“গবেষণা নেই, ধারণা নেই, কী নিয়ে কথা বলবেন তারা? এটা তো সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু না’’, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
Published : 30 Sep 2024, 08:31 AM
পুঁজিবাজার সংস্কারে আলোচনা করতে তড়িঘড়ি করে একদিনের নোটিস পেয়ে দুর্বল প্রস্তুতিতে সভায় যোগ দিচ্ছেন ডাক পাওয়া নির্বাহীরা। এতে প্রশ্ন উঠেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সংস্কার উদ্যোগের কার্যকারিতা ও সদিচ্ছা নিয়ে।
সভায় অংশ নিতে রোববার ছয় সংস্থাকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি। এক দিনের নোটিসে সোমবারের সভায় যোগ দিচ্ছেন ছয় সংস্থার নির্বাহীরা।
জরুরি নোটিসে ডাক দিয়ে সংস্কারের আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারের মত আর্থিক খাতের সংস্কারের মত বিষয়ে আলোচনার জন্য সভা করা মানেই হচ্ছে অংশগ্রহণকারীদের সময় দিতে হবে প্রস্তুতি নিতে। তারা প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলতে যাবেন। গবেষণা নেই, ধারণা নেই, কী নিয়ে কথা বলবেন তারা? এটা তো সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু না।’’
জরুরিভাবে ডেকে সংস্কারের নিয়ে আলোচনা করলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কারের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তারা আসলেই সংস্কার চান কি না, সে প্রশ্নটি উঠবে। যারা আসবেন, তারা তো প্রস্তুতি ছাড়াই আসবেন, নয়তো তাদের বক্তব্য দুর্বল হবে। এমন উদ্যোগ দেশ ও জনগণের কতটা কাজে লাগবে?’’
২০১০ সালের মহাধসের পর পুঁজিবাজার ১৪ বছরেও দাঁড়াতে পারেনি। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর পর ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলেও ২০২১ সালের শেষে শুরু হয় দীর্ঘ দর সংশোধন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর সেই সংশোধন আর শেষ হয়নি।
উত্থানের এই সময়ে আবার বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদর এমনভাবে বেড়েছে, যা বিস্ময় তৈরি করেছে। এর পেছনে যে কারসাজি আছে তা স্পষ্ট। বন্ধ, লোকসানি, দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদরও ১০ থেকে ২০ গুণ বেড়েছে, উচ্চমূল্যে কেনা শেয়ার এখন অনেকটাই আগের দরে ফিরে আসার কারণে বিনিয়োগকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টানা চার কর্মদিবস সূচক ও লেনদেনের উত্থান বিনিয়োগকারীদেরকে আবার লোকসানে ফেলেছে। বেড়ে যাওয়া দরে শেয়ার কিনে এখন বিপাকে তারা। হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারদরে লাফ দিলেও বেশিরভাগ কোম্পানির দর কমছে টানা।
এর মধ্যে সামনে আসছে কোম্পানির অনিয়মের ফিরিস্তি। কিন্তু একসঙ্গে বেশ কিছু কোম্পানিকে জেড শ্রেণিতে নিয়ে যাওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি আরও বেড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কোম্পানি পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেন বিনিয়োগকারীদেরকে ক্ষতির দিকে ঠেলে দেওয়া হল।
এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে সংস্কারের রোডম্যাপকে সামনে রেখে এই সভা ডাকা হয়েছে যে সভাকে ঘিরে বিনিয়োগকারীদের খুব একটা উৎসাহ আছে, তাও নয়।
সোমবার প্রথম দিনে যে ছয়টি সংস্থাকে আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছে তার মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর পরিচালক পর্ষদ নেই গত দেড় মাসের বেশি ধরে।
গত মে মাস থেকেই ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে চলেছে ডিএসই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ চিফ রেগুলেটরি অফিসার, সিআরও খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিএসইসির অনুসন্ধান চলছে।
এক দিনের নোটিস পেয়ে নিয়ম রক্ষা করতে সভায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছেন ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা। ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিআরও সভায় যোগ দিতে যাচ্ছেন সোমবার।
আলোচনার বিষয় ‘পুঁজিবাজারের সার্বিক সংস্কার’ জানাতে পারলেও প্রস্তুতির বিষয় খোলাসা করেননি ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ জি এম সাত্ত্বিক আহমেদ শাহ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘সংস্কার তো একদিনে সম্ভব না। আলোচনা শুরু হোক, এর পরে হয়ত ধাপে ধাপে সবকিছু হবে। আমরা সভায় যাচ্ছি, ডিএসইর পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা দেয়া হবে।’’
বাজার পরিচালনা করতে জড়িত ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নির্বাহীদের নিয়ে প্রথম দিন সভা করবে বিএসইসি। এর পরের দিন বাজারের মধ্যস্থতাকারী সংগঠনগুলোর পরিচালক পর্ষদ ও নেতাদের সঙ্গে বসার সূচি রয়েছে।
প্রথম দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসই, চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ-সিএসই, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড-সিডিবিএল, সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড-সিসিবিএল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট-বিআইসিএম, বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটস-বিএএসএম ও ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড-সিএমএসএফ এর শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে সভা করবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
কিন্তু বিএসইসির সংস্কারের আলোচনার তালিকায় রাখা হয়নি পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ-আইসিবিকে।
রোববার চিঠি পেয়ে দ্রুত বৈঠক করে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করেছে সিএমএসএফ।
তহবিলটির চিফ অপারেটিং অফিসার মনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা অংশ নেয়ার পরে বিস্তারিত জানতে পারবে কোন ধরনের সংস্কার হবে। এর পরে প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করব।’’
পুঁজিবাজারের জন্য শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিআইসিএম এর শীর্ষ নির্বাহী পদটি শূন্য হয় গত সপ্তাহে। ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রেসিডেন্ট যোগ দেবেন সভায়।
সংস্কার কোথা থেকে শুরু হবে তার ধারণা পেতেই মূলত সভায় যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে সিডিবিএল, সিসিবিএল ও বিএএসএম প্রতিনিধিরা।
গত শনিবার সাপ্তাহিক সরকারি ছুটির দিনে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিএসইসি জানিয়েছে, ‘‘পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও সংস্কারের রোডম্যাপ প্রস্তুতে পুঁজিবাজারের সকল অংশীজনদের সাথে বিএসইসি মতবিনিময় সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘‘মতবিনিময় সভার মাধ্যমে বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সহযোগী সংগঠনসমূহের শীর্ষ প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে পুঁজিবাজারের সার্বিক সংস্কারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে এবং তাদের মতামত নেয়া হবে।’’
দ্বিতীয় দিনে ব্রোকার-ডিলারদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন-ডিবিএ, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিএমবিএ, অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড-এএএমসিএমএফ, অ্যাসোসিয়েশন অব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ-এসিআরএবি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ-বিএপিএলসি, ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল-এফআরসি ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ-আইসিএবি এর নেতাদেরকে ডেকেছে বিএসইসি।
ডিএসইর পর্ষদ ‘অচল’
গত ১৯ অগাস্ট ডিএসইর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু।
এরপর থেকে অন্য স্বতন্ত্র পরিচালকরা পদত্যাগ করেন। চেয়ারম্যানের পদত্যাগের পর থেকে দেড় মাস ধরে পরিচালক পর্ষদ ছাড়া চলছে ডিএসই।
ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী, ডিএসইর পর্ষদে স্বতন্ত্র সাত পরিচালক থাকতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালক থেকেই চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।
আর চার পরিচালক নির্বাচিত হবেন শেয়ারহোল্ডারদের ভোটের মাধ্যমে। কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিনিধি পরিচালক হিসেবে থাকবেন।
বর্তমানে এই পাঁচ পরিচালক থাকলেও কোনো ধরনের সভা বা বিভাগীয় বৈঠক হচ্ছে না।
দুই দফায় বিএসইসি স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিলেও কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। সবশেষ তৃতীয় দফায় নিয়োগ দেওয়াদের যোগদানের অপেক্ষায় আছে ডিএসই।
চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জ, সিএসই চেয়ারম্যান পদও শূন্য দেড় মাস সময় ধরে। বৈঠকে ডাক পাওয়া সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাফিউর রহমান মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি, সভায় আলোচনা করব।’’