মহামারীর প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে থাকা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে গুটি গুটি পায়ে আবার মহাকাশ জয়ের লক্ষ্যে এগোনো শুরু করেছে সৌরজগতের নীল গ্রহটি।
Published : 06 Dec 2022, 02:31 PM
এখনও ইন্টারস্টেলার সিনেমার মতো নতুন পৃথিবীর খোঁজে ওয়ার্মহোলে ঝাঁপ দেওয়ার সক্ষমতা হয়নি মানব সভ্যতার, মঙ্গলেও পড়েনি প্রথম মানবের পায়ের ছাপ; চাঁদে ফেরার কথা ভাবতেও এখনও অন্তত ১০১টি হিসেব কষতে হচ্ছে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের।
কিন্ত, মহামারীর প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে থাকা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে গুটি গুটি পায়ে আবার মহাকাশ জয়ের লক্ষ্যে এগোনো শুরু করেছে সৌরজগতের নীল গ্রহটি।
শীতল যুদ্ধের শেষে দমে যাওয়া মহাকাশ উন্মাদনা নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে ২০২২ সালে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের অর্জন আর অগ্রগতিতে।
এ বছরে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী স্পেস টেলিস্কোপের তোলা ছবিতে পৃথিবীর জন্মের আগের মহাবিশ্ব দেখেছে মানবজাতি, চাঁদে নভোচারীদের ফেরানোর প্রতিশ্রতি নিয়ে উপগ্রহটিকে চক্কর দিয়ে পৃথিবীর পথ ধরেছে নাসার নতুন ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফট; অন্যদিকে পশ্চিমা খবরদারিতে ত্যক্ত-বিরক্ত চীন মহাকাশে বানিয়ে নিয়েছে নিজেদের প্রথম স্পেসস্টেশন।
সব মিলিয়ে, মানবসভ্যতার মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে ২০২২ ছিল একটি ঘটনাবহুল বছর। পৃথিবীর সীমানার বাইরে এ বছর নতুন কোথাও মানুষের ছাপ পড়েনি; কিন্তু সেই অসাধ্য সাধনের জন্য যা জানা বা করা প্রয়োজন, তার জোগাড়যন্ত্র শুরু হয়ে যাওয়ার বছর ২০২২।
দূর মহাকাশের একলা প্রহরী জেডব্লিউএসটি
পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে আরও ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরের শীতল মহাকাশে একলা প্রহরীর মতো মহাবিশ্বের দিকে নজর রাখছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)।
ওয়েব টেলিস্কোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নাম বেশি শোনা গেলেও কৃতিত্ব কেবল মার্কিনিদের নয়; বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অপটিকাল স্পেস টেলিস্কোপের নকশা, নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)।
ওয়েব টেলিস্কোপের মহাকাশযাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছরের বড় দিনে। কিন্তু এর সাড়া জাগানো, পত্রিকার পাতা ছাপানো ফল মিলেছে এ বছরই। জেমস ওয়েবের তোলা প্রথম ছবি নাসা প্রকাশ করেছে এ বছরের ১২ জুলাই। আর প্রথম ছবিতেই যেন বাজিমাত করে দিয়েছে স্পেস টেলিস্কোপটি।
পৃথিবীর জন্মপূর্ব মহাবিশ্বের একটুকরা ফুঁটে উঠেছে ওয়েবের প্রকাশিত প্রথম ছবিতে। তারপর থেকে একে একে পিলারস অফ ক্রিয়েশন, শনির চাঁদ টাইটানের মেঘ, দুই ছায়াপথের এক হয়ে যাওয়া, বৃহস্পতির অরোরার চোখ ধাঁধানো ছবি পাঠিয়ে মহাকাশ প্রেমীদের মাতিয়ে রেখেছে ওয়েব টেলিস্কোপ।
টেলিস্কোপের সেন্সরে পাওয়া তথ্য শোনার উপযোগী অডিও ফাইলেও রূপান্তর করেছেন নাসার প্রকৌশলীরা। আর মহাবিশ্বের সেই আওয়াজকে ভৌতিক বললেও সম্ভবত ভুল বলা হবে না।
‘ডায়নোসরের পরিণতি চাই না’
সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল এক গ্রহাণু, আর সে ঘটনার পার্শপ্রতিক্রিয়াতেই বিলুপ্ত হয়েছিল পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানোর ডায়নোসরেরা – অন্তত এমনটাই মত বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর।
১১ হাজার সাতশ বছর আগে শেষ হওয়া বরফ যুগের পেছনেও উল্কাপাত বা গ্রহাণুর হাত ছিল বলে মনে করেন কেউ কেউ। যদিও বড় বিতর্ক আছে এই তত্ত্ব নিয়ে; উভয় তত্ত্বের কেন্দ্র রয়েছে একটি বিষয়, দূর মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা কিছু আছড়ে পড়ার কারণে বড় ক্ষতি হয়েছিল পৃথিবীর। আর সেই ঝুঁকি এখনও আছে।
Don't want to miss a thing? Watch the final moments from the #DARTMission on its collision course with asteroid Dimporphos. pic.twitter.com/2qbVMnqQrD
— NASA (@NASA) September 26, 2022
মানবসভ্যতার পরিণতি যেন জাদুঘরে শোভা পাওয়া ডায়নোসরের কঙ্কালের মতো না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে এ বছর ৬৮ লাখ মাইল দূরের ডাইমরফোস গ্রহাণুর দিকে ‘ডার্ট’ ছুড়ে দিয়েছিল নাসা।
মহাকাশে ছুটে চলা কোনো গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার হুমকি তৈরি করলে, সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য মহাকাশযান দিয়ে কীভাবে ধাক্কা মেরে তার এর গতিপথ বদলে দেওয়া যায় – ডার্ট মিশন ছিল সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম পরীক্ষা।
ATLAS observations of the DART spacecraft impact at Didymos! pic.twitter.com/26IKwB9VSo
— ATLAS Project (@fallingstarIfA) September 27, 2022
ডার্ট ২৭ সেপ্টেম্বর ১৬০ মিটার চওড়া গ্রহাণুতে আঘাত হানার ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মহাকাশযানের গায়ে বসানো ক্যামেরা দিয়ে পুরো ঘটনা প্রবাহের ওপর নজর রেখেছিল নাসা। সফল হয়েছে সে মিশন। আবার কোনো গ্রহাণুর পৃথিবীর দিকে ঝাঁপ দেওয়ার খায়েস তৈরি হলে মানব সভ্যতার যে তাকে প্রতিহত করার নূন্যতম সক্ষমতাটুকু আছে, তা এখন বলাই যায়।
টু দ্য মুন অ্যান্ড বিয়ন্ড
ডিজনির ‘টয় স্টোরি’ সিনেমাটির ভক্তদের কাছে খুব পরিচিত একটা সংলাপ হচ্ছে ‘টু ইনফিনিটি অ্যান্ড বিয়ন্ড’। সংলাপটি যে চরিত্রের, সহজ করে বললে সেই বাজ লাইটইয়ারও এক নভোচারী।
নাসা বাজ লাইটইয়ারের সংলাপ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল বললে সম্ভবত বাড়িয়েই বলা হবে; তবে এ বছরে নাসা চাঁদ আর পৃথিবীর সীমানার বাইরের মহাকাশ জয় করতে যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে তাতে বলাই যায় যে, নাসার লক্ষ্য এখন ‘টু দ্য মুন অ্যান্ড বিয়ন্ড’।
টানা তিনবারের ব্যর্থতার পর অবশেষে ১৬ নভেম্বর আর্টেমিস ওয়ান মিশন উৎক্ষেপণ করেছে নাসা। চাঁদে শেষবার কোনো মানব নভোচারীর পায়ের ছাপ পড়ার পাঁচ দশক পর আবারও চাঁদে ফিরতে উঠে পড়ে লেগেছে মার্কিন সংস্থাটি। আর সেই স্বপ্ন পূরণে নভোচারীদের চাঁদে বয়ে নেবে যে মহাকাশযান, সেই ওরিয়ন ক্যাপসুল এখন চাঁদকে ঘিরে চক্কর দিয়ে পৃথিবীর পথ ধরেছে।
পুরো মিশনের মূল লক্ষ্য দুটি; প্রথমত, নিজেদের তৈরি ‘স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস)’ রকেটের কার্যক্ষমতা যাচাই করে দেখতে চায় নাসা। আর দ্বিতীয়ত ওরিয়ন স্পেসক্র্যাফট নভোচারীদের মহাকাশে আনা-নেওয়া করার জন্য নির্ভরযোগ্য কিনা, সেটিও পরীক্ষার বিষয়।
Breathtaking: A close up top-down view of the Artemis 1 launch!
