লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি খারাপ ফল করায় জোটসঙ্গীদের ওপর নির্ভর করতে গিয়ে এখন তাদের নানা দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার গ্যাড়াকলে পড়েছে।
Published : 05 Jun 2024, 09:36 PM
ভারতে গত ১০ বছরে দু’দফার প্রধানমন্ত্রীত্বেও নরেন্দ্র মোদীকে যা দেখতে হয়নি এবার সেই কঠিন বাস্তবতারই মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। মঙ্গলবার ঘোষিত লোকসভা নির্বাচনে মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সেকারণে কেন্দ্রে সরকার গড়তে এবার মোদী হয়ে পড়েছেন ‘পরনির্ভর’। তাকে ভরসা করতে হচ্ছে এনডিএ জোটসঙ্গীদের ওপর।
আর এই জোটসঙ্গী বলতে সবার চোখ এখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার এবং তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডুর দিকে। কারণ, নীতীশের জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) পেয়েছে ১২টি আসন এবং টিডিপি পেয়েছে ১৬টি আসন।
বলা হচ্ছে, এ দু’দলই এবারের ‘কিংমেকার’। তারা এখন রাজনৈতিক দরকষাকষিতে যেতে পারে। তাই তাদেরকে হাতে রাখতে মোদীর বিজেপি-কে কী মূল্য দিতে হয় সেটিই এখন দেখার বিষয়।
দল দুটি বর্তমানে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের শরিক হলেও বিরোধী দল কংগ্রেসও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে শোনা গেছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট ২৩২ আসন জয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ফলে তারাও শরিক জোগাড়ের চেষ্টায় নীতীশ এবং নাইডুর সঙ্গে কথা বলতে পারে বলে জল্পনা সৃষ্টি হয়।
অতীতে এ দুই দলের নেতারই একাধিক বার এনডিএ জোট ত্যাগ করা এবং ফিরে আসার ইতিহাস রয়েছে। বিরোধী ইন্ডিয়া জোট গড়ার শুরুতে নীতীশ কুমার প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন, পরে তিনি আবার দলবদল করে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান।
কংগ্রেস সেকথা ভুলে নীতিশ কুমারের সঙ্গে কথা বলেছে এবং জোট শরিক না হলেও সরকার গঠনে বড় ফ্যাক্টর হতে চলা চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে কথা বলেছে বলে শোনা গেছে। যদিও এমন গুঞ্জনের মাঝে জেডিইউ এবং টিডিপি –দুই দল জোরের সঙ্গেই বলেছে, তারা বিজেপি’র এনডিএ জোটে থাকবে।
বিজেপি বুধবার সন্ধ্যায় জোটসঙ্গীদের সঙ্গে রাজধানী দিল্লিতে বৈঠক ডেকেছিল। সামনের দিনগুলোতে কী করণীয় তা ঠিক করতে ডাকা হয় এ বৈঠক। জেডিইউ এবং টিডিপি নেতা উভয়ই এ বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে মোদী কোনও ঝুঁকিও নেননি। দুজনের কাছ থেকেই নিয়েছেন লিখিত সমর্থন।
নীতীশ এবং নাইডু উভয়েই ঝানু রাজনীতিবিদ। জোট সরকারে থাকার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। দরকষাকষিতেও তারা বেশ দক্ষ।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে জোটসঙ্গীদের যা দিতো তা নিয়েই তাদের খুশি থাকতে হত। কিন্তু এবার বিজেপি ভোটে অপ্রত্যাশিত খারাপ ফল করায় শরিকদের নানা দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার গ্যাড়াকলে পড়েছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদরা দরকষাকষিতে তাদের নানা দাবি আদায় করে নেওয়ার সুযোগ নিশ্চয়ই হাতছাড়া করবেন না।
কী চায় দুই শরিক?
নীতীশ কুমারের জেডিইউ এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা বিজেপি’র কাছে কী চাইতে পারে। কিন্তু চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি এখনও মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
এনডিটিভির সঙ্গে আলাপকালে জেডিইউর জ্যেষ্ঠ নেতা কেসি ত্যাগী বলেছেন, “আমন্ত্রণ জানানো হলে’ তার দল সরকারে যোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, নতুন সরকার বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা বিবেচনা করবে এবং দেশব্যাপী জাতিভিত্তিক আদমশুমারি পরিচালনা করবে।
কেসি অবশ্য এও বলেছেন, এনডিএ জোটকে জেডিইউ-এর সমর্থনের শর্ত এটি নয়। তিনি বলেন, “আমাদের সমর্থন নিঃশর্ত। তবে বিহার বিশেষ মর্যাদা না পাওয়া পর্যন্ত বেকারত্ব অবসান হবে না। তাই, বিহারের কাছ থেকে এনডিএ যে সমর্থন পেয়েছে, সেকথা মাথায় রেখে আমরা আশা করি, বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, জাতিশুমারি পরিচালনার যে দাবি কেসি ত্যাগী করেছেন সেটি বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার তোলা একটি মূল ইস্যু।
ভারতে বিশেষ করে তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য নীতি তৈরিতে সহায়ক হিসাবে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাসহ জনসংখ্যা অনুযায়ী মানুষের অধিকার দেওয়ার জন্যও এই জাত সমীক্ষার বিষয়টি নির্বাচনের সময় সামনে এনেছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া।
নীতিশ কুমার ইন্ডিয়া ছেড়ে বিজেপি’র এনডিএ-তে ফেরার আগে তার জোট সরকার রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) এবং কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে বিহারে একটি জাতিশুমারি পরিচালনা করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতিশুমারি ইস্যুতে নীরব,ছিলেন। তিনি নীরব কেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল কংগ্রেস ৷ তবে জেডিইউ নেতা ত্যাগী বলছেন, “মোদী কখনও দেশব্যাপী জাতিশুমারির বিরোধিতা করেননি। এটি সময়ের দাবি।”
জেডিইউ কী চায় সে বিষয়ে কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও টিডিপি কী চাইতে পারে বিজেপি নেতৃবৃন্দের কাছে সে সম্পর্কে এখনও পরিষ্কার কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দলীয় সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় সরকারে কোনও মন্ত্রণালয় চাইতে পারে টিডিপি।
আরেকটি মূল বিষয় হিসেবে অন্ধ্র প্রদেশের বিশেষ মর্যাদার প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে। মূলত, এই বিশেষ মর্যাদার দাবি নিয়ে বিরোধের জেরেই ২০১৬ সালে বিজেপি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নাইডু।
টিডিপি প্রধান নাইডু বিশাল জয় নিয়ে অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষমতায় ফিরেছেন। রাজ্যর পুনর্গঠন এবং রাজধানীর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। তাকে এখন সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। আর তাই এবার রাজ্যের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক সুবিধা এবং রাজধানীকে স্বপ্নের আইটি পার্ক বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চাইতে পারেন নাইডু।
আপাতত, টিডিপি এবং জেডিইউ- দুই দলই জোর দিয়ে বলছে, তারা এনডিএ’র সঙ্গেই থাকছে। বিজেপি’র সঙ্গে আগে থেকেই সখ্যতা থাকায় এবং আসন সমীকরণের দিক থেকে দুই নেতা হয়ত এনডিএ-তেই থেকে যেতে পারেন। তবে জোটের রাজনীতি খুবই অনিশ্চিত। ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে যে কোনও টানাপোড়েনেই জোট হয় বিপন্ন। আর দুই কিংমেকার যখন চন্দ্রবাবু নাইডু আর নীতিশ কুমার, তখন কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।