এই দুটি ধাতু উৎপাদন ব্যায়বহুল হওয়ার কারণ, এগুলো কেবল অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা ও তামার মতো ধাতু খনি থেকে উত্তোলনের সময় উপজাত হিসাবে পাওয়া যায়।
Published : 05 Jul 2023, 07:43 PM
মাইক্রোচিপ শিল্পে দুটো অপরিহার্য কাঁচামাল গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে নতুন আদেশ জারি করে তুরুপের তাস খেলে দিয়েছে বেইজিং, এবং তা তৈরি করবে নতুন সংকট– বলছেন এই শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে চীন-মর্কিন প্রযুক্তি যুদ্ধ দিনদিন আরও বাড়বে বলে তাদের অনুমানের কথা উঠে এসেছে সিএনএন-এর একটি প্রতিবেদনে।
“আমাদের মনে হচ্ছে, এআই চিপ রপ্তানিতে সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জবাবে এটি দ্বিতীয় এবং অনেক বড় আঘাত।” বলেছেন মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেফ্রিসের বিশ্লেষরা। তাদের হিসাবে, গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম চিপ নির্মাতা মাইক্রনকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছিলো প্রথম আঘাত।
এখন আমরা গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানব, সেইসঙ্গে চলমান এই অবরোধ চিপ যুদ্ধের জল কোথায় নিয়ে গড়ায় এবং আগামীতে আরও কী কী পদক্ষেপ আসতে পারে, খুঁজবো সেসব প্রশ্নের উত্তরও।
কিভাবে সৃষ্টি হলো এই পরিস্থিতি?
চীনা কোম্পানিগুলো লাইসেন্স ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চিপ ও চিপের যন্ত্রাংশ কেনায় নিষেধাজ্ঞাসহ গত অক্টোবরে বেশ কিছু রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আদেশ আরোপ করে বাইডেন প্রশাসন।
স্মার্টফোন এবং স্বয়ংক্রিয় গাড়ি থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক কম্পিউটার ও সমরাস্ত্রের প্রাণ বলা যায় এই চিপ প্রযুক্তিকে। সেই নিয়ন্ত্রণকে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ রয়েছে মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্তে।
ব্যাপারটা সেখানেই থেমে থাকেনি। ওয়াশিংটনের দেওয়া ওই অবরোধ কার্যকর করতে হলে অন্যান্য চিপ সরবরাহকারীকেও তাদের দলে টানা দরকার ছিল। নেদারল্যান্ডস ও জাপানের রপ্তানিকারকরা এসে পূরণ করে সেই তালিকা।
তবে চীনও পাল্টা আঘাত করতে পিছপা হয়নি। এপ্রিলে চীনের সরকার মাইক্রনের ওপর একটি সাইবার নিরাপত্তা তদন্ত চালানোর পর সে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোকে মাইক্রন থেকে চিপ কেনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তারপর গেল সোমবার দেশটির পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা এল গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রপ্তানিতেও।
গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম কী?
ছুরি দিয়ে মাখনের মতো কাটা যায় এমন একটি রুপালি ধাতু গ্যালিয়াম। সেমিকন্ডাক্টর ও এলইডি তৈরিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
অন্যদিকে জার্মেনিয়াম এক ধরনের শক্ত, ধূসর সাদা ধাতব পদার্থ যা ব্যবহৃত হয় অপটিক্যাল ফাইবার তৈরিতে। এই ফাইবারগুলো দিয়ে আলো এবং ইলেকট্রনিক ডেটা পাঠানো যায়।
মোট ১৭টি দুষ্প্রাপ্য ধাতুর শীর্ষ উৎপাদক চীন। গোটা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের অর্ধেকই উৎপাদন করে দেশটি। এর আগে ২০২১ সালেও একবার চীনের এই ১৭টি ধাতুর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগের কথা এসেছিল গণমাধ্যমে। সোমবারের এই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে ২০২১ সালের উদ্যোগের মিলের কথা সিএনএন বলেছে প্রতিবেদনে।
গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম সেই ১৭টি দুষ্প্রাপ্য ধাতুর মধ্যে পড়ে না। তবে এগুলো খনি থেকে আহরণ কিংবা কারখানায় উৎপাদন করা অনেক ব্যয়সাধ্য।
এই দুটি ধাতু উৎপাদন ব্যায়বহুল হওয়ার কারণ, এগুলো কেবল অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা ও তামার মতো ধাতু খনি থেকে উত্তোলনের সময় উপজাত হিসাবে পাওয়া যায়। ফলে এইসব ধাতু উৎপাদক দেশেই এগুলো কম খরচে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জারিপ বলছে, চীন বিশ্বের বৃহত্তম গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম উৎপাদক দেশ । বিশ্বের মোট উৎপাদিত গ্যালিয়ামের ৯৮ শতাংশ এবং পরিশোধিত জার্মেনিয়ামের ৬৮ শতাংশই উৎপাদিত হয় চীনে।
“খনি থেকে উত্তোলন এবং পরিশোধনের পেছনে থাকা চীনের সুসংহত এবং ক্রমশবৃদ্ধি পাওয়া অতিকায় অর্থনীতি, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রণোদানা থাকায় দেশটি যে দামে পরিশোধিত খনিজ উপাদান রপ্তানি করতে পারে, অন্য কারো জন্য সেটি মোটেও সম্ভব নয়। যার ফলে বিভিন্ন অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে দেশটির চিরস্থায়ী আধিপত্য তৈরি হয়েছে।” - বিষয়টিকে মঙ্গলবার এভাবেই ব্যাখ্যা করলেন ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা।
এই দুটি কাঁচামাল উৎপাদক চীনা কোম্পানিগুলোর শেয়ার মঙ্গলবার ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
চীনের সীমানা পেরিয়ে এই অবরোধের প্রভাব পড়েছে অস্ট্রেলিয়ার বাজারেও। বেইজিং আরও নতুন কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালেও অবরোধ আনতে পারে এমন আশংকা বিনিয়োগকারীদের। চীনের বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম দুষ্প্রাপ্য ধাতু উৎপাদক অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক কোম্পানি লাইনাসেরও শেয়ার মূল্য বেড়েছে দেড় শতাংশ।
এই প্রযুক্তি যুদ্ধে কে কীভাবে খেলছে?
