স্বল্প মূলধনী ও দুর্বল কোম্পানির টানা কয়েক মাসের দাপট কমে এখন তিন বছর আগের ঘটনাপ্রবাহের পুনর্মঞ্চায়ন দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাজারে।
২০২০ সালের মত বিনিয়োগকারীদের বীমা খাতে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল গত সপ্তাহ। চলতি সপ্তাহে তা আরও বেড়েছে।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যত টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, তার এক তৃতীয়াংশের বেশি হয়েছে বীমা খাতে।
এর মধ্যে সাধারণ বীমায় লেনদেন হয়েছে ১৮ শতাংশের কাছাকাছি, ১৫ শতাংশের বেশি হয়েছে জীবন বীমা খাতে।
লেনদেনের পাশাপাশি বাড়ছে শেয়ারদরও। আগের তিন দিনের মত দাম বৃদ্ধির শীর্ষে দেখা গেছে এই খাতের প্রাধান্য।
অবশ্য লেনদেনের একেবারে শেষ বেলায় বিক্রয় চাপে বেড়ে যাওয়া দর কিছুটা কমতে দেখা যায়। কয়েকটি কোম্পানিকে দর হারাতেও দেখা যায়।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর সময় সাধারণ ছুটি শেষে মে মাসের শেষে পুঁজিবাজার চালু হলে এভাবে বীমা খাতের একাধিপত্য দেখা গিয়েছিল। সে সময়ও লেনদেনের ৩০ শতাংশের আশেপাশে হত একটি খাতেই। কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারদর ছয় মাস বা এক বছরের ব্যবধানে পাঁচ থেকে সাত, এমনকি ১০ গুণের বেশি বেড়ে গিয়েছিল।
অস্বাভাবিক এই উত্থানের পর ব্যাপক দরপতনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিনিয়োগকারীরা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে টানা দরপতনে কোনো কোম্পানির ৫০ শতাংশ, কোনোটির ৬০ বা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমে যায়।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ফের ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হলে দরদতন ঠেকে। তবে বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দরে শেয়ারের ক্রেতাই ছিল না।
গত ১১ মে থেকে এই খাতটির আড়মোড়া ভাঙতে দেখা যায়। পরের দিন সাধারণ ও জীবন বীমা লেনদেনের শীর্ষে উঠে আসে। এর পরের তিন কর্মদিবসে দেখা যাচ্ছে একই চিত্র।
বুধবার কেবল সাধারণ বীমা খাত ছাড়িয়ে যায় অন্য সব খাতকে। জীবন বীমা থাকে দ্বিতীয় অবস্থানে। একই চিত্র সপ্তাহের শেষ দিনও।
দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৯৩২ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের তৃতীয় সর্বোচ্চ।
এর আগে গত ২৭ এপ্রিল ৯৬৭ কোটি ৬৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা এবং ১৮ জানুয়ারি ৯৩৪ কোটি ২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছিল।
দিনের লেনদেনের মধ্যে সাধারণ বীমা খাতের ৪০টি কোম্পানিতে হাতবদল হয় ১৫৩ কোটি টাকার বেশি, যা মোট লেনদেনের ১৭ শতাংশের বেশি। বাকি তিনটি কোম্পানির লেনদেন বন্ধ ছিল লভ্যাংশ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেটের কারণে।
এসব কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ৩০টি কোম্পানির, আগের দিনের দরে চারটি এবং বাকি ছয়টি কোম্পানির শেয়ারদর সামান্য কমেছে।
আর জীবন বীমা খাতের ১৪টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ১৩২ কোটি টাকা বেশি, যা মোট লেনদেনের ১৫ শতাংশের মত।
এই খাতে দর বেড়েছে ১১টি কোম্পানির, একটি আগের দিনের দরে এবং দুটি লেনদেন হয়েছে দর হারিয়ে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক এবং বিবিধ খাতে ৭৪ কোটির টাকার বেশি, বস্ত্র খাতে ৬৮ এবং তথ্য প্রযুক্তি খাতে ৬৪ কোটি টাকার কিছু বেশি লেনদেন হয়েছে।
সব মিলিয়ে ১১৫টি কোম্পানির দর বৃদ্ধি ৫৭টির পতন এবং ১৮১টি কোম্পানির শেয়ার আগের দিনের দরে হাতবদল হওয়ার দিন ডিএসইর সাধারণ সূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৮ পয়েন্ট।
দিন শেষে সূচকের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৯০ পয়েন্ট। এটি চলতি বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থান। গত ২৬ জানুয়ারি ৬ হাজার ২৯৬ পয়েন্ট ছিল বছরের সর্বোচ্চ অবস্থান।
দর বৃদ্ধির শীর্ষেও বীমার প্রাধান্য
সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টির মধ্যে বীমা খাতের কোম্পানি ছিল ছয়টি।
এদিন যে ৩১টি কোম্পানির শেয়ারদর ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে, তার মধ্যে ১৪টিই বীমা খাতের।
এর মধ্যে ১০ শতাংশ দর বেড়েছে তিনটি কোম্পানির, যার একটি জীবন বীমা খাতের একটি জীবন বীমা খাতের। তৃতীয় কোম্পানিটি কাগজ খাতের।
৯ শতাংশের বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া আরও পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে তিনটি বীমা খাতের।
আরও দুটি কোম্পানির দর বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি।
দর বৃদ্ধির শীর্ষে ১০ কোম্পানি হল নতুন তালিকাভুক্ত ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ জেনারেল জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, খুলনা পেপার মিলস, নাভানা সিএনজি, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, সিনোবাংলা ইন্ডাস্ট্রিজ, নিটল ইন্স্যুরেন্স এবং মেঘনা সিমেন্ট।
শীর্ষ দশ ছাড়ও আরও একটি কোম্পানির দর ৮ শতাংশের বেশি, দুটি করে কোম্পানির দর ৭ ও ৬ শতাংশের বেশি, পাঁচটি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, ১২টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ১৬টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ১৭টির দর ২ শতাংশের বেশি, ২১টির দর বেড়েছে এক শতাংশের বেশি।
পতনের শীর্ষে জেমিনি
পাঁচ সপ্তাহেই ৪৫৬ টাকা থেকে ৯৬০ টাকায় উঠে যাওয়া জেমিনি সি ফুড নিয়ে এক সপ্তাহ আগে তদন্তের নির্দেশ আসার পর এর শেয়ারদর কমছেই।
চলতি সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে চার দিন শেয়ারদর কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৭৩২ টাকা ৯০ পয়সা।
আরও ৬.৭৪ শতাংশ দর হারিয়ে দরপতনের শীর্ষে থাকা কোম্পানিটি এক সপ্তাহেই দর হারাল ২৩০ টাকার মত।
ব্যাংক খাতের প্রায় সব কোম্পানি যখন ফ্লোরে, সে সময় এক মাসের মধ্যে ৬০ শতাংশ দর বেড়ে যাওয়া মিডল্যান্ড ছিল এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে। আরও ৬.৬২ শতাংশ হারিয়ে দর নেমেছে ১৪ টাকা ১০ পয়সায়।
গত অর্থবছরে লোকসান দেওয়ার পরও চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি ৭ টাকার মতো মুনাফার তথ্যে ১৭৯ টাকা থেকে সাড়ে তিনশ টাকার কাছাকাছি উঠে যাওয়া হাইডেলবার্গ সিমেন্টও এখন উল্টোপথে হাঁটছে। ৫.৭১ শতাংশ হারিয়ে দর নেমেছে ২৬৮ টাকা ৭০ পয়সায়।
অগ্নি সিস্টেমস, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, এপেক্স ফুডস, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলস, আইটিসি, ইনটেক অনলাইন ও জাহিন স্পিনিংও ছিল পতনের শীর্ষ তালিকায়।
এসব কোম্পানির দর ২.৭৭ শতাংশ থেকে ৫.২০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
আরও ৯টি কোম্পানির দর ২ শতাংশের বেশি, ১৩টির দর বেড়েছে এক শতাংশের বেশি।
এপ্রিলের দ্বিতীয় প্রান্তিক থেকে অবিশ্বাস্য উত্থানে ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ টাকা হয়ে যাওয়া এমারেল্ড অয়েলও ছিল দর হারানোর তালিকায়। দর কমেছে ২ শতাংশের কিছু বেশি।