ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪৬ কোটি টাকা মুনাফা করা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ছিল দরপতনের শীর্ষ তালিকায়।
Published : 16 Oct 2023, 03:44 PM
পুঁজিবাজারে লেনদেন কিছুটা বাড়লেও এখনও শেয়ার বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। কারণ, অল্প কিছু কোম্পানিকে ঘিরেই চলছে বাজার।
সপ্তাহের দ্বিতীয় কর্মদিবস সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল এমন ২০টি কোম্পানির মধ্যে ৯টি দুর্বল মৌলভিত্তির স্বল্প মূধলনী কোম্পানি।
এর মধ্যে দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে সাতটি লোকসানি কোম্পানি। বাকি তিনটি কোম্পানির একটি গত ছয় বছরে কখনও শেয়ার প্রতি ২৫ পয়সাও মুনাফা করতে পারেনি। একটি কোম্পানি গত ছয় বছরে সর্বোচ্চ শেয়ার প্রতি ৫৯ পয়সা মুনাফা করতে পেরেছে। বাকি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত স্বল্প মূলধনী কোম্পানি।
সব মিলিয়ে এদিন ডিএসইতে দর বেড়েছে ৬৬টি কোম্পানির, ৭৮টি দর হারিয়ে এবং ১৭৫টি আগের দিনের দরে লেনদেন শেষ করেছে।
ডিএসইর সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ২ পয়েন্ট, যদিও এক পর্যায়ে ৯ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল। আগের দিন সূচক কমেছিল ৬ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে হাতবদল হয়েছে ৪৭৬ কোটি ৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকার শেয়ার। গত ৮ কর্মদিবসের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ লেনদেন।
এই লেনদেনের সিংহভাগ হয়েছে তিনটি খাতে।
খাতওয়ারি লেনদেনে যথারীতি শীর্ষে দেখা গেছে সাধারণ বীমা খাতকে। মোট লেনদেনের ২৪.২৬ শতাংশ হয়েছে একটি খাতেই।
কাছাকাছি ২১.২৯ শতাংশ হিস্যা ছিল খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের। এছাড়া ওষুধ ও রসায়ন খাতে লেনদেন হয়েছে ১১ শতাংশের কাছাকাছি।
ব্যাংক, বস্ত্র, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রকৌশলের মতো বড় খাতগুলোতে শেয়ারের ক্রেতা নেই বললেই চলে।
সব মিলিয়ে ৭০টি কোম্পানির একটি শেয়ারও লেনদেন হয়নি। এক লাখের বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে এমন কোম্পানির সংখ্যা কেবল ৯২টি। তবে এসব কোম্পানির আরও বহু লাখ শেয়ার বিক্রির জন্য বসিয়ে রাখা থাকলেও ক্রেতার দেখা মেলেনি।
আগ্রহ বেশি লোকসানি কোম্পানির শেয়ারে
সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন কোম্পানি টানা তিন বছর ধরে লোকসানে। গত মার্চ পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ীও শেয়ারপ্রতি ৩ পয়সার মতো লোকসান দেখিয়েছে কোম্পানিটি।
২০১৪ সালে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি সর্বোচ্চ ২০ পয়সা লভ্যাংশ দিতে পেরেছে, তাও নিয়মিত নয়।
আগের দিন এর শেয়ার দর ছিল ২৯ টাকা, বাড়ার সুযোগ ছিল ২ টাকা ৯০ পয়সা, বেড়েছে এই পরিমাণই।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯.৩৫ শতাংশ দর বেড়েছে দেশবন্ধু পলিমারের শেয়ার। শেয়ারপ্রতি ২৫ পয়সা লভ্যাংশ ঘোষণার পর গত ৩ অক্টোবর থেকে এর পালে হাওয়া লাগে।
আগের বছরের তুলনায় লভ্যাংশ অর্ধেক প্রস্তাব করা হলেও ৯ কর্মদিবসে দর ২২ টাকা ৯০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়ে গেছে ৪০ টাকা ৯০ পয়সা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮.৭৮ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া ফাইন ফুডসও দুর্বল কোম্পানি। ২০১২ সালের পর থেকে ২০১৮ সালে শেয়ার প্রতি ৩০ পয়সাই তাদের সর্বোচ্চ লভ্যাংশ। এমন কোম্পানির শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ১৩৩ টাকা ৭০ পয়সা, যদিও শেয়ারপ্রতি সম্পদ আছে ১০ টাকা ৬৩ পয়সার।
জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ার প্রতি ২ টাকা ৪৯ পয়সা লোকসান দেওয়া উৎপাদনে না থাকা কোম্পানি মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজের দর ৮.১১ শতাংশ, গত মার্চে তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ৭০ পয়সা লোকসান দেওয়া ওয়াইম্যাক্স ইলেকট্রোডের দর ৬.৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত শেয়ারপতি ৬ টাকা ৪৪ পয়সা লোকসানের তথ্য জানানোর পর আর হিসাব প্রকাশ না করা লিবরা ইনফিউশনের দর বেড়েছে ৬.২৪ শতাংশ। ১০ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির শেয়ারদর স্থির হয়েছে ১ হাজার ১৯১ টাকা ৪০ পয়সা।
২০১০ সালের পর থেকে লভ্যাংশ না দেওয়া উৎপাদনে না থাকা কোম্পানি ইমাম বাটনের শেয়ারদর ৬.০৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৬ টাকা ৭০ পয়সায়। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য আছে ৫ টাকা ৮১ পয়সার।
২০২১-২২ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৪৩ টাকা ২৪ পয়সা এবং গত মার্চ পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ১৯ টাকার বেশি লোকসান দেওয়া রেনউইক যগেশ্বরের দর ৫.৯৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০১ টাকা ৮০ পয়সায়। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য লোকসানের কারণে ঋণাত্মক ৬৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালের জন্য শেয়ারপ্রতি ১০ পয়সা লভ্যাংশ দেওয়ার পর লোকসানে ডুবে যাওয়া সেন্ট্রাল ফার্মা ছিল দর বৃদ্ধির দশম স্থানে। কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৫.৮৩ শতাংশ।
শীর্ষ দশের মধ্যে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া ‘এ’ ক্যাটাগরির একমাত্র কোম্পানি হলো ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট।
দর বৃদ্ধির একাদশ থেকে বিংশ স্থানে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্তত ৬টি রুগ্ন কোম্পানি।
কেন এমন হয়?
রুগ্ন ও লোকসানি কোম্পানির শেয়ারে এত আগ্রহ কেন- এই প্রশ্নে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণা প্রধান দেবব্রত পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির উদ্যোগে কিছু কোম্পানি পুগর্গঠন হয়েছে, কিছু কোম্পানির মালিকানা পাল্টেছে, কিছু কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে তালিকাচ্যুত করার আলোচনা আছে। এসব কারণে স্বল্প মূলধনী কিছু কোম্পানির শেয়ার এসব ঘটনা ঘটছে।”
তিনি বলেন, “দেখবেন, এই ধরনের কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন কম। বাজারে ফ্রি ফ্লোট শেয়ারের সংখ্যা আরও কম। ফলে কয়েকজন মিলেই দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
“আর আমাদের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কোম্পানি নিয়ে স্টাডি করার প্রবণতা নেই। তারা কেবল খোঁজে কোথায় ‘গ্যাম্বলার’ ঢুকেছে। গুজবে, গুঞ্জনে দাম বাড়ে।”
ইতিহাসের সর্বোচ্চ মুনাফা করে পতনের তালিকায়
শেয়ারপ্রতি ১৬ টাকারও বেশি হিসাবে গত অর্থবছরে ২৪৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা কর পরবর্তী মুনাফার তথ্য জানিয়ে শেয়ার প্রতি আড়াই টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ছিল দর পতনের শীর্ষ তালিকায়। কোম্পানিটি দর হারিয়েছে ৩.৬৬ শতাংশ।
দর পতনের শীর্ষ দশে দেখা গেছে সাধারণ বীমা খাতের প্রাধান্য। ১০টি কোম্পানির ৬টিই এই খাতের।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭ শতাংশ দর হারিয়েছে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স। ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স ৫.৩৪ শতাংশ, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স ৪.২৮ শতাংশ, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স ৩.৬৯ শতাংশ এবং ইউনাইটেড ও নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স ৩ শতাংশের কাছাকাছি দর হারিয়েছে।
নাভানা ফার্মা, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ ও জিকিউ বলপেনও ছিল দরপতনের শীর্ষ তালিকায়, সেগুলোর দর তিন শতাংশের চেয়ে বেশি কমেছে।