ইউক্রেইন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির ঠিক আগে দিয়ে চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইর মস্কো সফর নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক সমর্থন বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বেইজিংও এটা খুব ভালো করেই জানে। তারপরও তারা সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও চীন এখনো দাবি করে আসছে, ইউক্রেইন যুদ্ধের বিষয়ে তাদের অবস্থান নিরপেক্ষ।
তবে বেইজিংয়ে এ সপ্তাহের শুরুতে একটি সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুইন গ্যাং সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, যদি নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ আগুনে ঘি ঢালা বন্ধ না করে তবে ইউক্রেইন যু্দ্ধ নিয়েন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ বলতে তিনি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছেন। যারা সরাসরি ইউক্রেইনের সেনাবাহিনীকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে এবং একইসঙ্গে চীনকে হুঁশিয়ার করে বলছে, তারা যেন রাশিয়াকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করে।
যুদ্ধ বর্তমানে যে পর্যায়ে তাতে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, এখন চীন যদি দেখে ইউক্রেইনে পুতিন লজ্জাজনকভাবে হেরে যাচ্ছেন তখন বেইজিং কী করবে।
যদিও আমেরিকার অনেক গবেষকের বিশ্বাস, বেইজিং এরইমধ্যে রাশিয়ায় এমন সব সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি পাঠিয়েছে যেগুলো বেসামরিক এবং সামরিক উভয় খাতেই ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ, বেইজিং তাদের পাঠানো সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি বেসমারিক খাতে ব্যবহারের জন্য পাঠানো হয়েছে দাবি করলেও চাইলে সেগুলো সামরিক খাতেও ব্যবহার সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে তারা যুদ্ধবিমান মেরামতের প্রযুক্তির কথা বলেছেন।
এদিকে, রাশিয়ার অর্থনীতি বাঁচাতে চীন কোনো রাখঢাক ছাড়াই যেভাবে দেশটি থেকে তেল ও গ্যাস কিনছে, তাতে রাশিয়ার জ্বালানির উপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনীতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারছে না।
তবে কি চীন ধীরে ধীরে ইউক্রেইন যুদ্ধে নিজেদের প্রকৃত অবস্থান প্রকাশ্যে আনছে?
চীনের বৈদেশিক নীতি বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ওয়াংয়ের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের ছবিও দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ্যে আনার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইদানিংকালে বৈঠকের জন্য লম্বা টেবিল পুতিনের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছিল। সেই টেবিল এতটাই লম্বা এবং তার দুই প্রান্তে বসা দুই নেতার মাঝে দূরত্ব এতটাই বেশি থাকতে দেখা গেছে যে, চিৎকার করে না বললে দু’জন পরষ্পরের কথা ঠিক মত শুনতে পাননি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
অথচ, ওয়াংয়ের সঙ্গে পুতিনকে ডিম্বাকৃতির একটি টেবিলের মাঝের দুই প্রান্তে বসে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। তাদের মাঝে দূরত্ব এত কম যে তারা চাইলে করমর্দন করতে পারেন।
এই ছবি নিশ্চিতভাবেই বাকি বিশ্বকে দেখাতে একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে পুতিন হয়তো বোঝাতে চাইছেন, চীন রাশিয়ার কত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং তিনি দেশটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কতটা নিরাপদ বোধ করছেন।
যদিও দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক সব সময় এমন ছিল না। বরং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পরমাণু যু্দ্ধ লেগে যেতে আশঙ্কায় নাগরিকদের নিরাপদ রাখতে বেইজিং জুড়ে মাটির নিচে শেল্টার বানিয়েছিল চীন। যা আজও রয়ে গেছে।
তবে এই মুহূর্তে চীন রাশিয়াকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শত্রু হিসেবে দেখছে। অনেকটা উত্তর কোরিয়ার মত। যারা আন্তর্জাতিকভাবে অচ্ছুত হয়ে পড়েছে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে।
গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ‘বেইজিং উইন্টার অলিম্পিক’ আয়োজনে যোগ দিতে চীন সফরে গিয়েছিলেন পুতিন। সেখান থেকে ফিরে তিনি চীনের সঙ্গে তার দেশের নতুন ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্বের কথা বলেছিলেন।
অনেকের মনেই পরে প্রশ্ন জেগেছে, শি যখন পুতিনের পাশে বসেছিলেন তখন কি তাকে আসন্ন যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল। কারণ, পুতিনের মাথায় তখন যুদ্ধা ছাড়া অন্য কিছু থাকার কথা না।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চীন খুবই সূক্ষ্ম পথ ধরে হেঁটে চলেছে। শি হয়তো ভাবছেন তিনি খুবই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেই পথে হেঁটে চলেছেন। কিন্তু কেউ কেউ বলছেন, ওই পথ ভেঙ্গে পড়ছে এবং বেইজিং আর খুব বেশি দিন ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানের দাবিতে অটল থাকতে পারবে না।
পুতিনের সঙ্গে মঙ্গলবার বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে ওয়াং সাংবাদিকদের বলেছেন, দুই দেশে এক সঙ্গে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতার’ প্রচারের পথে কাজ করছে।
যদিও বিশ্বের অন্য প্রান্তের কাছে এই ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতার’ বার্তা হাস্যকর মনে হচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রথম বার্ষিকীর ঠিক আগে দিয়ে ওয়াংয়ের রাশিয়ার সফরের পর।
শিগগির চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংও রাশিয়া সফরে যাবেন বলে জানিয়েছেন পুতিন। অর্থাৎ, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শি হয়তো রাশিয়া যাচ্ছেন।
ইউক্রেইন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাশিয়া আসলে চীনের পথ পরিষ্কার করছে, অনেকে এমনটাও বলছেন। কারণ, এই যুদ্ধে পশ্চিমাদের সামরিক সক্ষমতার ব্যাপক ক্ষয় হচ্ছে, বাড়ছে নেটোর উপর চাপ।
রাশিয়ার অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু সেটা বেইজিংয়ের কাছে আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা আদতে তা গুরুত্বপূর্ণ কিনা। কারণ, যুদ্ধ পরবর্তী অর্থনীতির পুনর্গঠনে রাশিয়ার আরো বেশি চীনা পণ্যের প্রয়োজন হবে।
ইউক্রেইন যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় তাতে রাশিয়ার সেখানে জয়ের সম্ভাবনা দিন দিন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইউক্রেইনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এখন চীন যদি রাশিয়ার পাশে দাঁড়ায় তবে তা ইউরোপকে আরো রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করবে।
এটা ঠিক যে, চীনকেও সতর্ক থাকতে হবে। শি’র উচিত হবে না এমন কিছু করা যার ফলে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বাকি বিশ্বও নিশ্চয়ই চাইছে না এশিয়ার এই জায়ান্টকে ইউক্রেইন যুদ্ধে টেনে আনতে।