ইউক্রেইন সপ্তাহখানেক ধরে তুমুল লড়াই চালালেও ইতোমধ্যেই তাদেরকে পশ্চিমাদের দেওয়া অনেক সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক হারাতে হয়েছে।
Published : 15 Jun 2023, 03:20 PM
সপ্তাহখানেক ধরে তুমুল লড়াই চালালেও কিইভের পাল্টা আক্রমণের আসল পরীক্ষা আদতে সামনে; ইউক্রেইনের সেনারা রাশিয়ার আসল প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে এখনও খানিকটা দূরে, সংঘাতে জড়াতে বিপুল পরিমাণ সেন্য এখনও অপেক্ষমান।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পাল্টা আক্রমণ শুরুর পর গত সপ্তাহে ইউক্রেইন দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রের দুটি এলাকায় আক্রমণ শানিয়ে ৭টি গ্রাম পুনর্দখলের কথা জানালেও এই অল্প সময়েই তাদেরকে পশ্চিমাদের দেওয়া অনেক সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক হারাতে হয়েছে।
“উভয় পক্ষের জন্যই, কার কত ক্ষতি হচ্ছে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে,” বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো রব লি।
তার মতো অনেক বিশ্লেষকই উপগ্রহের ছবি ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত আলোকচিত্রের ভিত্তিতে ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণে দুই পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন।
“ইউক্রেইনীয়দের জন্য ঝুঁকি হচ্ছে, যদি তারা রাশিয়ার মূল প্রতিরক্ষা লাইনের কাছে পৌঁছানোর আগেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে সেই লাইনটি ভাঙা এবং তাকে কাজে লাগানো তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে,” বলেছেন লি।
ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, পশ্চিমাদের দেওয়া যুদ্ধ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের মতো যুদ্ধ সরঞ্জাম ইউক্রেইনীয় সেনাদের জীবন রক্ষায় সহায়ক হবে।
ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণ মোকাবেলায় মস্কো পশ্চিম রাশিয়ার পাশ থেকে শুরু করে দখলকৃত ক্রাইমিয়া পর্যন্ত মাইন, ট্যাংক বিধ্বংসী খাদ, সারি সারি কংক্রিটের ‘ড্রাগন দাঁত’ ব্যারিকেড ও পরিখাসহ হাজার হাজার প্রতিরক্ষা স্থান প্রস্তুত করেছে রেখেছে।
এসব স্থানের মধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণের স্থানগুলোতে মস্কো বিপুল পরিমাণ সৈন্য ও সরঞ্জাম জড়ো করে রেখেছে বলে এপ্রিলে দেখা উপগ্রহের ছবি পর্যালোচনা করে বলছে রয়টার্স।
রাশিয়ার সঙ্গে ক্রাইমিয়ার স্থলপথে যোগাযোগ ভণ্ডুল করে দিতে এবং ক্রেমলিনের বাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করে দিতে কিইভ এই দক্ষিণেই মূল আক্রমণ চালাতে পারে বলে অনেকের অনুমান।
পাল্টা আক্রমণের জন্য কাছেই বিপুল পরিমাণ সেন্য জড়ো করে রাখা ইউক্রেইন কোথায় কোথায় মস্কোর শক্তি বেশি তা দেখে পূর্বাঞ্চলের মতো তুলনামূলক অরক্ষিত অঞ্চলেও আঘাত হানতে পারে, বলছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
“ইউক্রেইনের হাতে বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারা এখন আর কৌশলে চমকে দিয়ে কিছু অর্জন করতে পারবে না হয়তো কিন্তু তারা অপারেশনাল ও ট্যাকটিকাল উপায়ে সর্বোচ্চটা অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় গোপন কর্মকাণ্ড, ছদ্মবেশ, জালিয়াতি, ভুয়া তথ্য ছড়ানোসহ নানান চাতুরিময় কর্মকাণ্ড হতে পারে, যেমনটা করে গত শরতে তারা সফল হয়েছিল,” বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের স্থলযুদ্ধ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো বেন বেরি।
লি-র বিবেচনায় এই মুহূর্তে মস্কোর কৌশল হতে পারে, এখন যেখানে যুদ্ধ চলছে, সেখান থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে তাদের মূল প্রতিরক্ষা লাইনে পৌঁছানোর আগে ইউক্রেইনের সর্বোচ্চ পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি ঘটানো।
“মরা পর্যন্ত যুদ্ধ করা কিংবা ঘেরাও হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই তাদের,” বলেছেন তিনি।
গত বছরের এপ্রিলে রুশ বাহিনীকে কিইভ থেকে হটিয়ে দেওয়া, সেপ্টেম্বরে খারকিভের বিশাল অংশ থেকে পিছু হটতে বাধ্য করা আর নভেম্বরে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় বড় শহর খেরসন পুনর্দখল করার পর কিইভ বাহিনী তাদের পাল্টা আক্রমণের জন্য অন্তত ছয় মাস সময় পেয়েছে।
এর মধ্যে তাদের সামরিক বাহিনী পূর্ণাঙ্গ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ১২টি ব্রিগেড বানিয়েছে, যার ৯টিরই প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।
একেকটি ব্রিগেডে সাধারণত সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার সৈন্য থাকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা ৪০ হাজার সেনার ৮টি আক্রমণকারী ব্রিগেড গঠন করা হচ্ছে বলেও ইউক্রেইন আগে থেকে জানিয়েছিল।
দক্ষিণপূর্বে ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণে এখন পর্যন্ত ওই ১২টি ব্রিগেডের মাত্র ৩টিকে দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেইন যুদ্ধকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা পোল্যান্ডভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক কনরাড মুজিকা।
পাল্টা আক্রমণকারী সেনাদের মূল চাপটা যাচ্ছে জাপোরিজিয়ার কিইভ নিয়ন্ত্রিত শহর ওরিখিভ এবং তার ৮০ কিলোমিটার পূর্বে দোনেৎস্কের ভেলিকা নভোসিলকার দিকে।
এই চাপ দেখে মনে হচ্ছে ইউক্রেইনের জেনারেলদের চোখ এখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা শহর তকমাকে। তারও ৫০ কিলোমিটার দূরে আছে মারিওপোল। মস্কো দুটি শহরকেই শক্তিশালী দুর্গ বানিয়ে রেখেছে।
ভেলিকা নভোসিলকার কাছে ইউক্রেইন এখন পর্যন্ত ৪টি গ্রাম মুক্ত করার দাবি করেছে, মঙ্গল ও বুধবার যার দুটি দেখে এসেছে রয়টার্স। এর বাইরে কাছাকাছি আরও দুটি গ্রামও এখন কিইভের নিয়ন্ত্রণে, সোমবার এমনটাই বলেছিলেন ইউক্রেইনের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হান্না মালিয়ার।
“সেনারা সাড়ে ছয় কিলোমিটারের মতো অগ্রসর হয়েছে, ৯০ বর্গকিলোমিটার জায়গা দখলে নিয়েছে”, বলেছিলেন তিনি।
বুধবার তিনি জানান, আগের ২৪ ঘণ্টায় সেনারা কোথাও কোথাও আরও ৩০০-৩৫০ মিটারও এগিয়েছে।
“শুরুর দিকে তারা বেশ ভালো করেছে। কিন্তু আমার উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে, পাল্টা আক্রমণের এই মূল পর্বে মাত্র ৫-৬ দিনের মধ্যে তাদের অগ্রযাত্রা থেমে গেছে। প্রথম কয়েকদিনে তারা যে গতি তৈরি করেছিল, তা হারিয়ে গেছে এখন আর আমরা জানি না, কেন এমনটা হয়েছে,” বলেছেন সমর বিশ্লেষক মুজিকা।
মালিয়ার অবশ্য বাখমুতের ধারেও কিইভের সেনাদের সামান্য অগ্রগতির খবর দিয়েছেন। গত মাসে পূর্বাঞ্চলীয় এই শহরটি পুরোপুরি নিজেদের কব্জায় নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল রাশিয়া।
বাখমুতের এই অগ্রগতির খবর অবশ্য খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে না, কারণ ইউক্রেইনের মূল আক্রমণ এ পথে হবে না বলেই মত বেশিরভাগ সামরিক বিশ্লেষকের।
অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, আকাশে পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমান না থাকায় ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সফল হতে পারছে না।
মাসের পর মাস ধরে কিইভ পশ্চিমাদের কাছে এফ-১৬ জঙ্গিবিমান চেয়ে আসছে; তারা এখন এই ধরনের বিমান পাওয়ার আশ্বাস পেলেও অত্যাধুনিক এই বিমানগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন হতে আরও অন্তত কয়েক মাস লাগবে।
নিজেদের অভিযানের সুরক্ষায় কিইভ এখন প্রায় সবধরনের তথ্যই চেপে রাখছে, যে কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে আসলে কী চলছে, তার সত্যিকারের চিত্র পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেইনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলছেন, ইতিমধ্যেই কিইভবাহিনীর বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত তাদের পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক ব্লগাররা যেসব ছবি শেয়ার করেছেন, তাতে রুশ বাহিনী হাতে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনেকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বানানো ব্র্যাডলি যুদ্ধযান ও লেপার্ড-২ ট্যাংক দেখা গেছে।
ইউক্রেইনের পাল্টা আক্রমণের জন্য পশ্চিমাদের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে এই ব্র্যাডলি ও লেপার্ড ট্যাংক নিয়ে কিইভ ও তার মিত্রদের উচ্চাশাও বেশি ছিল।
মুজিকার অনুমান, ইউক্রেইন সম্ভবত এরই মধ্যে তাদের কাছে থাকা ব্র্যাডলি যানের ১৫ শতাংশ এবং কিছু পরিমাণ লেপার্ড হারিয়েছে। তার মধ্যে কিছু ট্যাংক ও যান ইউক্রেইনের সেনারা পুনরুদ্ধার করে মেরামতের জন্যও পাঠিয়ে থাকতে পারে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক রয়েল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের জন্য লেখায় সামরিক বিশ্লেষক জ্যাক ওয়াটলিং সতর্ক করে বলেছেন, কিইভের এই পাল্টা আক্রমণ সফল কী ব্যর্থ, তা বলার সময় এখনও আসেনি।
“আগেভাগে সফল বা ব্যর্থ ঘোষণা দেওয়া থেকে দূরে থাকা দরকার আমাদের,” বলেছেন তিনি।
আরও খবর: