পশ্চিমা প্রযুক্তি বাজারে এই ভার্চুয়াল কর্মী নির্মাণের প্রযুক্তি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা না হলেও চীনের বাজারে এই প্রযুক্তির কদর প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
Published : 03 Jan 2023, 01:23 PM
গ্রাহকসেবা খাত থেকে শুরু করে বিনোদন শিল্পেও ‘ভার্চুয়াল কর্মী’ নিয়োগে আগ্রহ বেড়েছে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এমন ডিজিটাল কর্মীদের পেছনে বছরে ১৪ হাজার ডলার খরচ করতেও আপত্তি নেই তাদের।
চীনের প্রথমসারির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাইদু বলছে, ২০২১ সাল থেকে তাদের ‘ভার্চুয়াল পিপল প্রজেক্ট’ সংখ্যায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই ভার্চুয়াল কর্মীদের পেছনে বছরে দুই হাজার আটশ ডলার থেকে শুরু করে ১৪ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ করতে রাজি আছেন ক্রেতারা।
অ্যানিমেশন, সাইন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সমন্বয়ে ওই ‘ভার্চুয়াল কর্মী’দের সৃষ্টি করছে বাইদুর মতো কোম্পানিগুলো। এমনকি লাইভস্ট্রিমে মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা ও গান গাওয়ার সক্ষমতাও আছে তাদের।
পশ্চিমা প্রযুক্তি বাজারে এই ভার্চুয়াল কর্মী নির্মাণের প্রযুক্তি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা না হলেও চীনের বাজারে এই প্রযুক্তির কদর প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি।
ভার্চুয়াল কর্মী ক্রেতার তালিকায় আছে চীনের একাধিক আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি, স্থানীয় পর্যটন বিভাগ। এমনকি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব সংবাদমাধ্যমগুলোও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন বাইদুর ‘ভার্চুয়াল পিপল অ্যান্ড রোবটিক্স’ প্রধান লি শিয়ান।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই খাতের উৎপাদন খরচ গত এক বছরে ৮০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। একটি ত্রিমাত্রিক ভার্চুয়াল মানুষের পেছনে এক বছরের খরচ এখন এক লাখ ইউয়ান বা ১৪ হাজার তিনশ ডলার। আর ভার্চুয়াল মানুষটি দ্বিমাত্রিক হলে তার খরচ মাত্র ২০ হাজার ইউয়ান।
২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে ভার্চুয়াল কর্মী নির্মাণ শিল্প আকারে ৫০ শতাংশ করে বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছেন লি। এই প্রযুক্তির অগ্রগতিতে চীনও বাড়তি জোর দিচ্ছে বলে জানিয়েছে সিএনবিসি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে জনপ্রিয়তা খুইয়েছেন চীনের প্রথমসারির বেশ কিছু তারকা ব্যক্তিত্ব। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প মুখপাত্রের খোঁজ করছে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো।
২০২৫ সালের মধ্যে ভার্চুয়াল কর্মী নির্মাণ খাতের আকার বাড়িয়ে পাঁচ হাজার কোটি ইউয়ানে নেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বেইজিংয়ের নগর কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়াও অন্তত দুটি ‘ভার্চুয়াল কর্মী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান’ নির্মাণের কথা বলেছে নগর কর্তৃপক্ষ, প্রতি বছরের যার মুনাফা হবে পাঁচশ কোটি ইউয়ানের বেশি।
