দুই দিন কমে, একদিন বাড়ে, পুঁজিবাজারে ‘বানরের বাঁশে চড়ার গল্প’

“এখনকার পরিস্থিতি এমন যে, বাতাস হলেও মার্কেট পড়ে,” বলছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2023, 09:46 AM
Updated : 16 March 2023, 09:46 AM

১৬৯টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস ফিরিয়ে আনা, আর ‘মার্চ থেকে পুঁজিবাজার ভালো হবে’ বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি চেয়ারম্যানের আশাবাদের পর স্বস্তিকর একটি সপ্তাহ পার করে ফের একটি অস্বস্তিকর সপ্তাহ দেখল বিনিয়োগকারীরা।

বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন সূচক বেড়ে শেষ হলেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। এই সপ্তাহের পাঁচটি কর্মদিবসে দুই দিন সূচক সামান্য বাড়লেও বাকি তিন দিন পতন দেখেছে।

আগের সপ্তাহে সূচক বেড়েছিল ৪৬ পয়েন্ট। বেড়েছিল বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারদর। তলানিতে নেমে আসা লেনদেনে দেখা গিয়েছিল ঊর্ধ্বগতি। এভাবে বাড়তে থাকলে বাজার আপন গতিতে ফিরবে, এমন কথাও বলাবলি হচ্ছিল।

ওই সপ্তাহে গড় লেনদেন ছিল প্রায় সাড়ে ছয়শ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহে ছিল সাড়ে তিনশ কোটি টাকার কিছু বেশি।

গড় লেনদেন সাড়ে ছয়শ কোটি থেকে নেমে এসেছে ৫০৮ কোটি টাকায়, ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৩৯.৯৩ পয়েন্ট।

বেশিরভাগ শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে, এই পরিস্থিতিতেও বাজার মূলধন কমেছে ৩ হাজার ৬৯৬ কোটি ৯২ লাখ ৩ হাজার টাকা।

সেই সপ্তাহে মোট চার কর্মদিবস লেনদেন হয়। এর মধ্যে একদিন ছাড়া সূচক বাড়ে তিন দিনেই। এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ সোয়া সাত শ কোটি টাকার লেনদেনও দেখেছে বিনিয়োগকারীরা।

তবে গত রোববার একটি কোম্পানির ২০ শতাংশ দর বৃদ্ধিতে সূচকে ২৬ পয়েন্ট যোগ হলেও সামগ্রিকভাবে ২৫ পয়েন্ট হারিয়ে শুরু হয় সপ্তাহ। পরের দিন পতনের ধাক্কা সামলে সূচক বেড়েছিল আট পয়েন্ট।

এর পরের দুই কর্মদিবস ফের দরপতন দেখেছে বিনিয়োগকারীরা। মঙ্গলবার ১১ পয়েন্টের পর বুধবার পড়ে ১৮ পয়েন্ট। বৃহস্পতিবার শুরুতেই ছয় পয়েন্ট হারালেও শেষ পর্যন্ত ছয় পয়েন্ট বেড়ে শেষ হয় লেনদেন।

এই গোটা সপ্তাহেও ‘ফ্লোর প্রাইস’ ভাঙতে পারেনি দুই শতাধিক কোম্পানি। ‘ফ্লোরের’ চেয়ে বেশি দর, এমন কোম্পানির মধ্যে দর হারিয়েছে সিংহভাগ, বেড়েছে হাতে গোনা কয়েকটি।

এমনকি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের শেয়ার পর প্রথমবারের মতো নগদের পাশাপাশি ৬০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণার পর রোববার ইউনিভিলার কনজিউমার যে চমক দেখিয়েছিল, ধরে রাখতে পারেনি সেটিও।

সেদিন ২০.১৭ শতাংশ বা ৫৭৪ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে দর দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪২৩ টাকা ৭০ পয়সা। কিন্তু সেদিন যারা শেয়ার কিনেছেন, তাদের সবার মাথায় হাত। কারণ পরপর চার কর্মদিবস কমে শেয়ারের দর নেমেছে ২ হাজার ৯৮৭ টাকা ৬০ পয়সায়।

সোমবার কোম্পানিটির শেয়ার দর হারায় ১৭১ টাকা ১০ পয়সা, পরের দিন কমে ৫৪ টাকা ৭০ পয়সা। বুধবার আরও ১০৬ টাকা ৯০ পয়সার পর বৃহস্পতিবার কমল আরও ১০৩ টাকা ৪০ পয়সা। অর্থাৎ চার দিনে কমেছে ৪৩৬ টাকা ১০ পয়সা।

