টাকার খরায় আকাল পুঁজিবাজারে

পুঁজিবাজারে ক্রমাগত দরপতনের জন্য বাজারে অর্থ প্রবাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

ফারহান ফেরদৌস নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2019, 04:46 PM
Updated : 10 Sept 2019, 04:46 PM

তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক মুদ্রা নীতির আঁচ লেগেছে পুঁজিবাজারে।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুঁজিবাজারের নিজস্ব কোনো সমস্যা নাই এই মুহূর্তে। একমাত্র মুদ্রা বাজারের জন্যই পুঁজিবাজারে ভালো ফলাফল আসছে না।”

“এই পতনের পেছনে দায়ী কারেন্ট একাউন্ট ডেফিসিট,” বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

দুজনের কথা এক করলে দাঁড়ায় বাজারে অর্থ প্রবাহ কম থাকার কথা।

লালী বলেন, “এই মুহূর্তে পুঁজিবাজারে গ্রামীণফোন একটা বড় ফ্যাক্টর, তবে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হচ্ছে মানি মার্কেটে ক্রাইসিস।”

২০১০ সালে বড় ধসের পর ২০১৭ সাল থেকে পুঁজিবাজারে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, সূচক ছাড়িয়ে যায় ৬ হাজার পয়েন্ট। কিন্তু তার পরের বছর আবার কমতে শুরু করে সূচক। গত সোমবার তা ৫ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছে।

অধ্যাপক মিজানুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনি দেখবেন যেদিন থেকে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট শুরু হয়েছে, আমাদের পুঁজিবাজারের দুরবস্থাও কিন্তু প্রায় একই সময় থেকে শুরু হয়েছে।”

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষোভ মাঝেমধ্যে রাজপথেও গড়াচ্ছে (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স ধনাত্মক ছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রথম ঋণাত্মক হয় কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স। সেবার ঋণাত্মক হয় ১৬ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ সালে হয় ৭৯ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ঋণাত্মক ধারাই চলছে।

অধ্যাপক মিজানুর বলেন, “কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট দেখা দিয়েছে, ফলশ্রুতিতে আমাদের ডলার বিক্রি করতে হয়েছে টাকার মূল্যমান ধরে রাখার জন্য।

“আমাদের দেশে এখন ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট নীতি চালু আছে। ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে টাকার মান ধরে রাখতে ডলার বিক্রি করতে হয়। আর ডলার বিক্রি করলে অর্থনীতি থেকে টাকা চলে যায়।”

২০১৭-১৮ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, পরের অর্থবছরে তা কমে ৩২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত রিজার্ভ রিজার্ভ ৩২ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার।

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে চলতি অর্থবছরের পুরো মেয়াদের জন্য সতর্ক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, যে অঙ্ক গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

রশিদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লালী বলেন, “এই মুহূর্তে মানি মার্কেটে টাকা সরবরাহ কিন্তু কমে গেছে। এই যে বাংলাদেশ ব্যাংক সময় সময় ১০-১২ হাজার কোটি টাকার ডলার বিক্রি করে। এ টাকা তো অর্থনীতি থেকে বের হয়ে গেছে।”

ব্যাংকগুলোর উপর মানুষের আস্থা কমে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, “মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে নগদ টাকা হাতে রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কিন্তু অনেক বেশি। ফলে ব্যাংকগুলো কিন্তু ডিপোজিট পাচ্ছে না।”

একটি ব্রোকারেস হাউজে বিনিয়োগকারীরা (ফাইল ছবি)

আর্থিক খাতের এই দুরবস্থা পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণকেও কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন তিনি।

“দেশের অর্থনীতিতে যদি এত পরিমাণ লোক, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে, সেটা আর ফেরত না দেয়, যেটাকে আমরা মন্দ ঋণ বলি, সেটা যদি বেড়ে যায়, সেখানে তারল্য সঙ্কট প্রকট রূপ ধারণ করে।”

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অধ্যাপক মিজানুর বলেন, “ব্যাংকের ব্যবসা যদি স্থবির হয়ে যায়। এর প্রভাব পুঁজিবাজারের উপর পড়বেই। ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমেছে, এর প্রভাব কিন্তু ব্যাংকের শেয়ারগুলোর উপর পড়েছে। যার ফলে ব্যাংকের শেয়ারগুলোর দাম কমে গেছে। যেটা আবার পুঁজিবাজারের সূচক কমাতে ভূমিকা রেখেছে।

“আবার ব্যাংকগুলো যেহেতু ঋণ দিতে পারছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্থবির হয়ে গেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতের মুনাফাতেও প্রভাব পড়েছে।”

বিভিন্ন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও নিয়ে অনিয়মও পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর।

“আইপিওর মাধ্যমে যেসব কোম্পানিকে টাকা তোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এই টাকা নিয়ে নয়-ছয় করেছে। টাকা তসরুফ করেছে।”