গত ৪ জুন সাত মাসের মধ্যে সূচকের সর্বোচ্চ অবস্থান দেখা দেয়। দুই দিন পর থেকেই বাজারের ‘পথ হারানো’ শুরু।
Published : 15 Jun 2023, 03:22 PM
টানা চার দিন দরপতনের পর অবশেষে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সূচক বাড়ল পুঁজিবাজারে। তবে দুই মাস পর লেনদেন নেমে গেল পাঁচশ কোটি টাকার নিচে।
বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাইছেন। তবে কম দামেও ক্রেতার দেখা মিলছে না।
ঈদুল ফিতরের আগে থেকে একটু একটু করে গতি ফিরতে থাকা পুঁজিবাজারের এই ‘উল্টো যাত্রা’ বিনিয়োগকারীদের আবার হতাশ করছে।
আগের চার দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৭৮ পয়েন্ট। আগের দুই মাস ধরে একটু একটু করে গতি ফেরা বাজারে তৈরি হওয়া স্বপ্ন এই চার দিনের পতনেই ‘ফিকে’ হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে সূচক আরও ১০ পয়েন্ট পড়ে গেলে হতাশা আরও বাড়তে থাকে। তবে এরপর থেকেই সূচক বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে ৫ পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয় লেনদেন।
৮৯টি কোম্পানির শেয়ারের দরবৃদ্ধির এই দিনে কমেছে ৬২টির দর। ১৮৮টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে আগে দিনের দরে। এর সিংহভাই হাতবদল হয়েছে ফ্লোর প্রাইসে। তবে সংখ্যায় খুবই কম।
সারাদিনে হাতবদল হয়েছে ৪৬৫ কোটি ৭ লাখ ২৬ হাজার টাকার শেয়ার। এর আগে সবশেষ পাঁচশ কোটি টাকার নিচে লেনদেন হয়েছে গত ১৭ এপ্রিল। ৩৮ কর্মদিবস আগের সেই দিনে হাতবদল হয় ৪৪৩ কোটি ৫৮ লাখ ১৮ হাজার টাকার শেয়ার।
সেদিনের পর থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন একটু করে বাড়তে থাকে। বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হতে শুরু করায় বাড়তে থাকে লেনদেন, বাড়ে সূচকও। গত সপ্তাহেই চলতি বছরের সর্বোচ্চ সূচক ও লেনদেন দেখা যায়।
গত ৪ জুন সূচক দাঁড়ায় সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থান, ৬ হাজার ৩৬৬ পয়েন্টে। তার পরের দিন লেনদেন দাঁড়ায় ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকারও বেশি। এটিও গত নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ।
৬ জুন থেকেই মূলত বাজারের ‘পথ হারানো’ শুরু। বেশিরভাগ কোম্পানিই ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার পরও ৪০ পয়েন্ট সূচকের পতনে তৈরি হয় বিস্ময়।
পরে জানা যায়, মূলধনী আয়ে কর বসার গুজবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বিনিয়োগকারীরা। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি কাটায় পরের দুই দিন বাজারে উত্থান হয়। কিন্তু চলতি সপ্তাহের লেনদেন বিনিয়োগকারীদেরকে আবার হতাশার বৃত্তে ফেলে দিল।
কারণ কী?
