‘সুখবরের ইঙ্গিতে’ পুঁজিবাজারে লেনদেনে লাফ, বিশ্লেষকের সতর্কতা

বন্ডে বিনিয়োগ ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিটের বাইরে থাকছে, এই গুঞ্জনে শেয়ার কেনার ঝোঁক বেড়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2023, 09:59 AM
Updated : 30 March 2023, 09:59 AM

‘সুখবরের’ অপেক্ষায় থাকা পুঁজিবাজারে মার্চের শেষ কর্মদিবসে লাফ দেখা গেল লেনদেনে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে বন্ডের বিনিয়োগ ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখার কোনো ঘোষণা না এলেও এ বিষয়ে একটি গুঞ্জন ছড়িয়েছে বাজারে। সেই গুঞ্জনের ঢেউয়েই এ উত্থান বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইতে আগের দিন লেনদেন ছিল ৩৮২ কোটি টাকার বেশি, সেটি হঠাৎ লাফ দিয়ে বৃহস্পতিবার হয়েছে ৬৬৬ কোটি ৮৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ১০ পয়েন্ট।

তবে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে বাজারে যে সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, তা পাল্টানোর ইঙ্গিত মেলেনি।

শক্তিশালী মৌলভিত্তির বড় মূলধনী কোম্পানির শেয়ারে ক্রেতা নেই, অন্যদিকে স্বল্প মূলধনী, লোকসানি বা নামমাত্র মুনাফায় থাকা কোম্পানির প্রাধান্য দেখা গেছে আরও একটি দিন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পুঁজিবাজারে যে দরপতন দেখা দেয়, তা থেকে বের হওয়া যায়নি ১৩ মাসেও। তবে ফেব্রুয়ারির শেষে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেছিলেন, এ মাস থেকে সুখবর আসবে। 

২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে ব্রোকারেজ হাউজ ট্রাস্ট রিজিওনাল ইকুইটি লিমিটেডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “মার্চ থেকে মে জুনের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ডিভিডেন্ড চলে আসবে। ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের হাজার হাজার কোটি টাকার সক্ষমতা বেড়ে যাবে। ঠিক কত হাজার কোটি টাকা বাড়বে এর সংখ্যাটা না বলতে পারলেও এটা অনেক বড় হবে। মার্চে অনেক সুখবর আসা শুরু হবে।”

এরপর ৫ থেকে ৯ মার্চ বাজারে তারল্য বাড়ে, বাড়ে শেয়ারদর। আর শেয়ারদর বাড়তে থাকলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রবণতাও দেখা দেয়। এই সপ্তাহের চার কর্মদিবসে গড় লেনদেন আগের সপ্তাহের তুলনায় অনেকটা বেড়ে ছাড়ায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা। সূচক বাড়ে ৪৬ পয়েন্ট।

কিন্তু এই ‘শুভ ইঙ্গিত’ পরের সপ্তাহেই মিইয়ে যায়। ওই সপ্তাহে গড় লেনদেন নেমে আসে ৫০৮ কোটি টাকায় আর সূচক কমে ৩৯ পয়েন্ট। পরের সপ্তাহে তা নামে তিনশ কোটি টাকার ঘরে।

চলতি সপ্তাহে লেনদেন আরও কমে দুইশ কোটির ঘরে নেমে আসে। তবে বুধবার এক দিনে একশ কোটি টাকার বেশি বাড়ে। পরের দিন সেখান থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি বা প্রায় দুইশ কোটি টাকা বাড়ল।

হঠাৎ লেনদেনে গতি আসার বিষয়ে প্রশ্ন করলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণা প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে যে প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে, তাতে বন্ডে বিনিয়োগ ব্যাংকের এক্সপোজার থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে অনেক ফান্ড রিলিজ হবে। এটা মার্কেটের জন্য পজিটিভ হবে। এটার জন্যই লেনদেন বেড়েছে।

“যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এতদিন ইনঅ্যাকটিভ ছিল, এখন তারা ফিরতে পারবে। এতে একটা কনফিডেন্স বিল্ডআপ হল, তারা ভাবছে বায়ার রেডি হচ্ছে। সেই বায়াররা কিনুক আর না কিনুক, এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে।”

ডিএসই স্টক ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন বা ডিবিএ সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও মনে করেন, এ বিষয়টিই লেনদেন বৃদ্ধির কারণ।

তবে তিন সতর্ক করে বলেছেন, “সংশোধনী এখনও চূড়ান্ত হয়নি। পত্রিকায় দেখলাম, এখনও আনুষ্ঠানিক কিছু জানি না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরে যাবে সংসদীয় কমিটি। তারপর উঠবে সংসদে। সেখানে পাস হলে তারপর সেটি চূড়ান্ত হবে। কিন্তু সেটি তো বাদও পড়ে যেতে পারে।”

বন্ডে বিনিয়োগ নিয়ে যদি সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত হয়, তাহলে সেটি পুঁজিবাজারের জন্য ভালো হবে- এটা বিশ্বাস করেন রিচার্ডও । তিনি বলেন, “তখন অকগুলো ব্যাংক লিমিট পাবে নতুন করে। ফ্রি থাকলে কোনো না কোনো সময় ইনভেস্টমেন্টে আসবে।”

পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটিও বিনিয়োগকারীদের আশাবাদী করেছে বলেও মনে করেন ডিবিএ প্রধান। যদিও তিনি এই তহবিল থেকে ঋণ নেয়ার বিষয়ে আরও ভাবতে চান।

রিচার্ড বলেন, “এই ফান্ড থেকে যদি টাকা দেওয়া হয় সেটা ভালো। তবে এটি মানুষের ডিভিডেন্ডের (অবণ্টিত মুনাফার) টাকা। কোনোভাবে যেন মিসইউজ না হয়, সেটি নিশ্চিত করতেই হবে।

প্রকৃতি পাল্টায়নি

এখনও বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা নেই।

বৃহস্পতিবার ১০ পয়েন্ট সূচক বাড়ার দিনও ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হয়েছে ১৯৫টি কোম্পানির। আরও ৭১টি কোম্পানির একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি। যে ৩২২টি কোম্পানির লেনদেন হয়েছে তার মধ্যে প্রায় দুইশ কোম্পানির লেনদেন হয়েছে নামমাত্র।

যে লেনদেন হয়েছে, তার ৩৬ শতাংশই হয়েছে কেবল ১১টি কোম্পানিতে। ২০টি কোম্পানির লেনদেন সামগ্রিক লেনদেনের অর্ধেকের বেশি।

দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশে ছিল জেমিনি সি ফুড, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, মনস্পুল পেপার, নাভানা সিএনজি, ইউনিক হোটেল, বিডিথাই অ্যালুমিনিয়াম, মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, ইসলামিক কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, সোনালী আঁশ ও মুন্নু অ্যাগ্রো।

এসব কোম্পানির মধ্যে ইসলামিক কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স নুতন তালিকাভুক্ত। ইউনিক হোটেল ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশের ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। কোনো কোনোটি আছে লোকসানে।

এর মধ্যে একটি করে কোম্পানির দর ৮, ৭, ৬ ও ৫ শতাংশের বেশি, চারটির দর ৪ শতাংশের বেশি, দুটির দর বেড়েছে ৩ শতাংশের বেশি।

শীর্ষ ১০ ছাড়াও আরও ৯টি কোম্পানির দর তিন শতাংশের বেশি, ১০টির দর দুই শতাংশের বেশি, ২১টির দর বেড়েছে এক শতাংশের বেশি।

অন্যদিকে দরপতনের শীর্ষ তালিকায় ছিল প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্স, হাক্কানি পাল্প ইন্ডাস্ট্রিজ, জিকিউ বলপেন, ইমাম বাটন, শ্যামপুর সুগার, বঙ্গজ, বিডি ওয়েল্ডিং, সমনা লেদার, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস ও সোনালী পেপার।

এর মধ্যে একটির দর ৫ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৪ শতাংশের বেশি, চারটির দর ৩ শতাংশের বেশি, এবং তিনটির দর কমেছে ২ শতাংশের বেশি।

আরও পাঁচটির দর ২ শতাংশের বেশি, ১০টির দর কমেছে এক শতাংশের বেশি।