ইরানের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণে হ্যাকার সংগঠনগুলো

দাবিগুলোর সত্যতা যাচাই করা কঠিন হলেও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের অভ্যন্তরীণ ডিজিটাল অবকাঠামোয় হ্যাকারদের হামলার একাধিক ইঙ্গিত পেয়েছেন তারা।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Oct 2022, 03:10 PM
Updated : 5 Oct 2022, 03:10 PM

ইরানে হিজাব আইনবিরোধীদের পাশে দাঁড়িয়েছে অ্যানোনিমাসসহ প্রযুক্তিবিশ্বের পরিচিত হ্যাকারদের সংগঠনগুলো; ইরানের সরকারি অবকাঠামোর ওপর চলছে বহুমুখী সাইবার হামলা।

সিএনবিসি জানিয়েছে, ইরানী কর্মকর্তা এবং সংস্থার ওপর সাইবার হামলা চালাতে অনলাইনে সংঘবদ্ধ হয়েছেন হাজারো হ্যাকার। ইরান সরকার দেশের ইন্টারনেট সংযোগের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তা পাশ কাটানোর টিপসও দিচ্ছেন তারা।

২২ বছর বয়সী কুর্দিশ তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত করে রেখেছে ইরান সরকার।

ইরানের নীতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৬ সেপ্টেম্বর তেহরানের একটি হাসপাতালে মারা যান আমিনি। সঠিকভাবে হিজাব না পরার করার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল ইরানের নীতি পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আমিনির ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিল ইরানী পুলিশ। কিন্তু ইরানের কর্মকর্তাদের দাবি, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি।

এ বিষয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর পায়নি সিএনবিসি। অন্যদিকে, সোমবারেই হিজাব বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন দেশটির শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করে দেশব্যাপী প্রতিবাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের ইন্ধনকে দায়ী করেছেন তিনি।

চলছে ডিডিওএস আক্রমণ আর ডক্সিং

২৫ সেপ্টেম্বর ইরানের সংসদের কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের দাবি করেছে হ্যাকারদের আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যানোনিমাস। দেশটির আইনপ্রণেতাদের ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার দাবি করেছে সংগঠনটি।

হ্যাকারদের সংগঠনটির অংশ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ইরানী সংসদের কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাকিংয়ের করার দাবি করেছে একটি ইউটিউব চ্যানেল।

“যেখানে দেশের নাগরিকদের সমর্থন করার কথা সেখানে একনায়ককে সমর্থন করছে ইরানের সংসদ। তাই আমরা তাদের সবার ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছি,” ভিডিওতে কণ্ঠ পাল্টে এ দাবি করেছে অ্যানোনিমাসের স্বঘোষিত প্রতিনিধি।

অন্যদিকে, এনক্রিপ্টেড মেসেজিং সেবা টেলিগ্রামে আরেক হ্যাকার দল ‘অ্যাটলাস ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ দাবি করেছে, ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সেলিব্রেটিদের ফোন নম্বর এবং ইমেইলের ঠিকানা ফাঁস করে দিয়েছে তারা। হ্যাকারদের মধ্যে এ প্রক্রিয়াটি ‘ডক্সিং’ নামে পরিচিত।

হ্যাকারদের দলটি ইরানী সেনাবাহিনীর ‘ইসলামিক রেভুলুশনারি গার্ড কোর’-এর লোকেশন ডেটাও বেচার চেষ্টা করেছে বলে জানিয়েছে সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চেক পয়েন্ট।

ইরান সরকারের বিভিন্ন সেবা, মন্ত্রণালয় এবং সংস্থা থেকে ডেটা চুরি করে ফাঁস করে দেওয়ার দাবি করেছে অ্যানোনিমাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হ্যাকার দলগুলো। এ ছাড়াও ইরানের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রায়ত্ব সংবাদমাধ্যমের ওপরেও সাইবার হামলা চালানোর দাবি করেছে হ্যাকাররা।

হ্যাকারদের দাবিগুলোর সত্যতা যাচাই করা কঠিন হলেও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের অভ্যন্তরীণ ডিজিটাল অবকাঠামোয় হ্যাকারদের হামলার একাধিক ইঙ্গিত পেয়েছেন তারা।

“হ্যাকারদের আক্রমণে সরকারি ওয়েবসাইট অফলাইনে চলে যাওয়ার কিছু ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি।” -- সিএনবিসিকে জানিয়েছেন চেক পয়েন্ট রিসার্চের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লিয়াদ মিজরাচি। হামলার বেশিরভাগই ডিডিওএস হামলা ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।

ওয়েবসাইট বা সার্ভারের সক্ষমতার চেয়ে বেশি ডেটা ট্রাফিক বিভিন্ন উৎস থেকে পাঠিয়ে সেটা অচল করে দেওয়ার কৌশল ‘ডিস্ট্রিবিউটেড-ডিনায়াল-অফ-সার্ভিস’ বা ডিডিওএস হামলাা।

অন্যদিকে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ম্যানডিয়ান্টের বিশ্লেষক এমিয়েল হাফবার্ট সিএনবিসিকে বলেছেন, “যে সেবাগুলোর ওপর সাইবার হামলা চালানোর দাবি করা হয়ছে তার বেশ কয়েকটি বিভিন্ন সময়ে অফলাইন ছিল বলে নিশ্চিত ম্যানডিয়ান্ট; কিছু এখনও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে আছে।”

“সার্বিক বিবেচনায় এই ডিডিওএস এবং ডক্সিং অপারেশনগুলো ইরান সরকারের ওপর নীতিমালা পরিবর্তনের চাপ আরও বাড়াতে পারে,”-- যোগ করেন তিনি।

আর এক্ষেত্রে অ্যানোনিমাসের সংশ্লিষ্টতা সংগঠনটির অতীত আচরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে জানিয়েছেন হাফবার্ট। এ বছরের শুরুতেই ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে রাশিয়ার সরকারি অবকাঠামোয় একাধিক সাইবার হামলা চালিয়েছিল সংগঠনটি।

ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতিবন্ধকতা পাশ কাটানোর টিপস দিচ্ছে হ্যাকাররা

তেহরান দেশের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার পর ইরানের নাগরিকদের ‘ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক’ বা ভিপিএন, প্রক্সি সার্ভার এবং ডার্ক ওয়েব ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছে হ্যাকাররা। এ কৌশলগুলো ব্যবহার করে অনলাইনে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে পারেন ব্যবহারকারী; ওই ব্যক্তিকে অনুসরণ করতে পারে না ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার বা আইএসপিরাও।

পাঁচ হাজার সদসের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে হ্যাকাররা ইরানের নাগরিকদের উন্মুক্ত ভিপিএন সার্ভার ব্যবহারের প্রক্রিয়া বাতলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে সিএনবিসি।

চার হাজার সদস্যের আরেকটি দল প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার সংক্রান্ত শিক্ষামূলক কনটেন্টের লিংক সরবরাহ করছে বলে উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে।

দেশে সরকার বিরোধী প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ায় ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থার লাগাম টেনে ধরে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম অ্যাপগুলো ব্লক করে দিয়েছে ইরান। নারীদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের ভিডিও আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রকাশ হওয়া ঠেকাতেই দেশটি এ কাজ করেছে বলে ধারণা করছে সিএনবিসি।

প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশের হামলায় রোববার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দেড়শ ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানের স্বাধীন ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলো। মৃত্যের সংখ্যা ৪১ বলে দাবি করেছে ইরান সরকার।

একাধিকবার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্লাউডফ্লেয়ার এবং ইন্টারনেট পর্যবেক্ষক দল নেটব্লক্স।

ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে তেহরানের এক তরুণ পেশাজীবী সিএনবিসিকে জানিয়েছেন, “ইরানের বাইরে থাকা বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ইন্টারনেটের অবস্থা খুবই এলোমেলো, তাই কখনো কখনো আমরা টানা কয়েকদিন কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না।”

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে সিএনবিসিকে নিজের পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন ওই তরুণ।

“ইনস্টাগ্রামে আমার সীমিত প্রবেশাধিকার আছে, তাই আমি আপাতত এটাই ব্যবহার করছি।” সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে তিনি ও তার বন্ধুরা ভিপিএন সেবা ব্যবহার করছেন বলে জানিয়েছেন ওই ব্যক্তি।

“ওরা হত্যাকাণ্ড লুকাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিচ্ছে।”-- সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ইরানের অধিকারকর্মীদের শেয়ার করা একাধিক পোস্টে রয়েছে এ বার্তা। প্রতিবাদের ভিডিওতে পুলিশি নির্যাতনও উঠে এসেছে।

ডিজিটাল স্বাধীনতা কর্মীরা ইরানের নাগরিকদের টর ব্রাউজার ব্যবহার শেখাচ্ছেন বলেও জানিয়েছে সিএনবিসি। ব্যবহারকারীর অনলাইন কর্মকাণ্ডের ওপর আইএসপির নজরদারির পথ বন্ধ করে দেয় টর ব্রাউজার।

“ইরানের বিষয়ে এই প্রথমবারের মতো হ্যাকারা জড়াচ্ছেন, বিষয়টা এমন নয়।” -- সিএনবিসিকে বলেছেন সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কির বৈশ্বিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক আমিন হাসবিনি।