চীনের এই দুটি দুষ্প্রাপ্য কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে তাদের ব্যবহৃত অর্ধেকের বেশি গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়াম তারা চীন থেকে কিনেছে। ফলে, এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণকে “সতর্কবার্তা” বলেছেন ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা।
“চীন এক ঢিলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং নেদারল্যান্ডসকে বুঝিয়ে দিলো যে, চিপ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ আরও কাঁচামালে অবরোধ আরোপ করে সমুচিত জবাব দেওয়ার সক্ষমতা তাদের ঠিকই আছে।”
এই সপ্তাহান্তে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেনের বেইজিং সফরের কথা রয়েছে। চীনা কর্তৃপক্ষ সম্ভবত ইয়েলেনের সঙ্গে চিপ নিয়ে আলোচনায় এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণকে দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করবে, বলেছে সিএনএন।
যে সময়ে এই নিষেধাজ্ঞা এল সেটি বিবেচনায় একে আকষ্মিক মনে হচ্ছে না বলেই মত দিলেন জেফ্রিসের গবেষকরা।
“এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হজম করা এবং ভেবে চিন্তে একটি যথাযথ জবাব দেওয়ার জন্য অন্তত দুই দিন সময় বেঁধে দিল।”
তবে চীনের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য সাক্ষাৎ “মৃত্যু পরোয়ানা” নয় বলছে সিএনএন।
এই শিল্পে চীন অন্যতম হলেও এই দুটো খনিজ পণ্যের বিকল্প সরবরাহকারীও রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ইউরেশিয়া গ্রুপ।
যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকৃত গ্যালিয়ামের ২০ শতাংশ আসে যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি থেকে এবং জার্মেনিয়ামের ৩০ শতাংশ আসে বেলজিয়াম ও জার্মানি থেকে।
আরও অবরোধ আসবে?
নতুন অবরোধের যথেষ্ট সম্ভবনা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন চীন সরকারের একজন সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এই সপ্তাহে ঘোষণা দেওয়া নিষেধাজ্ঞা তো “কেবল শুরু” – সরকার নিয়ন্ত্রিত চায়ানা ডেইলিতে বলেছেন সবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ওয়েই জিয়ানগুয়ো। তিনি সেইসঙ্গে আভাস দিয়েছেন, পাল্টা আঘাত করার জন্য চীনের ভাণ্ডারে আর কোন কোন অস্ত্র রয়েছে।
“যদি ভবিষ্যতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে চীনকে আরও অবরোধ দেওয়া হয়, তবে চীন তার পাল্টা সমুচিত জবাব দেবে।” –এমনটাই বলেন জিয়ানগুয়ো। একই ধারণা বিশ্লেষকদেরও।
দুষ্প্রাপ্য হিসাবে পরিচিত ধাতুগুলো তেমন দুষ্প্রাপ্য না হলেও সেগুলোর পরিশোধন প্রক্রিয়া বেশ জটিল, এবং সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে সেগুলোর চাহিদা অপরিহার্য, যা হতে পারে সম্ভাব্য পরবর্তী নিশানা।
“চীন-মার্কিন সম্পর্কের এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে আশা করা যায় আরও দুষ্প্রাপ্য ধাতু যুক্ত হতে পারে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার তালিকায়” বলেছেন জেফ্রিসের বিশ্লেষকেরা। তবে ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকেরা নিষেধাজ্ঞাকে “উভয়সংকট” বলে সতর্ক করেছেন।
এর পূর্বে দুষ্প্রাপ্য ধাতুতে চীনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় বাজারে পণ্যগুলোর উপস্থিতি কমেছে এবং বেড়েছে দামও। উচ্চ দামের কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ধরতে চীনের বাইরে খনি থেকে উত্তোলন ও পরিশোধনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর পূর্বে ২০১০ সালে বিরোধের কারণে চীনযুক্তরাষ্ট্রকে দুষ্প্রাপ্য ধাতুর কোটা থেকে বাদ দেয়।
যার ফলে দেশটির বাইরে অন্যান্য স্থানে বিভিন্ন কোম্পানি সেসব ধাতু উৎপাদন শুরু করে। মার্কিন উপাত্ত দেখাচ্ছে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী চীনের বাজার শতকরা ৯৭ ভাগ থেকে ২০১৯ নাগাদ ৬০ শতাংশ হ্রাস পায়।
“নিষেধাজ্ঞা আরোপের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের আধিপত্য হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।” –বলেছেন ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষকরা।