তুরস্কে ভূমিকম্প: বাড়িতে থাকতে ভয় পাচ্ছেন ইস্তাম্বুলের বাসিন্দারা

ফেব্রুয়ারিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর তুরস্কের বড় বড় নগরীগুলোতে ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইস্তাম্বুলও এর ব্যতিক্রম নয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 March 2023, 05:05 PM
Updated : 12 March 2023, 05:05 PM

মেসুত মুত্তালিবোগলুর শয়নকক্ষের দেয়ালে যে ফাটল রয়েছে সেখানে অনায়াসে একটি গাড়ির চাবি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।

তিনি ফাটলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পাশের একটি অংশ ধরে টান দিলে পলস্তারার একটি বড় টুকরো ভেঙে খুলে এসে মাটিতে পড়ে।

এ কারণে তিনি এবং তার পরিবার ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছেন। যেখানে তারা গত ১৫ বছর ধরে বাস করছিলেন।

গত মাসে তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর মেসুতদের বাড়ির এ অবস্থা হয়েছে। পুরো ভবনটিই ভূমিকম্প সুরক্ষা পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আবার ভূমিকম্প হলে ভবনটি ধসে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে।

ওই ভূমিকম্পের পর তুরস্কের বড় বড় নগরীগুলোতে নতুন একটি জরুরি অবস্থা দেখা দেয়। সেটা হল ভবনের নিরাপত্তা।

ইস্তাম্বুলও তার ব্যতিক্রম নয়। এক কোটি ৫০ লাখ মানুষের বসবাস এই নগরীতে। নগরীটি ভূমিকম্প প্রবণ নর্থ আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইনের উপর অবস্থিত। যে কারণে, ২০৩০ সালের আগে সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভবনের নিরাপত্তার স্বার্থে ইস্তাম্বুলে ১৯৯৯ সালে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে মান বজায় রাখতে কঠোর বিধি আরোপ করা হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নগরীর প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন ওই নিয়ম কার্যকর হওয়ার আগে নির্মিত এবং ওই ভবনগুলো সম্ভাব্য অনিরাপদ বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। 

মাত্র তিন মাস আগে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বড় মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হলে ইস্তাম্বুলে ৯০ হাজারের বেশি মানুষ মারা পড়বে। নগরীকে কত দ্রুত তাই ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তোলা যায় এখনই সেটাই দেখার বিষয়।

ভূমিকম্প কতটা ধ্বংসাত্মক হতে পারে তা মেসুত খুব ভালো করেই জানেন। কয়েক দিন আগেই তিনি ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণের নগরী কাহরামমানমারাস থেকে ফিরেছেন। যেখানে তিনি তার স্বজনদের হারিয়েছেন।

বিবিসি-কে তিনি সে অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে দিয়ে বলেন, ‘‘ভোর ৪টার ১৭ মিনিটের দিকে এটি আরম্ভ হয়। আমার এক আত্মীয় ফোন করেছিলেন এবং আমরা সবাই আতঙ্ক নিয়ে জেগে উঠি।

‘‘ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছিল। তুষারপাতের কারণে প্রথম তিনদিন আমরা কাহরামানমারাস যেতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত যখন আমরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া নগরীতে পৌঁছালাম, সেখানে কঠিন অবস্থা ছিল। যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। প্রার্থনা করি ঈশ্বর যেন আর কাউকে এমন অভিজ্ঞতা না দেন।”

কাহরামানমারাস থেকে মেসুত যখন ইস্তাম্বুলে ফেরেন, ততদিনে কর্তৃপক্ষ তাদের ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘‘আমি তাদের অনুরোধ করি যেন পুনরায় বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেয়। যাতে আমি ফ্ল্যাট ছেড়ে যেতে পারি। তারা আমাকে দুই দিনের সময় দিয়েছিল।

‘‘পৌরসভা থেকে আমাদের লিখিত আকারে সতর্ক করা হয়। কিন্তু প্রতিবেশীদের আপত্তির কারণে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। আমরা জানতাম আমাদের ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে এবং আমরা সেখান থেকে চলে যেতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তারপরই আবার ভূমিকম্প হয় এবং সমস্তটাই নড়বড়ে হয়ে যায়।”

বিবিসি জানায়, ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পের পর ভবনের নিরাপত্তা পরীক্ষার আবেদন জানিয়ে ইস্তাম্বুল পৌরসভায় এক লাখের বেশি নতুন আবেদনপত্র জমা পড়ে।

ভবন মালিক বা ভাড়াটে, যে কেউ ভবনের নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবেন। যদিও আর্থিক কারণে এখনো অনেকে আবেদন করেননি।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থেকে সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে যাদের চলে যেতে হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হারও খুব কম।

কতগুলো ভবন নিরাপত্তা পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে তার হিসাবও ইস্তাম্বুল পৌরসভার কাছে নেই বলে জানায় বিবিসি।

যদিও ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে উদ্ধারকারী দলকে আরো প্রশিক্ষণ এবং ভূমিকম্পের পর আরো বেশি মানুষের জন্য অস্থায়ী শেল্টারের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের জন্য অস্থায়ী শেল্টারের ব্যবস্থা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

কিন্তু অনেকের আশঙ্কা এসব ব্যবস্থা গ্রহণের পরও তা যথেষ্ট হবে না। কেনো হবে না তা ইস্তাম্বুলের সড়কগুলোতে হাঁটলেই বোঝা যায় বলে জানিয়েছেন বিবিসি প্রতিনিধি

কারণ, সেখানে অনেক ভবন এমনভাবে তৈরি যে ভূমিকম্পের সময় যে চাপ তৈরি হয় সেগুলোর সেটা সহ্য করার মতো ক্ষমতা নেই।