আসাদকে কাছে টেনে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া বার্তা সৌদি আরবের

সৌদি আরবের নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ আর পশ্চিমা দেশটির চোখ রাঙানিতে বিরক্ত সৌদি ক্রাউন্স প্রিন্স এখন অন্য পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চাইছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2023, 12:18 PM
Updated : 24 May 2023, 12:18 PM

একসময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘অচ্ছুৎ’ বিবেচিত সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান গত সপ্তাহে সিরিয়াকে আরব লীগে ফিরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রিয়াদের ক্ষমতা বিষয়ে ওয়াশিংটনকে বার্তা পাঠিয়ে নিজেকে ফের বিশ্বমঞ্চে অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন।

আরব জোটে সিরিয়ার প্রত্যাবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের অনীহা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উষ্ণ অভিবাদন, গালে চুমু আর প্রগাঢ় আলিঙ্গনের মাধ্যমে সৌদি যুবরাজ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার অবস্থান যে এখনও একেবারেই নড়বড়ে হয়ে যায়নি তারও স্বাক্ষর রাখলেন, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ইউক্রেইন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত, তেল নির্ভরশীল বিশ্বে নিজেদের জ্বালানি সক্ষমতাকে ব্যবহার করে এমবিএস এখন সৌদি আরবকে ফের মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম নীতিনির্ধারক দেশে পরিণত করার চেষ্টা করছেন।

২০১৪ সালে সৌদি হিট স্কোয়াড সাংবাদিক জামাল খাশুগজিকে হত্যা করার পর পশ্চিমা দেশগুলো সৌদি এই ক্রাউন প্রিন্সের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল; কিন্তু নানান পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি এখন মধ্যপ্রাচ্যে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন যে ওয়াশিংটন তাকে উপেক্ষা বা অস্বীকার তো করতেই পারছে না। উল্টো অনেক ইস্যুতেই এই যুবরাজের সঙ্গে বসতে হচ্ছে, তাকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হচ্ছে।

সৌদি আরবের নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দেহ এবং পশ্চিমা দেশটির চোখ রাঙানিতে বিরক্ত এমবিএস এখন অন্য পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে কাজ করছেন; ওয়াশিংটনের চোখ কপালে তুলে দিয়ে তিনি সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্রের কমন শত্রুদের সঙ্গে নতুন সম্পর্কও দাঁড় করাতে চাইছেন।

বিশ্বমঞ্চে তার তুমুল আত্মবিশ্বাস কেবল আসাদকে অভ্যর্থনা জানানোতেই প্রকাশিত হয়নি, ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জেদ্দা সফরেও তা দেখা গেছে।

ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে এমবিএস কিইভ আর মস্কোর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। তেল উৎপাদক রাশিয়ার সঙ্গে অনেক ইস্যুতেই সৌদি আরবের মাখামাখি এখন স্পষ্ট।

অবশ্য সৌদি আরব এখনও সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল; ওয়াশিংটনই তাদেরকে কয়েক দশক আগে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরে ইরানের সামরিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রিয়াদকে তার অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও সরবরাহ করে যাচ্ছে।

তা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনকে এখন মধ্যপ্রাচ্যে তুলনামূলক কম প্রভাবশালী মনে হচ্ছে, রিয়াদের উদ্বেগ নিরসনেও তাদের খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এমবিএসও তার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্রের মতকে খানিকটা সরিয়ে রেখে নিজেদের আঞ্চলিক নীতি অনুসরণ করছে।

“যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সৌদি আরবের দিক থেকে এটি একটি শক্তিশালী বার্তা, যেখানে বলা হচ্ছে- আমরা তোমাকে ছাড়াই সম্পর্কগুলো পুনর্নির্মাণ করছি,” বলেছেন গালফ রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান আবদুলআজিজ আল-সগীর। 

আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিবেচনায় নিয়েই রিয়াদ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে মিশছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তিনি (এমবিএস) যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যা চাইছেন, তা পাচ্ছেন না।”

রয়টার্স বলছে, ইউক্রেইন যুদ্ধে অস্থিতিশীল তেলের বাজারের অস্থিরতা কমিয়ে আনতে গত বছর পশ্চিমা দেশগুলো সৌদি আরবের দ্বারস্থ হওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে উঠল।

ওই দরকষাকষিতে এমবিএস ‘কূটনৈতিক আক্রমণে’ নামার সুযোগ পেলেন, যা তাকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে হাজির হওয়ারও উপায় করে দিল।