গত শরতে উৎপাদন ও প্রচারণা শিল্পসহ অন্যান্য খাতে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি প্রযুক্তি সমন্বয়ের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো। গত বছরে প্রকাশিত দেশটির পাঁচ বছর মেয়াদী আর্থিক পরিকল্পনায় সার্বিক অর্থনীতির ডিজিটাল রূপান্তরের ওপর বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে চীন; ভার্চুয়াল ও অগমেন্টেড রিয়ালিটি খাতও আছে তার অধীনে।
কেলেঙ্কারিমুক্ত আইকন খুঁজছে চীন
সিএনবিসি জানিয়েছে, ব্যবসায়িক দৃষ্ঠিকোণ থেকে ভার্চুয়াল কর্মীরা কীভাবে নতুন নতুন কনটেন্টের উৎস হতে পারে সেদিকে জোর দিচ্ছে কোম্পানিগুলো।
কর ফাঁকি অথবা ব্যক্তিপর্যায়ের কেলেঙ্কারির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে জনপ্রিয়তা খুইয়েছেন চীনের প্রথমসারির বেশ কিছু তারকা ব্যক্তিত্ব। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো বিকল্প মুখপাত্রের খোঁজ করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ‘কান্টার’-এর প্রধান পণ্য কর্মকর্তা এবং বাজারজাতকরণ প্রধান সিরিয়াস ওয়াং।
কান্টারের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কেবল গত বছরেই একজন ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সার বা ডিজিটাল সেলেব্রেটির পারফর্মেন্স দেখেছেন চীনের ভোক্তাদের ৩৬ শতাংশ। ভার্চুয়াল চরিত্রকে কোনো আয়োজনের উপস্থাপনা বা সংবাদ পড়তে দেখেছেন ভোক্তাদের ২১ শতাংশ।
কান্টারের নিজস্ব গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালে একজন ভার্চুয়াল ইনফ্লুয়েন্সারকে নিয়োগ দেওয়া বা পারফর্মেন্সের খরচ মেটানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৪৫ শতাংশ বিজ্ঞাপনদাতা।
ভার্চুয়াল মানুষ নির্মাণে ঝুঁকছে চীনা প্রযুক্তি বাজার
সিএনবিসি জানিয়েছে, ভার্চুয়াল মানুষ নির্মাণে তৎপরতা বাড়িয়েছে চীনের বেশ কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। ভার্চুয়াল মানুষের ভাবনাকে চীনের বাজারের মূলধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল যে কোম্পানিগুলো, তার মধ্যে অন্যতম একটি কোম্পানি হচ্ছে ভিডিও ও গেইম স্ট্রিমিং অ্যাপ বিলিবিলি।
ভার্চুয়াল গায়িকা লুও তিয়ানইর নির্মাতা কোম্পানি কিনে নিয়েছিল বিলিবিলি। লুও তিয়ানইর দৃশ্যায়ন ও কণ্ঠ পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর। ভার্চুয়াল গায়িকার কণ্ঠস্বর উন্নত করতে এর নির্মাতারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন বলে দাবি বিলিবিলির।
চীনের প্রযুক্তি বাজারে তিয়ানইর অভিষেক হয়েছে ২০১২ সালে। সিএনবিসি জানিয়েছে বর্তমানে ভার্চুয়াল চরিত্রটির ভক্তের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি এবং বেইজিংয়ে গতবছরে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও পারফর্ম করেছিল তিয়ানই।
ভার্চুয়াল উপস্থাপকও আছে বিলিবিলির। দর্শক-শ্রোতার কাছে পোঁছাতে ওই অ্যাভাটারগুলো ব্যবহার করেন কিছু মানুষ। ২০১৯ সাল থেকে নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে দুই লাখ ৩০ হাজার ভার্চুয়াল উপস্থাপকের উপস্থিতি আছে বলে দাবি বিলিবিলির। আর ২০২২ সালে ভার্চুয়াল উপস্থাপকদের কার্যক্রম আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে দুইশ শতাংশ।
চীনের আরেক প্রযুক্তি জায়ান্ট টেনসেন্ট জানিয়েছে, আর্থিক সেবা এবং পর্যটন খাতে স্বয়ংক্রিয় গ্রাহকসেবা ব্যবস্থা চালু করতে চ্যাটবট সরবরাহ করবে ‘টেনসেন্ট ক্লাউড এআই ডিজিটাল হিউম্যানস’ বিভাগ। ইতোমধ্যে একজন ভার্চুয়াল গায়িকা এবং সাংকেতিক ভাষার ভার্চুয়াল অনুবাদক নির্মাণ করেছে কোম্পানিটি।
চীনের ছোট কোম্পানিগুলোও এখন একই পথে হাঁটছে বলে লিখেছে সিএনবিসি।