— World and Science (@WorldAndScience) December 3, 2022
(Credit: NASA Johnson) pic.twitter.com/JJwMz0mUZ5
১১ ডিসেম্বর পৃথিবীতে ফেরার কথা রয়েছে ওরিয়নের। এ মিশনের সাফল্য-ব্যর্থতার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে নাসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।
কারণ, এবার চন্দ্রজয়ের পরিকল্পনার পেছনে কোনো শীতল যুদ্ধের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নেই; বরং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। বয়স ফুরিয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের (আইএসএস)। তাই চাঁদে নতুন বাণিজ্যিক স্পেস স্টেশন ‘গেইটওয়ে’ নির্মাণের কথা ভাবছে নাসা। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোরও ‘গেইটওয়ে’ ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।
কেবল গেইটওয়ে নয়, চাঁদে নভোচারীদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করতে চায় নাসা। আরও দূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা হচ্ছে, গেইটওয়ে আর চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে মঙ্গল অভিযান পরিচালনা করা।
আর নাসার এই ‘টু দ্য মুন অ্যান্ড বিয়ন্ড’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চাবিকাঠি হচ্ছে আর্টেমিস ওয়ান মিশনের এসএলএস রকেট আর ওরিয়ন মহাকাশযান।
ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং নতুন একটি স্পেস স্টেশন
২০১১ সালে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত তুলে আইন পাশ করে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)-এ চীনা নভোচারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছিল মার্কিন কংগ্রেস; সেই ক্ষোভ ভোলেনি চীন।
পশ্চিমাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এক দশক পড়ে মহাকাশে নিজেদের স্পেস স্টেশন ‘তিয়ানগং’-এর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে ‘চায়না ম্যানড স্পেস এজেন্সি (সিএমএসএ)’।
প্রথমে দুটি অস্থায়ী স্পেস স্টেশন তিয়ানগং-১ এবং তিয়ানগং-২ বানিয়ে হাত পাকিয়ে নিয়েছিল চীনের সিএমএসএ। এরপর ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিলে মডিউলার স্পেস স্টেশন তিয়ানগংয়ের প্রথম মডিউল ‘তিয়ানহে’ মহাকাশে পাঠিয়েছিল চীনা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
এর পরের দেড় বছরে একে একে মহাকাশে পৌঁছেছে তিয়ানগংয়ের বাকি মডিউলগুলো। এতো কম সময়ে মহাকাশে একটি দীর্ঘ মেয়াদী স্পেস স্টেশন নির্মাণ করে কার্যত বিশ্বকে চমকে দিয়েছে চীন।
চীন তিয়ানগংয়ের নকশা করেছে রাশিয়ার ‘মির’ স্পেস স্টেশনের নকশা অনুকরণ করে। ভূপৃষ্ঠের ৩৪০ কিলোমিটার থেকে ৪৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় ভেসে আছে স্পেস স্টেশনটি। মহাকাশে মানব জীবনধারণের খুঁটিনাটি আর অন্যান্য বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সবটাই এখন নিজস্ব স্পেস স্টেশনে করতে পারবে চীন।
২৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো হাতবদল হয়েছে স্পেস স্টেশনটির নিয়ন্ত্রণ। শেষ পর্যায়ের নির্মাণকাজের দায়িত্ব থাকা নভোচারীদের কাছ থেকে তিয়ানগংয়ের নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিয়েছেন নতুন তিন নভোচারী। আর এই ‘ক্রু হ্যান্ডওভার’-এর মধ্যে দিয়েই পুরোপুরি চালু হয়েছে তিয়ানগংয়ের কার্যক্রম।
পশ্চিমা প্রযুক্তি ও সহযোগিতার সক্ষমতা ছাড়াই মহাকাশে প্রথম স্পেস স্টেশন নির্মাণের কৃতিত্ব এখন চীনের, আর সেটি ঘটল এই ২০২২ সালেই।