সৌদি এই ক্রাউন প্রিন্সই যে খাশুগজি হত্যার নির্দেশদাতা, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা বলার পরও ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার থেকে ওয়াশিংটন দায়মুক্তি দিলে এমবিএসের কাজ আরও সহজ হয়ে যায়।

রিয়াদ যে ফের বিশ্বমঞ্চে প্রভাব নিয়ে ফিরছে, গত বছরের জুলাইয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সৌদি সফর তা স্পষ্ট করে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ওই সফর থেকে খালি হাতে ফিরলেও সৌদি নিরাপত্তায় মার্কিন প্রতিশ্রুতির পুনঃউচ্চারণ এমবিএসের প্রভাব পাকাপোক্ত করেছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনছে নানা পদক্ষেপে তার ইঙ্গিত মিলছিল; চলতি বছর রিয়াদ আর তার আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ তেহরানের মধ্যে চুক্তিতে চীনের মধ্যস্থতা বিষয়টিকে প্রকাশ্যেই নিয়ে আসে।

এর মাধ্যমে রিয়াদ দেখিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে কাজ করতে পারদর্শী এবং কূটনৈতিকভাবেই তারা তাদের ক্ষতি কমাতে ও স্বার্থসিদ্ধিতে পারঙ্গম।

একসময়কার বৈরি দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সৌদি আরব এরই মধ্যে ইয়েমেনে সংঘাতকে অনেকটাই ঠাণ্ডা করতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে তার সেনারা ২০১৫ সাল থেকেই আটকে আছে।

এর পাশাপাশি সৌদি প্রিন্স তুরস্কের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছেন, প্রতিবেশী কাতারকে বয়কটের পথ থেকে সরেও এসেছেন।

“গত তিন বছর ধরে ওই দা-কুমড়া সম্পর্ককে কবর দেওয়া হয়েছে, সম্পর্ক মেরামত করার কাজ চলছে,” সংবাদমাধ্যম আল-আওসাতে এমনটাই বলেছেন সৌদি কলামিস্ট আবদুলরহমান আল-রাশেদ।

উপসাগরীয় একটি দেশের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময়ে অন্যান্য দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রিয়াদকে ভয় পাইয়ে দেয়।

সেসময় যুক্তরাষ্ট্র পুরনো মিত্রদের ছুড়ে ফেলছিল, একইভাবে তারা সৌদ রাজবংশকেও ত্যাগ করতে পারে এমন আশঙ্কার গোড়াপত্তন হয় সৌদি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে।

এরপর আসে ইরান পরমাণু চুক্তি, তাতে তেহরানের বিষয়ে ওয়াশিংটনের নমনীয় নীতি সৌদি আরবকে আরও সন্দিহান করে তোলে। ওই চুক্তির সুযোগ নিয়ে ইরানঘনিষ্ঠ বিভিন্ন শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী হতে শুরু করে।

এরপর ইয়েমেনে সৌদি অভিযান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রত্যাহার রিয়াদকে ব্যাপক অসন্তুষ্ট করে। ওয়াশিংটন অবশ্য তার আগে থেকেই, সৌদি আরবকে তার নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে তাগাদা দিয়ে আসছিল।

সৌদি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ না থাকায় এবং সৌদি আরবকে সহযোগিতা কমিয়ে দেওয়ায় রিয়াদের হাতে তেহরানের সঙ্গে চুক্তি করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।

“যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডেরই প্রতিক্রিয়া এটি,” বলেছেন তিনি।

পরিস্থিতি এখন এমন যে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব দুই পক্ষের হাতেই অনুরোধের এমন তালিকা আছে, যা অপরপক্ষ পূরণে আগ্রহী নয়, বলেছেন উপসাগরীয় ওই কর্মকর্তা।

তবে  তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষকেই এখন নিজেদের ক্ষোভ দমিয়ে রাখতে হচ্ছে। 

সৌদি আরব হয়তো দেখছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপের নিরাপত্তা ছাতা দিন দিন দুর্বল হচ্ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াশিংটন সৌদি প্রতিরক্ষায় এখনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর হাতেও বিকল্প নেই। কেবল মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেই নয়, অস্থিতিশীল তেলের বাজারেরও জন্যও রিয়াদকে তাদের দরকার।

এই প্রয়োজনীয়তাই দুই পক্ষকে এখনও মিত্র বানিয়ে রাখছে। তবে তার মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের কড়া বার্তা চোখ এড়াচ্ছে না।