“বর্ণনা দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দ খুঁজে পাইনি আমরা। বাহ্যিক উৎস থেকে তথ্য নিতে পারে এটি, সেই তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়াও জানায়।”
Published : 13 Oct 2022, 02:54 PM
ল্যাবরেটরিতেই মানব মস্তিষ্কের কোষ বড় করেছেন গবেষকরা। ৭০-এর দশকে নির্মিত টেনিস ধাঁচের ভিডিও গেইম ‘পং’ খেলে সংবেদনশীলতার প্রমাণও দিয়েছে সেই ‘মিনি-ব্রেইন’।
পাঁচ মিনিটেই ভিডিও গেইম খেলতে শিখে গিয়েছিল ল্যাবে বড় হওয়া মস্তিষ্ক কোষ।
কম্পিউটিং ডিভাইসের সঙ্গে মানব মস্তিষ্কের জ্যান্ত কোষ জুড়ে দিয়ে জৈবিক বুদ্ধিমত্তা সৃষ্টির লক্ষ্য কাজ করছে ‘কর্টিকাল ল্যাবস’। সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নিউরন’-এর এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো গবেষণাগারে ‘সংবেদনশীল মিনি-ব্রেইন’ তৈরির দাবি করেছেন কোম্পানিটির গবেষক ড. ব্রেট কাগান।
অন্যান্য গবেষকরা কাগানের গবেষণার অগ্রগতিকে ‘উত্তেজনাপূর্ণ’ বলে আখ্যা দিলেও, কোষগুলোকে ‘সংবেদনশীল’ বলার বেলায় দ্বিধাবিভক্ত বলে জানিয়েছে বিবিসি।
কিন্তু ড. কাগানের ভাষ্যে, “ডিভাইসটির বর্ণনা দেওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দ খুঁজে পাইনি আমরা। বাহ্যিক উৎস থেকে তথ্য নিতে পারে এটি, সেই তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়াও জানায়।”
বাজারে বিদ্যমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সিস্টেমের চেয়ে দ্রুত শিখতে পারে মানব মস্তিষ্ক; মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাও বেশি এর। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, নতুন প্রজন্মের কম্পিউটারের জন্য এটাই কী আরও ভালো মডেল?
‘মাইক্রোসেফালি’ নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে গবেষকরা প্রথম ‘মিনি-ব্রেইন’ সৃষ্টি করেছিলেন ২০১৩ সালে। জিনগত ত্রুটির কারণে মস্তিষ্কের আকার ছোট হওয়ার ব্যাধি ‘মাইক্রোসেফালি’। তারপর থেকেই মানব মস্তিষ্ক নিয়ে নানা গবেষণার কাজে ‘মিনি-ব্রেইন’ ব্যবহার করছেন গবেষকরা।
এবারই প্রথম ল্যাবরেটরিতে বড় হওয়া কোনো ‘মিনি-ব্রেইন’ বাহ্যিক কোনো উৎসের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি; এ ক্ষেত্রে যা ছিল একটি ভিডিও গেইম।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, স্টেম সেল এবং ইঁদুরের ভ্রুণ থেকে মানব মস্তিষ্কের আট লাখ কোষ বড় করেছেন গবেষকরা। তারপর ইলেকট্রোডের মাধ্যমে ভিডিও গেইম খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন ‘মিনি-ব্রেইন’টিকে।
প্রতিক্রিয়ায় নিজে থেকেই বৈদ্যুতিক সিগনাল তৈরি করতে শুরু করে ল্যাবরেটরিতে বেড়ে ওঠা মস্তিষ্ক কোষ। গেইম খেলার সময়ে নিজের শক্তি খরচও কমিয়ে আনে এরা।
কিন্তু গেইম রিস্টার্ট করা হলে নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন করে কার্যপ্রণালী সাজায় কোষগুলো। ওই সময়ে বেড়েছিল শক্তি খরচও।
গেইমটি মূলত একটি প্যাডল নিয়ন্ত্রণ করে স্ক্রিনে ভাসতে থাকা একটি বলকে স্ক্রিনের বাইরে পড়ে যাওয়া ঠেকানোর। বিবিসি জানিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই প্যাডেল দিয়ে বল ঠেকাতে মিস করেছে মিনি-ব্রেইন। কিন্তু এর সাফল্যের হারও কাকতালীয় সুযোগের চেয়ে অনেক বেশি।
তবে, গবেষকরা এটাও বলেছেন যে, যেহেতু মস্তিষ্কটি সচেতন নয়; একজন মানুষ যেভাবে জানেন যে তিনি গেইম খেলছেন, মিনি-ব্রেইনটি সেভাবে নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত নয়।
আসল উদ্দেশ্য কী?
