার কারণে এই এলাকার মানুষজন প্রতিবার গান্ধী পরিবারের সদস্যদের ভোট দিয়ে লোকসভায় পাঠায়। এবারো তার ব্যতিক্রম হবে- এমন আভাস পাওয়া যায়নি।

অষ্টম পর্বের নির্বাচন সামনে রেখে আমেথি আসনে ভোটের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে এই এলাকার অধিবাসীরা। আগামী ৭ মে এই আসনে ভোট হবে।

সকাল থেকে দুই ঘণ্টা অবস্থানকালে আমেথির প্রান্তিক কৃষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে।

কথায় কথায় কৃষাণ মনি দেবলাল যেমন বললেন, “আমেথির গর্ব আলাদা। কারণ আমেথিই ভারত শাসন করে। আগামীতেও করবে।”

রাহুলের এটি তৃতীয় দফা নির্বাচন। গত দুই দফায় দলের পঞ্চম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এবার তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে লড়ছেন। ২০০৪ সালে কংগ্রেস চেয়ারম্যান সোনিয়া গান্ধী ছেলের জন্য আমেথি আসন ছেড়ে রায় বেরিলিতে গিয়ে নির্বাচন করেন। সোনিয়ার ‘মুখরক্ষা’ও করেছেন তিনি। উপনির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে রাহুল প্রথম লোকসভায় নিজের নাম লেখান সেবার।

১৬ তম লোক সভা নির্বাচনে রাহুলের বিপক্ষে বিজেপি’র টিকিটে লড়ছেন টিভি পর্দার এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্মৃতি ইরানি।

আম আদমির প্রার্থী হয়েছেন কবি কুমার বিশ্বাস এবং বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) প্রার্থী ধর্মেন্দ্র প্রতাপ সিং।

রাজীব গান্ধী এই আসন থেকেই লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন। সেজন্য গান্ধী পরিবারের কাছে আসনটির গুরুত্ব আলাদা।

আমেথির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গোমতি নদী। অধিবাসীদের অধিকাংশ কৃষক হলেও নদীর দুই তীরে রয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্প। এক সময়ে আমেথির নাম ছিলো চত্রাপতি সাহু জি মহারাজ নগর।

লখনৌ থেকে আমেথি যাওয়ার হাইওয়ের দু'পাশটা দিগন্ত বিস্তৃত দুই পাশে চাষের জমি। রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিম বাগান, ফলজ গাছ-গাছালি। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে গম ক্ষেত। ফসল তুলে ফেলায় জমিগুলো এখন প্রখর উত্তাপে বিবর্ণ হয়ে আছে। রাস্তায় গাড়ির পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছে ফসলবোঝাই গাড়ি ও গরুর পাল।

পুরো এলাকায় উন্নয়ন গতি তেমন দ্রুততর নয়। রাস্তা-ঘাটে মেঠো পথে এখনো কৃষাণ-কৃষাণীর পায়ে হেঁটে যেতে হয়। কংক্রিটের সড়ক পথ অনেক জনপথের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেনি। তবে শহরের মতো কোলাহল আমেথিতে নেই। নেই মানুষের মধ্যে আক্ষেপের কোনো কথা। এই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাদের না চাওয়ার সারল্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। 

টিলোয়, জগদীপুর, গুরিগঞ্জ, সালন ও আমেথি নিয়ে লোকসভার আমেথি আসন। জনসংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে পুরুষ ৫২ শতাংশ। দারিদ্রপীড়িত এই এলাকার মানুষজনকে স্বনির্ভর করতে রাহুল নিজে কাজ করছেন এক যুগ ধরে। স্বনির্ভর কুঠির গোষ্ঠীর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনে নতুন মডেল গড়ে তুলেছেন তিনি। কৃষাণ-কৃষাণী কৃষি ঋণ নিয়ে এখন নিশ্চিন্তে ফসল ঘরে তুলেন। এতেই তারা খুশিতে একাট্টা।

স্বনির্ভর কুঠির গোষ্ঠী ছাড়াও আমেথিতে করা হয়েছে ফুড পার্ক। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম দেখে রাহুল গান্ধী আমেথিতে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নতুন পথ দেখিয়েছেন বলে মনে হয়েছে।