এটি অবশ্য পুঁজিবাজারের সামগ্রিক চিত্রের মতোই বলা যায়। প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার হঠাৎ লাফ দেয়। কদিন বেড়েই আবার দেখা যায় উল্টো দৌড়।

দরপতনের কারণ ‘প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অভাব আর আতঙ্ক’

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা একে দেখছেন বাজারের প্রতি আস্থাহীনতার প্রতীক হিসেবে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণা প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুঁজিবাজারের পরিসিথতি বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠার অংকের মতো। ছোটবেলায় গণিতের এই হিসাব করেছি, এখন দেখছি।”

তিনি বলেন, “বাজারে চাহিদা ও যোগানে একটি ফারাক রয়ে গেছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নেই। ব্যক্তিশ্রেণির ছোট বিনিয়োগকারী দিয়ে আর কয়দিন চলবে?”

তিনি বলেন, “এখনকার পরিস্থিতি এমন যে, বাতাস হলেও মার্কেট পড়ে। আমেরিকায় ব্যাংক ধসে পড়লে এখানে বাজার পড়ে। সারা বিশ্বের কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি থাকলেও এখানে এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু বিশ্বে যখন সেখানে বাড়ে, তখন এখানে আর বাড়ে না।”

আগের সপ্তাহ ‘ভালো’ করার পরও চলতি সপ্তাহে পুঁজিবাজারে এমন আচরণের পেছনে বিনিয়োগকারীদের একটি উৎকণ্ঠা কাজ করেছে বলেও মনে করেন এই বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, “একটা পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে সিকিউরিটিজ ল আপডেট হবে। কারসাজির জরিমানা বাড়বে। কিন্তু এটা তো প্রবলেম না। তো প্যানিকড হওয়ারও কিছু নাই। কেউ কারচুপি করলে সাজা পাবে। যে পরিমাণ টাকা তারা আয় করেছে, সেই পরিমাণ জরিমানা আদায় করা হবে।

“কিন্তু গত এক বছরে মার্কেটের রিটার্ন তো নেগেটিভ। কারচুপি করবে কোত্থেকে? আর অনেক সময় কেউ কেউ অনেক এগ্রেসিভ হয়ে যায়। রেগুলেটরদের কাজই তো সতর্ক করা। তাও না মানলে আইন তো থাকতে হবে। সেটা নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।”

বাজারের সামগ্রিক চিত্র

সপ্তাহের শেষ দিন ডিএসইতে বেড়েছে ৫০টি কোম্পানির দর, কমেছে ৫৬টির আর আগের দিনের দরে হাতবদল হয় ২০৮টি, যেগুলোর প্রায় সবগুলোই বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দর বা ফ্লোর প্রাইসে আছে।

দুই দিন পর লেনদেন নেমে এসেছে পাঁচ শ কোটি টাকার নিচে। দিনভর হাতবদল হয়েছে ৪৮৩ কোটি ৯৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা যা আগের দিন ছিল ৬০৭ কোটি ১৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

এর মধ্যে আবার কেবল শীর্ষ ১০টি কোম্পানিতেই লেনদেন হয়েছে ১৬৭ কোটি ১২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। শীর্ষ ২০ কোম্পানিতে লেনদেন ছিল ২৩৫ কোটি ৬৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।

লেনদেনের তলানিতে থাকা দেড় শ কোম্পানি মিলেও ১০ কোটি টাকা হাতবদল হয়নি।

সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া মুন্নু অ্যাগ্রোর শেয়ারদরে যোগ হয়েছে ৫.২৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সোনালী পেপারের দর বেড়েছে ৪.৯২ শতাংশ।

আরও চারটি কোম্পানির দর ৪ শতাংশের বেশি, একটির দর ৩ শতাংশের বেশি, পাঁচটির দর ২ শতাংশের বেশি, ১৩টির দর এক শতাংশের বেশি বেড়েছে।

বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ৫.৮৫ শতাংশ দর হারানো মেঘনা লাইফ। আরও চারটির কমেছে ৪ শতাংশের বেশি, ছয়টির দর কমেছে ৩ শতাংশের বেশি, ৪টির দর ২ শতাংশের বেশি ১১টির দর এক শতাংশের বেশি কমেছে।