কেবল পাখির ধাক্কাতেই ইঞ্জিন বিকল হয়ে জেজু এয়ারের উড়োজাহাজ এতবড় দুর্ঘটনার শিকার হল- মানতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।
Published : 29 Dec 2024, 08:25 PM
দক্ষিণ কোরিয়ায় ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার আসল কারণ কি তা নিয়ে ধন্দে পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে পাখির আঘাতের কারণে হয়ে থাকতে বলে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে রোববার প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে এসে রোববার সকাল ৯টার দিকে (স্থানীয় সময়) দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় জেজু এয়ারের উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে মাত্র দুজনকে জীবীত উদ্ধার করা গেছে।
দুর্ঘটনার কারণের প্রাথমিক তদন্তে বলা হচ্ছে, পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ারে জটিলতা তৈরি হয়। চাকা না খোলায় অবতরণের পর বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজটি রানওয়েতে ছেঁচড়ে গিয়ে বিমানবন্দরের দেয়ালে ধাক্কা খায় এবং অগ্নিগোলকে পরিণত হয়।
কিন্তু উড়োজাহাজটি বিধ্বস্তের আসল কারণ কি তা নিয়ে এখনও রয়ে গেছে সংশয়। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ উড়োজাহাজটির যান্ত্রিক ত্রুটিসহ অন্যান্য আরও কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন: উড়োজাহাজের দুটো ইঞ্জিন কাজ না করা এবং গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দুইপাশে থাকা ব্রেক কাজ না করা। তাদের মতে, কেবল পাখির সঙ্গে ধাক্কা লাগার কারণে উড়ো্জাহাজের সব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র এভাবে একসঙ্গে বিকল হতে পারে না।
তাছাড়া, পাখির আঘাতের কারণে ল্যান্ডিং গিয়ার বিকল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এয়ারলাইন নিউজ এডিটর জিওফ্রি থমাস বলেন, “পাখির সঙ্গে ধাক্কা সচরাচর ঘটেই থাকে। আবার উড়োজাহাজের চাকায় সমস্যা হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। পাখির সঙ্গে ধাক্কার ঘটনা আরও ঘন ঘনই হয়। তবে তাতে সাধারণত গোটা উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারায় না।”
অস্ট্রেলিয়ার উড়োজাহাজ চলাচল বিষয়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জিওফ্রি ডেল বলেন, “পাখির আঘাত ল্যান্ডিং গিয়ার বন্ধ করতে পারে, এমন নজির আমি দেখিনি।”
দক্ষিণ কোরিয়ার এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরে অবতরণের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। ফলে পাইলট না নেমে আকাশে ভেসে থাকতে বাধ্য হন।
দুই মিনিট পর পাইলট ‘মে ডে’ ঘোষণা করলে (বিপদে পড়ার সংকেত) এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল অবতরণের অনুমতি দেয়। উড়োজাহাজটি উল্টো দিক থেকে রানওয়েতে নেমে এলেও ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করায় চাকা ছাড়াই সেটি নেমে আসে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, জোড়া ইঞ্জিনের উড়োজাহাজটি চাকা ছাড়াই রানওয়ে দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ছেঁচড়ে যায়, তারপর রানওয়ে থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিমানবন্দরের দেয়ালে ধাক্কা খায়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায় এবং এর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিকে।
বিশেষজ্ঞরা বেশিরভাগই একমত যে, ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করাই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণ। ভিডিওতে দেখা গেছে ল্যান্ডিং গিয়ার বের হয়নি। বিমানের গতিও অনেক বেশি ছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ার ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ চৈ কি-ইয়ং বলেন, একটি উড়োজাহাজের একাধিক ব্রেক থাকে। আর ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করলে উল্টোদিকে চালিত ইঞ্জিন পাখা বের হতে সাহায্য করে, যেটি ব্রেকের কাজ করে। কিন্তু এই উড়োজাহাজটির ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা কাজ করতে দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাখির ধাক্কায় উড়োজাহাজের একটি ইঞ্জিনও যদি বিকল হয়ে থাকে, তারপরও দ্বিতীয় আরেকটি ইঞ্জিনের সাহায্যে ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ করতে পারত। কিন্তু তা না হওয়ায় যন্ত্রিক ত্রুটি বিমান দুর্ঘটনার কারণ হয়ে থাকতে পারে তেমনটিও ধারণা করা হচ্ছে।
তাছাড়া, কোনও উড়োজাহাজের বেলি ল্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সেটি ধীর গতিতে পাখার সাহায্যে চলার কথা। এরকম কিছুও জেজু এয়ারের উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞ ইয়ং বলেন, তার ধারণা, দুটো ইঞ্জিনই বিকল হয়েছিল। দুই ইঞ্জিন বিকল হয়ে গোটা উড়োজাহাজই নিয়ন্ত্রণ হারায়। সেক্ষেত্রে পাইলটের কমান্ডও আর কাজে আসে না।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন এয়ারলাইন নিউজ এডিটর থমাস। তিনি বলেন, রানওয়েতে ফোম কেন ছড়ানো হয়নি? আগুন নিয়ন্ত্রণ দল কেন উপস্থিত ছিল না? বিমানটি রানওয়ের এতদূরে কেন অবতরণ করল? রানওয়ের শেষে ইটের দেয়াল কেন ছিল?
আবার অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞ জিওফ্রি ডেল বলেন, পাখি ইঞ্জিনে আঘাত করলেও ইঞ্জিন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। আর তখন পাইলটও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কিছুটা সময় পাওয়া কথা।
তাই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ আসলেই কি ছিল, তা আরও পুঙ্ঘানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোরিয়ান এয়ারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাইট এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক কিম-ইন গিউ বলেন, “আমাদেরকে কারণ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। একটি উড়োজাহাজের তিনটি ল্যান্ডিং গিয়ারই কাজ না করা খুবই বিরল ব্যাপার। কেবল পাখির ধাক্কাতেই সেটি হয়েছে এমন উপসংহার টানা কঠিন। উড়োজাহাজটির আগে থেকেই কোনও সমস্যা ছিল কিনা সেটিও আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার।”
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন এবং পাখির ধাক্কাসহ সব সম্ভাব্য কারণ পরীক্ষা করে দেখছেন। তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে আরও তথ্য প্রয়োজন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্ঘটনার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে।