দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়, বরং এই চুক্তিকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হিসেবে দেখছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
Published : 18 Jan 2025, 12:44 AM
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতির সমঝোতা হয়েছে, তাতে ১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধের অবসান এবং দুই দেশের হাতে ‘জিম্মি’ থাকা মানুষের মুক্তির একটা আশা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন, নানা কারণে চুক্তিটির বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
তারা বলছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সায় দেয় শুক্রবার সন্ধ্যায়। যদিও এই অনুমোদন দেওয়ার কথা ছিল আগের দিন, যেটা শেষমেশ স্থগিত হয়ে যায়।
আরেকটা উদ্বেগের বিষয় হল, চুক্তিটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। যেগুলোর একেক ধাপে একেক ধরনের শর্ত রয়েছে। এসব শর্ত মেনে চলার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইসরায়েলের তরফে লঙ্ঘন করার বেশ ঝুঁকি দেখছেন বিশ্লেষকরা।
প্রথম পর্যায়ের ৪২ দিনে দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু বন্দি ও জিম্মি বিনিময় হওয়ার কথা রয়েছে। ফিলিস্তিনের জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং ত্রাণ কার্যক্রম বাড়ানোর কথাও রয়েছে প্রথম পর্যায়ে।
এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো বন্দি ও জিম্মি বিনিময় হবে। এই পর্যায়ে গাজা থেকে স্থায়ীভাবে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার ও টেকসই যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ারও কথা রয়েছে।
আল জাজিরা লিখেছে, হামাসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্তির পরেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চেহারা বদলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
হামাসকে দুর্বল করতে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাড়াতে, নিজের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে এবং হামাসের ঘাড়ে চুক্তি লঙ্ঘনের দায় চাপিয়ে দিতে পুনরায় হামলা শুরু করতে পারেন নেতানিয়াহু, যিনি কয়েক মাস ধরে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করে আসছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন’ সম্পর্ক বিশ্লেষক মাইরাভ জনসজেইন বলেন, “যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করা এবং লঙ্ঘনের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়ে ইসরায়েল বেশ পারদর্শী।”
সাময়িক স্বস্তি
গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ। যুদ্ধের কারণে ছোট ভূখণ্ডটির প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দাকে কয়েকবার উপত্যকাটির ভেতরের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছুটে বেড়াতে হয়েছে।
এমন অবস্থায় সেখানে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি।
কিন্তু বন্দি বিনিময়ের পরেই এই চুক্তির ‘পতন’ দেখতে পাচ্ছেন জনসজেইন। তিনি বলেন, “গাজায় ত্রাণ তৎপরতা চালানো কিংবা দুই পক্ষের বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রে এই চুক্তি সাময়িক একটা স্বস্তি এনে দেবে।
“কিন্তু এই চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়, এটাকে সাময়িক যুদ্ধবিরতি বলা যেতে পারে।”
ফিলিস্তিনের আইনবিদ ও ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সাবেক মধ্যস্থতাকারী দিয়ানা ভুট্টোও মনে করেন, চুক্তির অস্পষ্টতার কারণে ইসরায়েল যে কোনো সময় এটি লঙ্ঘন করবে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “চুক্তির একটা অংশে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজা উপত্যকার সীমান্তে ফিরে যেতে হবে। ১৯৬৭ সালে নির্ধারিত সীমান্তে ফিরে যাওয়ার কথা কিন্তু চুক্তিতে বলা হয়নি।”
ফলে ইসরায়েলি বাহিনীকে আদৌ পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন দিয়ানা ভুট্টো।
‘রাজনৈতিক ভয়’
এবার যে চুক্তি হচ্ছে, প্রায় একই ধরনের একটি চুক্তির প্রস্তাব গত বছরের মে মাসেও উঠেছিল। হামাস রাজি থাকলেও ইসরায়েল সেটি প্রত্যাখ্যান করে। আর চুক্তি প্রত্যাখ্যানের পরেই গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ শহরে হামলা চালায় ইসরায়েল।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, নিজেদের রাজনৈতিক জোটের জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়ার জন্যই চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হামলা অব্যাহত রাখেন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহুর এই ‘রাজনৈতিক ভয়কে’ দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করছেন ইসরায়েলের অতি ডানপন্থিরা। অতি ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মটরিচ ও জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির সম্প্রতি হুমকি দেন, নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে সই করলে তারা জোট থেকে বেরিয়ে যাবেন।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক হিউ লোভ্যাট বলেন, “ইসরায়েলের রাজনীতিতে নেতানিয়াহুকে সবাই প্রভাবশালী একটা চরিত্র হিসেবেই দেখে। কিন্তু তার রাজনৈতিক ভয়কে কীভাবে ডানপন্থিরা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে, সেটাও লক্ষ্য করার মত একটা ব্যাপার।”