নতুন করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেওয়ার পর প্রথম দেশ হিসেবে এই ভাইরাস জয়ের ঘোষণা দেওয়া নিউ জিল্যান্ডের সাফল্যের পেছনে তাদের সময়োচিত পদক্ষেপগুলোর কথা বলা হচ্ছে।
Published : 28 Apr 2020, 11:11 PM
বিবিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫০ লাখ মানুষের দেশ নিউ জিল্যান্ডে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ১২৪ জন। এই ভাইরাস সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১৯ জন।
বেশ কিছু দিন ধরে নিউ জিল্যান্ডে নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা এক অঙ্কে রয়েছে, রোববার শনাক্ত হয় মাত্র একজন। আর তা থেকেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ’ডুর্ন কার্যকরভাবে ভাইরাস নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন।
নিউ জিল্যান্ডের এই সাফল্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকেই গত ১৯ মার্চ নিউ জিল্যান্ড ভ্রমণ ও মানুষের কর্মকাণ্ডের ওপর যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করে, সেগুলো ছিল বিশ্বে সবচেয়ে কঠোরতম পদক্ষেপের অন্যতম।
সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশফেরত সবার জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যবাধতামূলক ঘোষণা করেন নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।
তার এই পদক্ষেপই বিদেশ থেকে করোনাভাইরাস আমদানি বন্ধে তাদের সাহায্য করেছে। দেশটির মোট আক্রান্তের ৩৩ শতাংশই বিদেশফেরত।
ওই সময় প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ’ডুর্ন বলেছিলেন, “আমাদের মাত্র ১০২ জন করোনাভাইরাস রোগী আছে, কিন্তু ইতালিরও এক সময় তা-ই ছিল।”
বিদেশ থেকে করোনাভাইরাস নিয়ে আসা ঠেকাতে নিউ জিল্যান্ড সরকারের ওই সিদ্ধান্ত কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা বোঝাতে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সঞ্জয়া সেনানায়েকে বিবিসিকে বলেন, “আপনি যদি প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ার দিকে তাকান, আক্রান্তদের দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশ থেকে এসেছে।
“সুতরাং সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেওয়া সত্যিকারে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তারা তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেছে।”
দ্রুত ও পুরোদমে লকডাউনও নিউ জিল্যান্ডের করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্যে বড় ভূমিকা রেখেছে।
২১ মার্চ নিউ জিল্যান্ড সরকার চার মাত্রার সতর্কতা ব্যবস্থার ধারণা সামনে নিয়ে আসে। এর সর্বোচ্চটা হল দেশজুড়ে লকডাউন, আর সর্বনিম্নটায় বোঝাবে রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে তবে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
এরপর দ্বিতীয় ধাপে চলে যায় নিউ জিল্যান্ড, যাতে বোঝায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঝুঁকি বাড়ছে। কয়েক দিনের মধ্যে চতুর্থ মাত্রার সতর্কতায় যায় দেশটি, অর্থাৎ দেশজুড়ে লকডাউন।
অফিস-আদালত, স্কুল এবং সমুদ্র সৈকত ও খেলার মাঠ সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। সব ধরনের বার ও রেস্তোরাঁও বন্ধ করা হয়।
কন্টাক্ট ট্রেসিং ও পরীক্ষার দিক দিয়ে নিউ জিল্যান্ড এই লড়াইয়ে এগিয়ে গেছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এর ফলে ওই মানুষগুলো ভাইরাসের ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ডে’ নিজেদের আলাদা করে রাখতে সক্ষম হয়েছেন এবং ওই সময় শেষ হওয়ার পর তারা পরীক্ষা করিয়েছেন। প্রতিদিন আট হাজার করে পরীক্ষা করা হয় বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কে কার কার সংস্পর্শে আসছেন তার রেকর্ড রাখতে জনসাধারণকে ডায়রি ব্যবহার করতেও উৎসাহিত করা হয়েছিল। এছাড়া আক্রান্তরা কার কার সংস্পর্শে এসেছেন খুঁজে বের করতে সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো নিউ জিল্যান্ডও কন্টাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ ব্যবহার করছে।
নিউ জিল্যান্ড সরকার লকডাউনের মধ্যে জনগণকে নিজেদের ঘরের মধ্যেই আটকে না থেকে বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের ছোট গ্রুপ, যারা শুধু নিজেদের মধ্যেই যোগাযোগ রাখবেন, এমন গ্রুপ করে থাকতে বলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ব্যবস্থা নেওয়ায় মানুষ বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আটকে যাওয়াটা কম অনুভব করেছেন, আর তাতে আইন লংঘনের প্রবণতাও কমেছে।
পরস্পর থেকে দুই মিটার (৬ ফুট) দূরত্ব বজায় রাখার বার্তাও আগেভাগেই জনগণকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সংকটকালে জনগণের সামনে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে পারার জন্যও নিউ জিল্যান্ড সরকারের প্রশংসা হচ্ছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা অ’ডুর্ন এবং দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী ডা. অ্যাশলি ব্লুমফিল্ডের প্রশংসা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক সেনানায়েকে বলেন, “আমার মনে হয়, যখন আপনি শুনছেন আপনার প্রধানমন্ত্রী শান্তভাবে বিবেচনাপ্রসূত তথ্য দিচ্ছেন তখন তা আপনাকে শান্ত থাকতে সহায়তা করবে।”
তবে এখই নিউ জিল্যান্ডে মানুষের চলাচলে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন তিনি।
এখনও মানুষের সতর্ক থাকার দরকার বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।
“আমি মনে করি, বিধি-নিষেধ ধাপে ধাপে তোলাটা সর্বোত্তম এবং এক্ষেত্রে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে কি না তার ওপর নজর রাখতে হবে,” বলেন তিনি।
সোমবার রাত থেকেই লকডাউনের বিধি-নিষেধ শিথিল করে তৃতীয় মাত্রায় এনেছে নিউ জিল্যান্ড সরকার, যাতে খাবার কিনে নেওয়ার দোকান এবং জরুরি নয় এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আবার চালু হয়েছে।
বিবিসি বলছে, প্রায় পাঁচ সপ্তাহের কঠোর লকডাউন থেকে ছাড়া পেয়ে নিউ জিল্যান্ডাররা যেন কফি ও ফাস্ট ফুডের দোকানের দিকে ছুটেছে বলেই মনে হচ্ছে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কফি শপ ও ম্যাকডোনাল্ডসের আউটলেটগুলোর সামনে ভিড় জমে যায়।
“এই কফির স্বাদ অসাধারণ এবং আমার মনে হচ্ছে জীবনে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে,” বলেন একজন কফিপ্রেমী।