গতি ফিরতে থাকা পুঁজিবাজারের উল্টোপথে যাত্রা নিয়ে জানতে চাইলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর সংগঠন স্টক ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন-ডিবিএর সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমকে দুটি কারণের কথা তুলে ধরেছেন। একটি হল মুদ্রানীতি, অপরটি অর্থবছর শেষের মাস জুনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর বিক্রয়চাপ।
তিনি বলেন, “পত্রপত্রিকায় দেখলাম মূদ্রানীতি নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এগুলো অনেক হিসাব করে। এবার মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা। ব্যাংকের সুদহারের ৬ ও ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, রিজার্ভের নতুন ক্যালকুলেশন এবং ডলারের দাম বাজারের চাহিদার কাছে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে কথা চলছে। অনেকে হয়ত চিন্তা করছে কী হয় দেখি।
“আবার জুন মাসে কিছু সেল প্রেসারও থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে লভ্যাংশ তুলে নেয়। সেটা সাধারণত মাসের শেষ সপ্তাহে হয়। তবে এবার মানি ফ্লো বেশি থাকায় ইনস্টিটিউশন হয়ত ক্যাপিটাল গেইন নিয়ে নিয়েছে আগে। আমার ধারণা, সব শেষ করে বাজার খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।”
বীমার পতন থামল
সূচক বৃদ্ধির এই দিনটিতে সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে ভালো করেছে বীমা খাত। এই খাতের দুই ধরনের কোম্পানির মধ্যে আবার জীবন বীমার দিন গেছে তুলনামূলক ভালো।
জীবন বীমার ১৫টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৯টির। তিনটির দর কমেছে, আরও তিনটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
তবে দর বৃদ্ধির শীর্ষ বা পতন, কোথাও এই খাতের কোম্পানির প্রাধান্য দেখা যায়নি। সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির শেষ অবস্থানে ছিল মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, যার দর ৩ শতাংশের কিছু বেশি বেড়েছে।
আরও দুটি কোম্পানির দর ২ শতাংশের বেশি, তিনটির দর এক শতাংশের বেশি এবং বাকি তিনটির দর বেড়েছে এক শতাংশেরও কম।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ১.৮২ শতাংশ দর হারিয়েছে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। বাকি দুটি দর হারিয়েছে এক শতাংশেরও কম।
খাতওয়ারী হিসাবে জীবন বীমা লেনদেনের শীর্ষে, তবে তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মত তা একশ কোটি টাকার নিচে নেমে গেল।
মোট লেনদেনের ১৯ শতাংশ হয়েছে এই খাতটিতে, হাতবদল হয়েছে ৮০ কোটি টাকার শেয়ার।
সাধারণ বীমার ৪২টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৮টির, ১১টি কোম্পানি আগের দিনের দরে এবং ১৩টি দর হারিয়ে শেষ করেছে লেনদেন।
সব মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে ১৮ কোটি টাকার কিছু বেশি, যা মোট লেনদেনের ৪.৩৪ শতাংশ।
মন্দা ফেরার আভাসে ফের লোকসানির উত্থান
পুঁজিবাজারে আবার মন্দাভাবের মধ্যে লোকসানি ও দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দর বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। গোটা সপ্তাহেই দেখা গেছে এই প্রবণতা।
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির ছয়টিই লোকসানি। এর মধ্যে টানা কয়েক বছর লভ্যাংশ দেয় না এমন কোম্পানি যেমন আছে, তেমনি লভ্যাংশ ঘোষণা করে বিতরণ না করায় সাজাপাওয়া কোম্পানি ওয়াইমেক্সও আছে।
পুঁজিবাজারে যখনই শেয়ারের ক্রেতা কমে যায়, তখনই লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের এই রমরমা চিত্র এর আগেও দেখা গেছে
দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকার থাকা দুটি কোম্পানি সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে লেনদেন শেষ করেছে। এর মধ্যে ৯.৯২ শতাংশ দর বেড়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া এপেক্স ট্যানারি গত মার্চ পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে ১০ টাকার শেয়ারপ্রতি ৫ টাকা ৪০ পয়সা লোকসান দিয়েছে।
৯.৭৩ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া খুলনা পেপার মিলসের মালিকপক্ষ ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দেশ ছেড়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছরই কোম্পানিটি লভ্যাংশ দেয়নি।
৭.১৪ শতাংশ দর বেড়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা খান ব্রাদার্স পিপিওভেন টানা তিন বছর লোকসান দিয়েছে। চলতি অর্থবছরেও তারা মুনাফার মুখ দেখেনি।
লোকসানি কোম্পানি ওয়াইমেক্স ইলেকট্রোড, সমতা লেদার ও জুট স্পিনার্সও ছিল দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায়।
বস্ত্র খাতের সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এপেক্স স্পিনিং, আমরা নেটওয়ার্ক ও মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি হলো অপর চারটি কোম্পানি।
পতনের শীর্ষে যারা
গত দুই সপ্তাহে অনেকটাই উত্থান হয়েছে, এমন কোম্পানিগুলো ছিল এই তালিকায়।
বঙ্গজ, মুন্নু অ্যাগ্রো, সিএপিএম আইবিবিএল মিউচ্যুয়াল ফান্ড, স্টাইলক্রাফট, ইসলামিক কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, পেপার প্রসেসিং, জিকিউ বলপেন, নাভারা ফার্মা ও ইয়ানিক পলিমার ছিল এই তালিকায়।
এগুলোর দর ৬.৫৯ শতাংশ থেকে ৩.৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।