এতোদিন গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোনো সরকারই ‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’ প্রযুক্তি ঠেকানোকে টার্গেট করে আইন পাশ করেনি। লক্ষণ বলছে, সেই সুবিধা আর বেশিদিন আর থাকছে না।
Published : 05 Jul 2023, 04:34 PM
অ্যাপভিত্তিক মেসেজিং ব্যবস্থায় নতুন ঘোষণা দিয়েছে মেটা – তারা নিজেদের সবগুলো অ্যাপ ‘সুপার সিকিওর’ করবে। আর এই সিদ্ধান্ত তাদের ঠেলে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকারের মুখোমুখি, যারা নতুন আইন তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওই আইন পাশ হলে এমন প্রযুক্তি হয়ে যাবে পুরোপুরি অবৈধ।
এই প্রযুক্তি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চলমান ‘শোডাউনে’ আগে কে আগে কোথায় পা ফেলে তার ওপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নজর রাখছে বলে উঠে এসেছে বিবিসির প্রতিবেদনে। কারণ, এতে গোটা বিশ্বের যে কোনও মানুষ যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের অনেক কিছুই যাবে-আসবে।
‘এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন’, ‘ব্যাকডোর’ ও ‘ক্লায়েন্ট-সাইড স্ক্যানিং’ – এইসব শব্দ অনেকের কাছেই হয়ত জটিল, তবে প্রযুক্তি খাতে এরা যথেষ্টই স্পর্শকাতর। আর, সিলিকন ভ্যালি ও বিশ্বের অন্তত ডজনখানেক দেশের সরকারের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনার মূল বিষয় এটি।
হোয়াটসঅ্যাপ, আইমেসেজ, অ্যান্ড্রয়েড মেসেজেস ও সিগনাল – এদের সবাই এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এই প্রযুক্তির মানে হচ্ছে, কোনো মেসেজিং সেবার মাধ্যমে পাঠানো বার্তা পড়া, ছবি বা ভিডিও বা অডিও কলের ডেটা কেবল প্রাপক ও প্রেরকের কাছেই থাকবে। এমনকি অ্যাপের নির্মাতারাও এইসব কনটেন্টে প্রবেশাধিকার পাবে না।
আঘাত আসছে সে নিরাপত্তায়
বিগত ১০ বছরে ‘এন্ড-টু-এন্ড’ এনক্রিপশন সুবিধাওয়ালা অ্যাপের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আর প্রতিদিন কয়েকশ কোটি মানুষ এগুলো ব্যবহার করছেন।
বেশিরভাগ সরকার ও নিরাপত্তা সংস্থা এই প্রযুক্তির উত্থান মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এরইমধ্যে, চার বছর আগে জাকারবার্গ ঘোষণা দেন, মেসেঞ্জার অ্যাপ ও পরবর্তীতে ইনস্টাগ্রামেও এটি সাধারণ ফিচার হিসাবে যুক্ত হবে।
“আমরা বিশ্বের দুইশ কোটি মানুষের জন্য এই সুবিধা চালু করছি যাতে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত কথোপকথনে প্রাইভেসি পান।” – সে সময় বলেন তিনি। এর পর থেকে, জাকারবার্গ ও তার প্রকৌশলীরা এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন।
মেটা থেকে আসা সর্বশেষ তথ্য বলছে, সম্ভবত তারা এ বছরের মধ্যেই এটি করে ফেলবে।
এই যখন বাস্তবতা, তখন এই সুরক্ষা ব্যবস্থা ঠেকানোর দাবি দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর সে দাবি আসছে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছ থেকে।
এর আগে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউ জিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, তুরস্ক, জাপান ও ব্রাজিলের নিয়ন্ত্রকদের পাশাপাশি ইন্টারপোলের মতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এই প্রযুক্তির সমালোচনা করেছে।
তবে, এতোদিন গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোনো সরকারই এইসব জনপ্রিয় অ্যাপে ব্যবহৃত প্রযুক্তি ঠেকানোকে টার্গেট করে আইন পাশ করেনি। লক্ষণ বলছে, সেই দিন আর থাকছে না।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে বেআইনি উপাদানযুক্ত বার্তা স্ক্যান করার ব্যাকডোর তৈরিতে বাধ্য করা যুক্তরাজ্যের অনলাইন সুরক্ষা আইনের অন্যতম শর্ত। আর অদূর ভবিষ্যতে এটি সম্ভবত কার্যকর হতে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের সরকার বলছে, মেটাকে এইসব বার্তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা না গেলে অপরাধী বা জঙ্গি শনাক্তে তথ্যের একটি বড় উৎস তাদের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি রয়েছে অনলাইনে শিশুদের সঙ্গে কে বা কারা গোপনে যোগাযোগ করছে তা নিয়ে শঙ্কা।
এই যুক্তিটিই তুলে ধরেছেন যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান। জাকারবার্গকে সোমবার পাঠানো এক চিঠিতে তিনি লেখেন - “যারা শিশুদের ক্ষতি করতে চায়, তাদের জন্য এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন বিশাল আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে।”
এই দাবির প্রতি সমর্থন মেলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে। অলাভজনক সংস্থা ‘ন্যাশনাল সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু চিলড্রেন (এনএসপিসিসি)’ একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, শিশু সুরক্ষার প্রশ্নে ব্রিটিশ জনগণ চায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যেন মেসেজে প্রবেশের ক্ষমতা থাকে।
যুক্তরাজ্যের প্রায় পৌনে দুই হাজার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর চালানো ওই জরিপের ৭৩ শতাংশই বলেন, বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানির উচিৎ আইনি উপায়ে মেসেজিংয়ে শিশু নিপীড়নবিষয়ক কনটেন্টে স্ক্যানিং ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি এগুলোকে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড পরিবেশে যুক্ত করা।
এনএসপিসিসি বলেছে, এরইমধ্যে বিভিন্ন সেবার বেশিরভাগ শিশু নিপীড়ন সংশ্লিষ্ট কনটেন্ট স্ক্যান করা হয়েছে। ফলে, অনেক অপরাধী সফলভাবে শনাক্ত করা গেছে।
“যেসব কোম্পানি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রাইভেসির অজুহাতে শিশু সুরক্ষার মৌলিক অধিকার খর্ব করতে চায়, তারা যে জনগণ এমনকি নিজেদের ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে, তা এখন পরিষ্কার।” --বলেন সংস্থাটির সহযোগী প্রধান রিচার্ড কলার্ড।
ওই জরিপের জবাবে মেটার মুখপাত্র বলেন, ‘শিশু নিপীরনের মতো অপরাধ প্রতিরোধ, শনাক্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা মেটা তৈরি করেছে।’ এর সহজ উদাহরণ হিসাবে তিনি অচেনা ব্যক্তিদের সঙ্গে শিশুদের যোগাযোগের বেলায় বয়সগত সীমাবদ্ধতার উদাহরণ দেন।
গোল্লায় যাক প্রাইভেসি?
বুধবার এই চলমান বিতর্ক নিয়ে দুই পক্ষের যুক্তি তুলে ধরে উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি সমর্থকদের ৬৮ জনের একটি দল এক খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। তারা এতে বলছেন, ব্রিটেনের প্রস্তাবিত অনলাইন সুরক্ষা আইন কার্যকর হলে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন বলে আর কিছু থাকবে না।
আইনটি ব্যবহারকারীর প্রাইভেসি বজায় রেখে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে বের করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানিকে দায়িত্ব নিতে বলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেটা অসম্ভব।
“আইনটি প্রাইভেসি, এমনকি অনলাইন সুরক্ষাও নষ্ট করবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোকজনের শেয়ার করা কনটেন্ট নিরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে দমনমূলক শাসনের নজিরও স্থাপন করবে এটি।
বিশ্বাসের ফাটলে সুপার গ্লু
হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগনাল বলেছে, তারা এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের সুরক্ষা ব্যবস্থা না বদলে বরং যুক্তরাজ্য থেকে নিজেদের সেবা গুটিয়ে নেবে।
আর এই চলমান বিতর্কের ‘আগুনে ঘি ঢালতে’ মে মাসে ইলন মাস্ক ঘোষণা দেন, তিনিও টুইটার বার্তায় এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ব্যবস্থা চালু করছেন।
মেটা যুক্তি দেখাচ্ছে, এই প্রযুক্তি বদলে ফেলা একইসঙ্গে জটিল ও ব্যয়বহুল। তবে প্রযুক্তি সেক্টরে সরকারি নীতিনির্ধারকরা বলছেন, এটি অতি জরুরী।
বহু বছর ধরে চলা ডেটা স্ক্যান্ডালের প্রেক্ষিতে শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই সুরক্ষাকে তাদের ওপর গ্রাহকের ‘বিশ্বাস পুনরায় অর্জনের চাবি’ হিসেবে দেখছে বলে লিখেছে বিবিসি।
কাকতালীয়ভাবে, এই এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন ব্যবস্থা বিভিন্ন বাধার মুখে পড়া কোম্পানির কনটেন্ট মনিটরিংয়ের কাজ সহজ করে তোলে। আর ব্যবহারকারী কী শেয়ার করছেন, সেটি দেখতে না পেলে সেগুলোর ওপর নজর রাখার প্রশ্নও ওঠে না।