গাজা-ইউক্রেইনসহ বহু জায়গায় যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার গুরুত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তবে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং অনেক জোটে প্রধান ভূমিকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বমঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ।
Published : 01 Nov 2024, 07:50 PM
আর মাত্র তিনদিন পরই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। আমেরিকানরা তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাকে বেছে নেয় তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ববাসী।
ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস কি বাইডেনের দেখানো পথ অনুসরণ করে তার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাবেন? নাকি ‘বিশ্ববাদ নয়, আমেরিকাবাদ’ বিশ্বাস নিয়ে আবারও “মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” বলবেন ডনাল্ড ট্রাম্প?
আমরা এমন এক বিশ্বে বাস করছি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের মূল্য কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আঞ্চলিক শক্তিগুলো নিজস্ব পথে চলছে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা তাদের নিজ নিজ মিত্র তৈরি করে নিচ্ছে। গাজা, ইউক্রেইনসহ বিশ্বজুড়ে অন্যান্য স্থানে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ওয়াশিংটনের ভূমিকার গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি এবং অনেক জোটে দেশটির প্রধান ভূমিকার কারণে তারা এখনও বিশ্বমঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক শক্তি:
নেটোর সাবেক ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রোজ গোটেমোয়েলার বলেন, “ডনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের দুঃস্বপ্ন। নেটো জোট থেকে তার দেশের বেরিয়ে যাওয়ার হুমকির প্রতিধ্বনি এখনও সবার কানে বাজে।”
ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা ব্যয় নেটোর অন্য ৩১ সদস্যের সামরিক বাজেটের দুই-তৃতীয়াংশ। নেটোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক খাতে চীন ও রাশিয়াসহ পরবর্তী ১০টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়েও বেশি ব্যয় করে।
ট্রাম্প গর্ব করে বলেছেন, অন্যান্য নেটো রাষ্ট্রকেও তাদের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বাধ্য করবেন তিনি। সেই ব্যয় তাদের জিডিপি’র ২ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র ২৩ সদস্য রাষ্ট্র।
তবে হ্যারিস জিতলে নেটো নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের হাতে থাকবে বলে মনে করেন গোটেমোয়েলার। কিন্তু সেখানেও রয়েছে বিপত্তি।
গোটেমোয়েলার সতর্ক করে দিয়ে বলনে, ইউক্রেইনে বিজয় অর্জনের জন্য হ্যারিস নেটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকবেন। তবে হ্যারিস ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া থেকে পিছ পা হবেন না।
অবশ্য যাই ঘটুক না কেন, গোটেমোয়েলার মনে করেন “নেটো ভেঙে পড়বে না। তবে ইউরোপের 'নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসার দরকার পড়বে'”।
শান্তি স্থাপনকারী?
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য এমন একটি বিশ্ব অপেক্ষা করছে যেখানে শান্তির চেয়ে সংঘাত বেশি। এই যুদ্ধ মোকাবেলা করেই তাকে কাজ করে যেতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফোর্ট ইরো বলেন, “শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবচেয়ে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক শক্তি। তবে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধানে সহায়তা করার শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কমে গেছে।”
যুদ্ধ শেষ করা দিনদিন কঠিন হয়ে পড়েছে। ইরোর মতে, “প্রাণঘাতী সব সংঘাত আরও জটিল হয়ে উঠছে, বড় বড় শক্তির দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং মাঝারি শক্তির দেশগুলোর ক্ষমতা বাড়ছে।”
ইরো আরও বলেন, “ইউক্রেইনের মতো যুদ্ধ একাধিক শক্তিকে টেনে রেখেছে। আবার সুদানের মতো সংঘর্ষগুলো একে-অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থের সঙ্গে আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের ক্ষমতার খেলায় নামার সুযোগ করে দেয়। এখন সবাই শান্তি রক্ষার চেয়ে যুদ্ধেই বেশি বিনিয়োগ করে।”
ইরোর মতে, আমেরিকা তার নৈতিকতার উঁচু স্থান হারাচ্ছে। তিনি বলেন, “কমলা হ্যারিসের জয় বর্তমান প্রশাসনের ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করে।"
“কিন্তু ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় আসেন তবে, তিনি গাজা ও মধ্যপ্রাচ্যে চলমান বহুমুখী যুদ্ধে ইসরায়েলকে আরও আশকারা দিতে পারেন। এমনকি, কিইভকে টপকে গিয়ে মস্কোর সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা করতে পারেন।”
মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হ্যারিস বারবার ইসরায়েলের 'আত্মরক্ষার অধিকারের' প্রতি বাইডেনের দৃঢ় সমর্থনের প্রতিধ্বনি করেছেন।
তবে তিনি জোর দিয়ে এও বলেছেন যে, “নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা বন্ধ করতে হবে।”
ট্রাম্পও বলেছেন, “এখন শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং মানুষ হত্যা বন্ধ করার সময়।” তবে অন্যদিকে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বলেছেন, “আপনার যা করণীয় তা করুন।”
রিপাবলিকান এই প্রার্থী নিজেকে শান্তি স্থাপনকারী হিসাবে বর্ণনা করে থাকেন।
কিছুদিন আগে সৌদি আরবের আল আরাবিয়া টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করব এবং শিগগিরই।”
ট্রাম্প ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো ইসরায়েল এবং কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করেছে।
তবে ইউক্রেইনের বিষয়ে ট্রাম্প কখনওই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো শক্তিশালীদের প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি।
তবে তিনি স্পষ্ট করে এও বলেছেন যে, ইউক্রেইনে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান। সাম্প্রতিক একটি নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি যাব। আমাদের যেতেই হবে।’
ওদিকে, হ্যারিস ইউক্রেইনের মিত্র হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কমলা হ্যারিস বলেন, 'ইউক্রেইনের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি গর্বিত। আমি ইউক্রেইনের পাশে থাকব। আর এই যুদ্ধে ইউক্রেইনের জয় নিশ্চিত করতে কাজ করব।”
তবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ও সিইও কমফোর্ট ইরো আশঙ্কা করছেন,. যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যিনিই নির্বাচিত হন না কেন, বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বেইজিংয়ের সঙ্গে ব্যবসা:
চীনের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত রানা মিত্র বলেন, “বর্তমানে পুরো বিশ্বেই কয়েক দশকের মধ্যে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা চলছে।” তার মধ্যে আমদানি করা সব চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প তার "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির আওতায় চীন এবং অন্যান্য অনেক বাণিজ্য অংশীদারদের উপর চড়া শুল্ক চাপিয়ে দিতে নাছোড়বান্দা। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ভাল সম্পর্কের কথাও ফলাও করে বলেছেন ট্রাম্প।
তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডকে বলেছিলেন, “বেইজিং যদি তাইওয়ান দখলের চেষ্টা করে তবে তাকে সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে হবে না । কারণ চীনা নেতা "আমাকে সম্মান করেন এবং তিনি জানেন আমি ক্ষ্যাপাটে।”
তবে নেতৃস্থানীয় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা উভয়ই মনে করে, চীন প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আমেরিকাকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে।
ওদিকে, চীনের নেতারা মনে করেন, হ্যারিস ও ট্রাম্প উভয়ই কঠোর হবেন।
তবে হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলে যুক্তরাষ্ট্র-এশিয়া সম্পর্ক বিষয়ে এসটি লি চেয়ারের দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মিত্তরের মতে, হ্যারিস হবেন মন্দের ভাল।
জলবায়ু সংকট:
নেলসন ম্যান্ডেলার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব নেতাদের গ্রুপ ‘দ্য এল্ডার্স’ এর চেয়ার এবং আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ম্যারি রবিনসন বলেন, “জলবায়ু ও প্রকৃতি সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কেবল দেশটির নাগরিকদের জন্য নয় বরং গোটা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে এবং মিল্টনের মতো বিধ্বংসী হারিকেনের তাণ্ডব ঠেকাতে প্রতিটি পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু হারিকেন মিল্টন এবং হেলেন যখন তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট এই দুর্যোগে জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় পরিবেশগত পরিকল্পনা ও নীতিমালা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে উপহাস করেছেন।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে ট্রাম্প সরে আসবেন, যেমনটি তিনি তার প্রথম মেয়াদে করেছিলেন।
মানবিক নেতৃত্ব:
জাতিসংঘের মানবিক ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয় বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে অতুলনীয় প্রভাব বিস্তার করে তা কেবল সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমেই নয়, বরং বিশ্ব মঞ্চে নৈতিক কর্তৃত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।”
গ্রিফিথস বলেন, হ্যারিস জিতলে তাও ভালো কিছু আশা করা যায়। কিন্তু আবার যদি সেই "একতরফাবাদ এবং একলা চল নীতি নেওয়া ট্রাম্প ফিরে আসেন, তাহলে বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যাবে।”
তবে মধ্যপ্রাচ্যের অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের সমালোচনাও করেছেন তিনি।
ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গতবছর ৭ অক্টোবর হামাসের প্রাণঘাতী হামলা নিয়ে বারবারই নিন্দা জানিয়েছেন ত্রাণ সংস্থাগুলোর প্রধানরা। তবে তারা বারবার গাজার পাশাপাশি লেবাননে বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে আরও কিছু করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বানও জানিয়েছেন।
বাইডেন এবং তার শীর্ষ কর্মকর্তারা অনবরত গাজায় আরও বেশি বেশি ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়ে আসলেও মাঝেমধ্যে এর তারতাম্যও দেখা গেছে।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, গাজায় সাহায্য সরবরাহ এবং ইসরায়েলকে এর জন্য তাদের চাপ প্রয়োগ করাটা কখনওই যথেষ্ট ছিল না।
জাতিসংঘের সহয়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একক বৃহত্তম দাতা। ২০২২ সালে তারা রেকর্ড ১৮.১ বিলিয়ন ডলার (১৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড) দিয়েছে।
কিন্তু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রেসিডেন্সির প্রথম মেয়াদেই জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থার তহবিল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও সরে দাঁড়ান তিনি। অন্য দাতারা তখন সেই শূণ্যস্থান পূরণ করতে নেমেছিল। আর ট্রাম্প এটাই চেয়েছিলেন।
জাতিসংঘের মানবিক ও জরুরি ত্রাণ সমন্বয় বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল গ্রিফথস অবশ্য এখনও বিশ্বাস করেন আমেরিকা বিশ্বের একটি অপরিহার্য শক্তির দেশ।
তিনি বলেন, “বৈশ্বিক সংঘাত ও অনিশ্চয়তার এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্বশীল ও নীতিবান নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে উঠে দাঁড়াক সেটিই বিশ্ববাসীর কাম্য।”