বিবিসি জানিয়েছে, এ প্রযুক্তি আলঝেইমারের মতো রোগের চিকিৎসা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহার করা যাবে বলে আশা করছেন ড. কাগান।
“মানুষ যখন পেট্রি ডিশে কোষের দিকে তাকায়, তারা যা দেখে তা হচ্ছে এতে কোনো (রাসায়নিক) কার্যকলাপ হচ্ছে কি না? কিন্তু মস্তিষ্কের কোষের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা।”
“এই কোষগুলোর মৌলিক ক্রিয়ায় উঁকি দিতে পারলে তাতে আরও অনেক গবেষণার পথ খুলবে” বলে যোগ করেন তিনি।
এরপর অ্যালকোহলের সংস্পর্শে মিনি-ব্রেইন ভিডিও গেইম খেলতে পারে কি না, সে পরীক্ষা চালাতে চান ড. কাগান।
সে পরীক্ষাতেও ল্যাবরেটরিতে বড় হওয়া মস্তিষ্কের কোষ যদি মানব মস্তিষ্কের মতোই আচরণ করে তবে তাতে মিনি-ব্রেইনের সক্ষমতাই প্রমাণিত হবে বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি।
গবেষকরা বলছেন, এআই সিস্টেমের চেয়ে পারিপার্শিক বা বাহ্যিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বেশি মিনি-ব্রেইনের।
তবে, ড, কাগান যেখাবে নিজের উদ্ভাবনকে ‘সংবেদনশীল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তা শব্দটির আবিধানিক সংজ্ঞার সঙ্গে ঠিক মেলে না বলে জানিয়েছে বিবিসি। শব্দটির আবিধানিক অর্থ বলে, অনুভূতির সক্ষমতাই সংবেদনশীলতা।
তাই একে, ‘চিন্তাশীল ব্যবস্থা’ বলে আখ্যা দিতেই বেশি পছন্দ করেন কার্ডিফ সাইকোলজি স্কুলের অনারারি সহযোগী গবেষক ড. ডিন বার্নেট।
“এতে অবশ্যই তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে এবং তার ব্যবহারের ফলে পরিবর্তন আসছে। কিন্তু তারা যে ফলাফল পাচ্ছেন তা একেবারেই মৌলিক পর্যায়ের,” বিবিসিকে বলেন তিনি।
গবেষণার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মিনি-ব্রেইনগুলোর গঠন আরও জটিল হবে। তবে, দুর্ঘটনাবসত একটি সচেতন মস্তিষ্কের সৃষ্টি এড়াতে কাগান ও তার দলের সদস্য একজন বায়োএথিসিস্ট বা জৈবনীতিবিদের সঙ্গে কাজ করছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
“নতুন প্রযুক্তিকে আমাদের জন্মলগ্নে থাকা কম্পিউটার শিল্প হিসেবে ভাবতে হবে; যখন প্রথম ট্রানজিস্টরগুলো দুর্বল প্রোটাটাইপ ছিল, নির্ভরযোগ্য ছিল না - কিন্তু বছরের পর বছরের গবেষণার ফলে সাড়া বিশ্বে প্রযুক্তিগত বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
ইতোমধ্যেই দাবা খেলায় গ্র্যান্ড মাস্টারদের হারাতে সক্ষম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সিস্টেম বানিয়েছেন গবেষকরা।
কিন্তু ড. কাগানের সহকর্মী অধ্যাপক কার্ল ফ্রিস্টনের মতে, “মিনি-ব্রেইনটি কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজ থেকে শিখেছে; অর্থাৎ এটি (এআইয়ের চেয়ে) আরও বেশি নমনীয় এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম।”