“চীন যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি- তাতে পুরনো ও নতুন অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত,” বলছেন এক অর্থনীতিবিদ।
Published : 05 Oct 2024, 09:41 AM
চীন যখন তার ‘স্বর্ণালি সপ্তাহের’ ছুটি উদযাপনের সঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রের ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি দেশের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে।
বিবিসি লিখেছে, এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সংকটে পড়া আবাসন খাতে সহায়তা, পুঁজিবাজারের জন্য সহায়তা, দরিদ্রদের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা এবং সরকারি আরও কর্মসূচিতে খরচা। এই ঘোষণার পর চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকংয়ের শেয়ারদর রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এসব পদক্ষেপ চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।
দেশটির বিপর্যস্ত পুঁজিবাজারকে টেনে তুলতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর নতুন কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা করে পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি)।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৮০ হাজার কোটি ইউয়ানের তহবিল যোগানের ঘোষণা দিয়েছে, যে তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে ইন্স্যুরার, ব্রোকার ও অ্যাসেট ম্যানেজাররা শেয়ার কিনতে পারবে।
গভর্নর প্যান কংশেং বলেছেন, যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি তাদের নিজেদের শেয়ার কিনতে চায় এবং ঋণের খরচ কমানোর পরিকল্পনা করছে; সেই সব কোম্পানি যাতে আরও ঋণ পায়, তার অনুমতি দেওয়া হবে ব্যাংকগুলোকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণার দুদিন বাদে শীর্ষ নেতাদের নিয়ে আকস্মিক অর্থনীতিকেন্দ্রিক বৈঠকে বসেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সেখানে কর্মকর্তারা অর্থনীতিতে সহায়তা দিতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
চীনে এক সপ্তাহের ছুটি শুরু হওয়ার আগের দিন সোমবার সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের কম্পোজিট সূচক ৮ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর আর এমন দিন দেখেনি চীন। নতুন পদক্ষেপের ফলে পাঁচ দিনে সূচক বেড়েছে ২০ শতাংশ।
পরের দিন মূল ভূখণ্ডে পুঁজিবাজার বন্ধ ছিল, আর প্রশাসনিক অঞ্চল হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচক ৬ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
বিশ্লেষক বিল বিশপ মনে করেন, বিনিয়োগকারীরা চীন সরকারের নতুন পদক্ষেপ পছন্দ করেছেন।
বিবিসি লিখেছে, বিনিয়োগকারীরা খোশ মেজাজে থাকলেও প্রেসিডেন্ট শিকে সমস্যার আরও গভীরে যেতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৫তম বার্ষিকীর মানে হচ্ছে, এটাই একমাত্র প্রধান কমিউনিস্ট রাষ্ট্র, যা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে টিকে আছে। এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পরে ভেঙে পড়েছিল।
সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক আলফ্রেড উ বলেন, “সোভিয়েত ইউনিয়নের মত পরিণতি এড়ানোই দীর্ঘদিন ধরে চীনা নেতাদের মূল মাথাব্যথা।”
বার্ষিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে- এমন ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্যে শীর্ষ কর্মকর্তাদের এখন আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ইউয়েন ইউয়েন অ্যাং বলেন, “চীনকে যে কোনো উপায়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। ২০২৪ সালে সেটা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে প্রবৃদ্ধির ধীরগতি আর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে বলে দেশটির নেতারা উদ্বিগ্ন।”
বিবিসি লিখেছে, তিন বছর আগে আবাসন বাজারে শুরু হওয়া মন্দাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে সম্প্রতি ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে পুঁজিবাজারের পাশাপাশি আবাসন খাতকেও রাখা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঋণ বাড়ানো, জামানত হার কমানো এবং সেকেন্ড হোম ক্রেতাদের জন্য ন্যূনতম ডাউন পেমেন্টের ব্যবস্থা। তবে আবাসন বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ যথেষ্ট কি না তা নিয়ে সংশয় আছে।
মুডি'স অ্যানালিটিকসের অর্থনীতিবিদ হ্যারি মারফি ক্রুজ বলেন, এই পদক্ষেপগুলোকে স্বাগত জানানো যায়, তবে তাতে পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
“চীনের দুর্বলতা আস্থার সংকট থেকে উদ্ভূত, ঋণের নয়; প্রতিষ্ঠান ও পরিবারগুলো ঋণ নিতে চায় না- তা যতই সহজ করা হোক না কেন।”
পলিটব্যুরোর বৈঠকে চীনা নেতারা সুদের হার কমানোর আগ্রহ দেখাননি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরকারি তহবিল ব্যবহারের অঙ্গীকার করেছেন।
তবে সম্পত্তির বাজার স্থিতিশীল করা, ভোগব্যয় বৃ্দ্ধির সুযোগ তৈরি এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর মত অগ্রাধিকার ঠিক করার বাইরে সরকারি ব্যয় কতটা বাড়ানো যাবে, সে বিষয়ে তেমন কোনো প্রস্তাব রাখেননি কর্মকর্তারা।
ভ্যানগার্ডের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ কিয়ান ওয়াং সতর্ক করে বলেছেন, রাজস্ব প্রণোদনা যদি বাজারের চাহিদার চেয়ে কম হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হতে পারেন।
“তাছাড়া চক্রাকার প্রণোদনা নীতি অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যার সমাধান করে না।"
সংকটের গভীরে গিয়ে সংস্কার না করলে চীনের অর্থনীতির সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চীনের আবাসন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করাকেই সামষ্টিক অর্থনীতি ঠিক করার মূল চাবিকাঠি হিসাবে দেখেন অর্থনীতিবিদরা।
বিবিসি লিখেছে, বেশিরভাগ পরিবার সম্পত্তিকে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হিসেবে দেখে। ফলে বাড়ির দাম কমায় ভোক্তাদের আস্থা কমছে।
জুলিয়াস বেয়ারের অর্থনীতিবিদ সোফি আল্টারম্যাটের একটি নোটে বলা হয়েছে, আগে বিক্রি হওয়া কিন্তু অসমাপ্ত বাড়ি এখন ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
তার পরামর্শ, অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়ানোর টেকসই উপায় হিসেবে পরিবারের আয়ের জন্য এককালীন আর্থিক সহায়তা থেকে সরে আসতে হবে। তার বদলে উন্নত পেনশন এবং সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
কমিউনিস্ট চীনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এ বছর ৩০ সেপ্টেম্বর ৭৫তম বার্ষিকীর দিনে রাষ্ট্রায়াত্ত সংবাদপত্র পিপলস ডেইলির একটি সম্পাদকীয়তে আশার বাণী শুনিয়ে বলা হয়, “যদিও সামনের যাত্রা চ্যালেঞ্জিং, তবে ভবিষ্যত আশাব্যঞ্জক।"
ওই নিবন্ধে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট শি'র ‘উচ্চমানের উন্নয়ন' এবং ‘নতুন উৎপাদনশীল শক্তি'র ধারণা আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ উন্মোচনের চাবিকাঠি।
এই ধারণাগুলোর ওপর জোর দেওয়ার মানে দাঁড়ায় অতীতের প্রবৃদ্ধির জন্য সম্পত্তি এবং অবকাঠামো বিনিয়োগ গুরুত্ব পেলেও শি এখন হাই-এন্ড শিল্পের ওপর ভর করে আরও সুষম অর্থনীতি বিকাশের চেষ্টা করছেন।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাং বলেন, চীন যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তাতে পুরনো ও নতুন অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুরনো অর্থনীতি যদি খুব দ্রুত হোঁচট খায়, তবে তা অনিবার্যভাবে নতুনের উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করবে।
“এটাই চীনা নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং সে অনুযায়ী সাড়া দিচ্ছে।”