উত্তর কোরিয়ায় সম্প্রতি পাস হওয়া নতুন একটি আইনের মূল লক্ষ্য, যে কোন ধরনের বিদেশি প্রভাব প্রতিহত করা। এই আইন অনুযায়ী, ভিনদেশি সিনেমা দেখা, পোশাক পরা এমনকী গালি দেওয়ার জন্যও কঠোর শাস্তির মুখে পড়বেন নাগরিকরা। কিন্তু কেন?
Published : 09 Jun 2021, 04:31 PM
দক্ষিণ কোরিয়ার নাটকসহ ধরা পড়া এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড প্রথমবারের মতো মাত্র ১১ বছর বয়সে স্বচক্ষে দেখেছিলেন উত্তর কোরিয়ার ইয়ুন মি-সো। তার সব প্রতিবেশীকেই বাধ্য করা হয়েছিল এই দৃশ্য দেখতে। কারণ, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না দেখাটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। অবৈধ ভিডিও চোরাচালানের শাস্তি কতটা কঠোর, তা সবাই জানবে- নিশ্চিত করতে চেয়েছিল উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী।
“আমি এখনও ভুলতে পারি না মানুষটার কথা। তার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল, কিন্তু তাও তার চোখের পানি দেখা যাচ্ছিল। চোখ বেঁধে রাখা কাপড়টি পানিতে ভিজে গিয়েছিল। মানুষটিকে বেঁধে গুলি করা হয় আমাদের চোখের সামনেই”- নাজুক বয়সে এভাবে মৃত্যু দেখার সেই স্মৃতিকথা ইয়ুন মি-সো জানিয়েছেন বিবিসি-কে।
অস্ত্র ছাড়া এক যুদ্ধ
ভাবুন আপনি অনেকদিন ধরে লকডাউনে আছেন। নেই কোন ইন্টারনেট, কোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আছে শুধু কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল, যা শুধু দেশের নেতাদের শেখানো বুলি শুনায় জনগণকে। এটাই উত্তর কোরিয়ার জনজীবন।
এর ওপর নতুন পাস হওয়া আইনটিতে জনজীবন হবে আরও বিপন্ন। ‘প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা’ রুখতে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বলেই জানাচ্ছে দেশটি।
আইন অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা জাপানি কোনও ভিডিওর বড় চালানসহ ধরা পড়লে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে। কেউ দেখতে গিয়ে ধরা পড়লে হতে পারে ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড।
আর এই আইন শুধু লোকে কী দেখবে আর কী দেখবে না তা নিয়েই নয়। বিদেশি ভাষা, কাপড় এমনকি চুলের ছাঁটও বন্ধ করা এ আইনের লক্ষ্য। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে লেখা এক চিঠিতে কিম জং ঊন তরুণদের ‘রুচিহীন, স্বতন্ত্রবাদী এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী আচরণ’ বন্ধ করার তাগিদ দেন। বিদেশি এই প্রভাবকে তিনি ‘ভয়ানক বিষ’ হিসেবে দেখেন, বলে জানিয়েছেন চিঠিতে।
আর এসবের কারণেই বলা যায়, কিম এমন এক যুদ্ধে লিপ্ত যাতে কোনও পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে না। উত্তর কোরিয়ার জীবন ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে, আর এই তথ্য কিম দেশের বাইরে প্রচার হতে দিতে চান না, তাই বেছে নিয়েছেন এই পদ্ধতি। এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
উত্তর কোরিয়ায় লাখ লাখ মানুষ খাবারের অভাবে আছে বলে ধারনা করা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে সীমানার ওপারে এশিয়ার অন্যতম ধনী শহর সিউলের ঝলমলে জীবনযাত্রা থেকে দূরে রেখে উত্তর কোরীয়দের পরিকল্পিত প্রচারণা গেলানো হচ্ছে।
এছাড়াও, করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে দেশকে রক্ষা করতে সীমানা বন্ধ করার কারণে বহির্বিশ্বের সাথে রীতিমত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বর্তমান উত্তর কোরিয়া।
প্রতিবেশী চীন থেকে আমদানি ও বাণিজ্য প্রায় অচল, সেখানে কিছু সরবরাহ আসলেও আমদানি খুবই সীমিত। অর্থনীতি যাচ্ছে খারাপের দিকে। বছরের শুরুতে কিম নিজেই এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছিলেন, তার দেশের মানুষ এখন “সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা কাটিয়ে উঠতে হবে।”
কী বলা আছে আইনে?
‘দ্য ডেইলি এনকে’ সদ্য পাস হওয়া আইনের একটি অনুলিপি পেয়েছে বলে জানায় বিবিসি। দ্য ডেইলি এনকের প্রধান সম্পাদক লিং স্যাং ইয়াং বিবিসি-কে বলেন, ‘এতে বলা আছে শ্রমিকের দোষে কারারুদ্ধ হবেন কারখানা প্রধান, শিশুর দোষে দোষী হবে তার অভিভাবক।’
আইনটি সম্পর্কে লিং স্যাং ইয়াং বলেন, দেশটি ভাবে বিদেশি সংস্কৃতি থেকে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধের অনুপ্রেরণা আসতে পারে। উত্তর কোরীয় তরুণদের মনে থাকা নূন্যতম স্বপ্নটুকু গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য এবং দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়ক যে কোনও আকর্ষণ তৈরি হওয়ার রাস্তা বন্ধ করার জন্যই করা হয়েছে এই আইন।
গত বছর নিজ দেশ ত্যাগ করেছেন চোই জং-হুন। তিনি বিবিসি-কে বলেন, “সময় যত কঠিন হয়, আইন কানুন, শাস্তি সবই কঠিন হয়। মনস্তাত্বিকভাবে, পেটে ভাত থাকলে দক্ষিণ-কোরীয় সংস্কৃতি বিনোদন হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যখন খাবারই নেই, বেঁচে থাকা দুষ্কর, তখন তো মানুষ অসন্তুষ্ট থাকবেই।”
এর আগের দমনাভিযানগুলো থেকে দেখা গেছে যে, চীন সীমান্ত হয়ে আসা বিদেশি চলচ্চিত্র দেখায় উত্তর কোরিয়ার মানুষ কতটা করিৎকর্মা।
দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া চোই নামের এক নাগরিকের মতে, অনেক বছর ধরে উত্তর কেরিয়ায় ইউএসবি স্টিকের মাধ্যমে নাটকগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ইউএসবি স্টিক সহজলভ্য এবং লুকিয়ে ফেলাও সহজ। পাসওয়ার্ড দিয়ে সেগুলো এনক্রিপ্ট করা যায়।
তিনি বলেন, "পরপর তিনবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলে ভেতরের ফাইল আপনা থেকেই মুছে যায়। এমনকী এমনভাবে পাসওয়ার্ড সেট করা যায় যে একবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলেই ফাইল মুছে যায়"।
"এমনও অনেক ঘটনা আছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট কম্পিউটারেই ইউএসবি স্টিকের জন্য ফাইল খোলা যাবে। এটি অন্য কম্পিউটারে খোলা যাবে না, ফলে কাউকে দেয়াও যাবে না।”
অনেকেই সিনেমা দেখার জন্য কতটা মরিয়া তা উঠে এসেছে ইয়ুন মি-সো এর স্মৃতিকথায়। তিনি জানান, তার প্রতিবেশীরা একবার গাড়ির ব্যাটারি ধার করে এনেছিলেন। তারপর সেটাকে একটি জেনারেটরের সাথে জুড়ে দিয়েছিলেন টেলিভিশন চালানোর জন্য।
দক্ষিণ কোরিয়ার নাটক "স্টেয়ারওয়ে টু হেভেন" বা স্বর্গের সিঁড়ি প্রায় ২০ বছর আগে উত্তর কোরিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলে জানান মি-সো।
দমনাভিযানের শুরু যখন:
২০ বছর আগের ওই সময়ে চীন থেকে আনা সস্তা সিডি ও ডিভিডির কল্যাণে বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতি যখন উত্তর কোরিয়ার মানুষ আসক্ত হয়েছিল তখনই পিয়ংইয়ংয়ের শাসকেরা বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলেন।
চোই নামের ওই নাগরিক জানান, তার মনে পড়ছে, ২০০২ সালে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তল্লাশি চালিয়েই ২০ হাজারের বেশি সিডি জব্দ করেছিল।
প্রশ্ন করে তিনি বলেন, “একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়েই এ অবস্থা হলে সারা দেশে কী পরিমাণ সিডি ছিল তা কি কল্পনা করা যায়? সরকার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই সময়টাতেই শাস্তি অগের চাইতে কঠোর করা হয়েছিল।”
আরেক নাগরিক কিম জিউম-হিউক বলেন, ২০০৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাকে আটক করা হয়েছিল।অবৈধ ভিডিও ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গঠিত একটি বিশেষ বাহিনী তাকে আটক করেছিল।
জিউম-হিউকের সঙ্গে একজন বন্দির মতো আচরণ করা হয়েছিল। তাকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি। টানা চার দিন ধরে ক্রমাগত লাথি ও ঘুষি মারা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন হিউক।
তার কথায়. "আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।ভেবেছিলাম, আমার দুনিয়াটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারা জানতে চাচ্ছিল, আমি এসব ভিডিও কোথায় পেয়েছি, কতজনকে দেখিয়েছি। আমি বলতে পারিনি যে, আমার বাবা সেগুলো চীন থেকে এনেছেন। আমি আর কীইবা বলতে পারতাম? তিনি আমার বাবা। তাই আমি কিছু বলিনি। শুধু বলতাম, আমি কিছু জানি না। আমি কিছু জানি না। আমাকে যেতে দিন।”
জিউম-হিউক এখন দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বাস করেন। সেখান থেকেই বিবিসি-কে এসব কথা বলেন তিনি। জিউম-হিউক পিয়ংইয়ংয়ের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা সেই সময় ঘুষ দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন কিমের নতুন আইনের আওতায় এভাবে কাউকে ছাড়িয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।
ওই সময়ে একইকারণে ধরা পড়া অনেককেই শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এই শাস্তি যথেষ্ট মনে না হওয়ায় সাজা কঠোর করা হয়।
"প্রথমে শাস্তি ছিল শ্রম শিবিরে এক বছর কাটানো। পরে তা বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়। এখন শ্রম শিবিরগুলোতে গলে দেখা যাবে তাদের অর্ধেকের বেশিই তরুণ - তাদের অপরাধ বিদেশি ভিডিও দেখা।”
"কেউ দু'ঘণ্টা অবৈধ ভিডিও দেখলেই তাকে তিন বছর থাকতে হবে শ্রম শিবিরে। এটা একটা বিরাট সমস্যা”, বলেন মি. চোই।
বেশ কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে যে, উত্তর কোরিয়ার কোন কোন বন্দিশিবিরের পরিসর গত বছর বাড়ানো হয়েছে। চোই বিশ্বাস করেন কঠোর নতুন আইনের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।
তিনি বলেন, “সিনেমা দেখাটা এখানে বিলাসিতা। কারণ, সিনেমা দেখার চিন্তা করার আগে পেট ভরতে হবে। খাওয়া জোটানোই যখন কষ্ট হয়ে দাঁড়ায় তখন কোনও পরিবারের কাউকে শ্রম শিবিরে পাঠানো হলে তা হবে বিপর্যয়কর।”
জিউম-হিউক বলেন, "বিদেশি নাটক দেখার জন্য আমাদের অনেক ফন্দি আঁটতে হত। কিন্তু কৌতূহল দমিয়ে রাখা যায় না। বাইরের দুনিয়ায় কী হচ্ছে তা আমরা জানতে চাইতাম।”
নিজের দেশ সম্পর্কে সত্যিটা জানতে পারার পর জীবন বদলে যায় জিউম-হিউকের। তিনি ছিলেন হাতে গোনা সৌভাগ্যবান উত্তর কোরীয়দের একজন, যিনি লেখাপড়ার জন্য বেইজিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন ইন্টারনেট।
তার কথায়, "প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। আমি ভাবতাম পশ্চিমারা আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা বলছে। উইকিপিডিয়া মিথ্যা বলছে। আমি কীভাবে এটা বিশ্বাস করতে পারি? কিন্তু আমার মন বলছিল এক রকম আর মস্তিষ্ক বলছিল আরেক রকম"।
"তাই আমি উত্তর কোরিয়া বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্রগুলো দেখতে শুরু করি। অনেক নথি পড়ি। তারপর আমার মনে হল যে, তারা সম্ভবত সত্য কথাই বলছে, কারণ তাদের কথায় যুক্তি আছে"।
“আমার চিন্তার জগতে এই পরিবর্তন যখন অনুধাবন করতে পারলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমার আর পেছনে ফেরার উপায় ছিল না।” শেষ পর্যন্ত জিউম-হিউক সিউলে পালিয়ে যান।
আরেক নাগরিক ইয়ো মি-সো পেয়েছেন তার স্বপ্নের জীবন। সিউলে তিনি ফ্যাশন উপদেষ্টা। নতুন দেশে পা দিয়ে প্রথমেই তিনি সেই সব জায়গায় গিয়েছিলেন, যেসব জায়গা তিনি দেখেছিলেন 'স্টেয়ারওয়ে টু হেভেন'-এ।
কিন্তু এদের মতো সৌভাগ্যবান আরও কারও হওয়ার ঘটনা বিরল। উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে সম্প্রতি কাউকে 'দেখামাত্র গুলি' নীতির কারণে এখন নাগরিকদের দেশ ছেড়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
নাগরিক চোই উত্তর কোরিয়া ছাড়তে পারলেও এখনও দেশে রয়ে গেছে তার পরিবার। তিনি বিশ্বাস করেন, একটি দু'টি নাটক দেখে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা আদর্শগত নিয়ন্ত্রণ আলগা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এও মনে করেন যে, উত্তর কোরিয়ার জনগণ রাষ্ট্রীয় প্রচার হয়ত সত্য নয় বলেই সন্দেহ পোষণ করে।
চোই বলেন, "উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের মনে কোথাও হয়ত ক্ষোভের বীজ আছে, কিন্তু তারা জানে না সেই ক্ষোভ নিয়ে তারা কোন পথে যাবে।”
"এই ক্ষোভের কোনও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই। আমার হৃদয় ভেঙে যায় যখন দেখি, আমি তাদেরকে বলার পরও তারা বুঝতে পারছে না। এখন এমন একজন দরকার যে তাদেরকে জাগাবে। তাদেরকে আলোকিত করবে।”