মিয়ানমারের সামরিক শাসনের বিরোধীদের নিয়ে গঠিত ছায়া সরকার দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেওয়ার পর সহিংসতা এড়ানোর অনুরোধ এসেছে আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে।
Published : 08 Sep 2021, 04:41 PM
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এ দেশটির সব পক্ষের প্রতি সহিংসতা এড়িয়ে চলতে এবং মানবিক ত্রাণসাহায্য প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও পশ্চিমা অনেক দেশ।
মঙ্গলবার জান্তাবিরোধী ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এ্নইউজি) জানায়, তারা ‘জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধের’ সূচনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা মূলত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় করার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষ বদলের আহ্বান জানিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র এনইউজির এ ডাককে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এটি বিশ্ববাসীর মনোযোগের আকর্ষণের চাল। তাদের বিদ্রোহ সফলতার মুখ দেখবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
এনইউজি’র বিদ্রোহের ডাকের পর বুধবার তাৎক্ষণিকভাবে দেশটিতে সহিংসতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
“সব পক্ষকেই মিয়ানমারের জনগণের নিরাপত্তা ও ভালো থাকাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে,” বলেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তেউকু ফাইজাসিয়াহ।
পরিস্থিতি নিরাপদ মনে হলেই কেবল মানবিক ত্রাণসাহায্য সরবরাহ করা যাবে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে নিলে মিয়ানমারে যে সংকটের সূচনা হয়, তার সমাধানে যে প্রতিবেশী দেশগুলো এগিয়ে এসেছিল ইন্দোনেশিয়া তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ওই অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে কয়েকশ গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীর প্রাণ গেছে। জান্তাবিরোধী অনেকে গণপ্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যানারের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীও গড়ে তুলেছে।
এই জান্তাবিরোধীরা জাতিগত সংখ্যালঘু অনেক গোষ্ঠীর সঙ্গে জোট গড়েছে; আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার জন্য লড়া এই সংখ্যালঘুরা দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে তাদের শত্রু হিসেবে দেখে আসছে।
এখন এনইউজি’র বিদ্রোহের ডাক এই পরিস্থিতির সঙ্গে নতুন কী যোগ করতে পারে, তাই দেখার বিষয়, বলছেন পর্যবেক্ষকরা।
“এনইউজির ডাকের প্রতি ব্যাপক সমর্থন দেখা গেছে মিয়ানমারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে,” বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হরসে।
মিয়ানমারের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোরদার লড়াইয়ের সক্ষমতা বিরোধী বাহিনীগুলোর আদৌ আছে কিনা, তাও স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এনইউজি’র এই যুদ্ধের ঘোষণা ‘ব্যাকফায়ারও’ করতে পারে, কেননা মিত্র অনেক দেশের জন্য এনইউজির এই ঘোষণায় সমর্থন দেওয়া কঠিন হবে, বলেন হরসে।
ফেইসবুকে দেওয়া এক পোস্টে মিয়ানমারে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত পিট ভাওলেস বলেছেন, “জান্তার অভ্যুত্থান ও নির্মমতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমরা।”
তিনি সব পক্ষকে আলোচনায় অংশ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।
অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমা দেশগুলো সামরিক জান্তার ওপর চাপ প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ বেছে নিলেও, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান কূটনৈতিক উপায়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করে আসছে।
তবে এই চেষ্টায় তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় জোটের অনেক সদস্য দেশের মধ্যে হতাশা ও বিরক্তি দেখা যাচ্ছে।
“আমি কেবল বলতে পারি, যে ৫ দফা নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে না পেরে আমরা হতাশ,” এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে সহিংসতা বন্ধে এপ্রিলে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের আলোচনার ফলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন আবদুল্লাহ।
এনইউজি’র বিদ্রোহের ডাক নিয়েও তিনি নাখোশ।
“নতুন এ ঘটনার পর আপনাকে আবারও ড্রয়িং বোর্ডে ফিরতে হবে,” বলেছেন তিনি।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেছেন, তারা এনইউজি’র ‘জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধের’ ডাকের ব্যাপারে অবগত।
“মিয়ানমারের এখনকার সংকটের সমাধান হিসেবে সহিংসতাকে মেনে নিতে পারে না যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন দেশটির সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে,” বলেছেন তিনি।
ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী সু চির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেও মিয়ানমারে নিজেদের ব্যাপক অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকা চীন তুলনামূলক ‘নরম অবস্থান’ নিয়েছিল।
বেইজিং বলেছিল, মিয়ানমারে স্থিতিশীলতাই তাদের অগ্রাধিকার এবং তারা প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছে, পশ্চিমা দেশগুলো যদি জান্তাবিরোধী বাহিনীগুলোকে সামরিক সমর্থন দেয় তাহলে তা মিয়ানমারজুড়ে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা উসকে উঠতে পারে।
“যদি সশস্ত্র সংঘাতকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং উগ্র রাজনৈতিক কর্মসূচিকে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে দেশটি সীমাহীন যুদ্ধ ও সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়বে,” সংবাদপত্রটিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এমনটাই বলা হয়েছে।