কৃষক ননীতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথম দিকে দরিদ্রতা ছিলো তাদের নিত্য দিনের একমাত্র সঙ্গী। স্বনির্ভর কুঠির গোষ্টির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে এখন ঘরে ফসল তুলে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সুখে আছি আমরা। কোনো অভাব নেই।”

“১০ বছর আগের আমেথি ও এখনকার আমেথি দেখলে চেনা যাবে না। আপনি কী ১০ বছর আগে এসেছেন? চুলপাকা দেখে মনে হয়, আপনি জোয়ানকালে এখানে এসেছিলেন? দুই মিলিয়ে নিলে বুঝবেন আমেথি কতটুকু এগিয়েছে।”

ননীতার এরকম প্রশ্নের জবাবে ‘না’ মন্তব্য করলে তিনি বলেন, “তাহলে এখনকার আমেথি চেনা যাবে না। অনেক কিছুতে পরিবর্তন এসেছে এখন।”

কৃষাণ সুদীপ্ত বলেন, “ঋণ সুবিধা পেলেও আমরা নিজেরা জমির মালিক হতে পারেনি। দিন এনে রাতে ঘুমাতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চিত ঠিকানা করতে পারিনি।”

তারপরও গান্ধী পরিবার তাদের আশ্রয়, ভরসা- এমনটিই জানা গেল নানা কথায়। আমেথিবাসীরা বিশ্বাস করে, ভারত বর্ষকে শান্তিতে রাখতে পারে গান্ধী পরিবারই।

আমেথির নির্বাচনী ভোটে বিজেপি‘র স্মৃতি ইরানি প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে হাসি দিয়ে কলেজ শিক্ষক শিলেন্দ্র শিং বলেন, “এটা ইউনিভার্সাল ট্রুথ, রাহুল গান্ধীর বিজয়ে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। রাহুল গান্ধী প্রার্থী হিসেবে অনেক বেশি জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য।”

অবশ্য উন্নয়নের প্রয়োজনের কথা বলতেও ভুললেন না এই শিক্ষক। “আমেথির রাস্তা-ঘাটের আরো উন্নয়ন প্রয়োজন।”

রাহুলের জন্ম ১৯৭০ সালের ১৯ জুন। স্কুল ও কলেজ ভারতে শেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থনীতিতে উচ্চ শিক্ষা নেন তিনি। ২০০২ সালে রাহুল দেশে ফিরে এসে রাজনীতিতে হাতে খড়ি নেন মা সোনিয়ার কাছ থেকে। ২০০৭ সালে সোনিয়া গান্ধী তাকে কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দেন। গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন।

এবার রাহুলের পুরো নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান সমন্বয়কারী ছোট বোন প্রিয়াংকা গান্ধী। কেবল তাই নয়, ৩০ কিলো মিটার দূরে রায় বেরিলি আসনে মা সোনিয়া গান্ধীর নির্বাচনও প্রিয়াংকাই দেখভাল করেছেন।

বলে রাখি বুধবার লোকসভা নির্বাচনে সপ্তম পর্বে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, বিহার, পশ্চিবঙ্গ, জম্মু কাশ্মিরসহ ভারতের নয় রাজ্যের ৮৯টি আসনে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে।

ওইদিনই বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস ও বিজেপি’র সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের ভোট শেষ হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর প্রদেশের রায় বেরিলি আসনে কংগ্রেস চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী, গুজরাটের ভদোদরা আসনে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি, গান্ধীনগর আসনে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা এল কে আদভানি, লাখনৌ আসনে বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং, কানপুর আসনে মুরলী মনোহর যোশী, পাঞ্জাবের অমৃতসর আসনে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অরুন জেটলি।

এছাড়া আছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও জুম্ম কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স দলের প্রধান ফারুক আবদুল্লাহ, পাঞ্জাবের মুখ্য অমরিন্দর সিং, কংগ্রেস নেত্রী অম্বিকা সোনি, রীতা বহুগুনা যোশী, অভিনেতা বিনোদ খান্না, বিজেপি নেত্রী উমা ভারতী, জেডিইউ চেয়ারম্যান শারদ যাদবের মাধেপুরা প্রমুখ নেতাদের ভোট ইভিএম মেসিনে বন্দি হয়ে গেছে।

(লোকসভা নির্বাচনের খবর জানাতে ভারতে রয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদক সুমন মাহমুদ)