আইটি কোম্পানির তথ্য হালনাগাদকালে সার্ভারে ত্রুটি, ডিএসইএক্সে ‘বিভ্রান্তি’

আমরা নেটওয়ার্কের রোববারের লেনদেন বাতিল, যা সোমবার ফের চালু হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 March 2024, 12:06 PM
Updated : 10 March 2024, 12:06 PM

তালিকাভুক্ত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি কোম্পানির তথ্য হালনাগাদ করতে গিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্ভার ত্রুটিতে পড়ে; যে কারণে দিনভর লেনদেন চলাকালে সূচকের অস্বাভাবিক তথ্যের বিভ্রান্তির মধ্যেই শেয়ার কেনাবেচা করেছেন বিনিয়োগকারীরা।

দিন শেষেও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। যদিও এক ঘোষণায় দেশের প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ দুপুরে দাবি করেছিল সমস্যার সমাধান হয়েছে।

রোববার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসের লেনদেনের শুরুতেই এ কারিগরি ত্রুটির কথা জানায় ডিএসই; চার ঘণ্টা শেষেও যা সমাধান হয়নি।

এতে সূচকের ওঠানামার কোনো তথ্য জানতে পারা ছাড়াই বিনিয়োগকারীদের আন্দাজের ওপর ভিত্তি করে শেয়ার কেনাবেচা করতে হয়েছে।

দিন শেষে দেশের প্রধান এ স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য বলছে, ৬ হাজার ১১২ পয়েন্ট নিয়ে আগের দিন শেষ হওয়া ডিএসইএক্স সূচক রোববার লেনদেন শেষে কমেছে ৫ হাজার ৯৭১ পয়েন্ট বা প্রায় ৯৮ শতাংশ। সূচকের অবস্থান দেখাচ্ছে ১৪১ দশমিক ৫৬ পয়েন্ট। শেয়ারদর ওঠানামায় সার্কিট ব্রেকার (সর্বোচ্চ কতটুকু উঠতে বা কমতে পারে) থাকায় একদিনে এতটা পতন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

কারিগরি সমস্যায় প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের মতো গড়বড় দেখা গেছে অন্য সূচকগুলোতেও। বিনিয়োগকারীদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে না।

তবে অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সূচক ঠিকই ছিল। এটির প্রধান সূচক সিএসসিএক্স কমেছে শূন্য দশমিক ৭৩ শতাংশ।

কারিগরি ত্রুটির কারণ হিসেবে ডিএসই বিকাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। তবে কোম্পানির নাম উল্লেখ না করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘তালিকাভুক্ত একটি আইটি কোম্পানির তথ্য হালনাগাদ করতে গিয়ে প্রধান সূচকে সমস্যা তৈরি হয়। কোম্পানির তথ্য পরিবর্তনের সঙ্গে প্রধান সূচক সমন্বয় করতে গিয়েই তা হয়। বিএসইসির প্রতিনিধি দল ডিএসইতে গিয়েছে। আশা করছি দ্রুত পুরো ঘটনা জানা যাবে। ’’

ডিএসই ও বিএসইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে বলছেন, আমরা নেটওয়ার্ক এর তথ্য হালনাগাদ করতে গিয়েই ঝামেলার শুরু।

আমরা নেটওয়ার্কের লেনদেন বাতিল

মূল সূচকে ত্রুটির মধ্যেই রোববার লেনদেন হওয়া আমরা নেটওয়ার্কের সব লেনদেন বাতিল করার কথা জানিয়েছে ডিএসই। সোমবার আগের দিনের (বৃহস্পতিবার) অবস্থান থেকে আবার শুরু হবে লেনদেন।

সকালে লেনদেন শুরুর পরপরই ডিএসইএক্সের কারিগরি ত্রুটির বিষয়টি ধরা পড়ে। সূচকের গতি-প্রকৃতির কোনো তথ্য দিনভরই দিতে পারেনি দেশের প্রধান এ স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে শুরুতেই ‘কারিগরি’ ত্রুটির বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের জানানো হয়।

আতঙ্কিত না হওয়ার অনুরোধ

লেনদেন শেষে ডিএসই জানিয়েছে, ত্রুটি সেরে সূচক সঠিক তথ্য দেখাতে শুরু করেছে। তবে ওয়েবসাইটের তথ্যের সঙ্গে সেই কথা মিলছে না। কর্মকর্তারাও নাম প্রকাশ না করে বলছেন, কারিগরি সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। সূচকের সর্বশেষ যে তথ্য দেখা যাচ্ছে ওয়েবসাইটে তা সঠিক নয়। ত্রুটি ঠিক হলে ‘বিভ্রান্তি’ কাটবে।

পরে আরেক বিজ্ঞপ্তিতে প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জটি দু:খ প্রকাশ করে বলেছে, "বিনিযোগকারী তথা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অপারেশনাল ত্রুটিজনিত কারণে ডিএসইর সূচকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক পরিসংখ্যান লক্ষ্য করা যায়।

"এ বিষয়ে ডিএসই ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নাসডাক এর সাথে জরুরি বৈঠক করে তা সমাধানের চেষ্টা অব্যহত রেখেছে।"

বিজ্ঞপ্তিতে বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য অনুরোধও করা হয়েছে।

তদন্তে কমিটি

ঘটনার তদন্তে ডিএসইর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) সাত্ত্বিক আহমেদ শাহকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

শুরুতেই সমস্যা

এর আগে দিনের শুরুতে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ডিএসই বলেছে, ‘‘কারিগরি ত্রুটিতে ডিএসইর সূচকে অস্বাভাবিক সংখ্যা দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনাগত পরিচালনায় ত্রুটি হওয়ায় আমরা নেটওয়ার্কের ১০ মার্চের সকল লেনদেন বাতিল করা হল। পরবর্তী লেনদেন দিবসে আমরা নেটওয়ার্কের লেনদেন চালু হবে।’’

সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার সকাল থেকেই ডিএসইর ওয়েবসাইটের প্রধান সূচকে ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দেখা যায়।

সূচকে ‘অস্বাভাবিক’ উল্লেখ করে ডিএসই প্রথম বেলায় বিনিয়োগকারীরে বলেছিল, ‘‘কারিগরি ত্রুটির কারণে সূচকে অস্বাভাবিক সংখ্যা দেখা দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সূচক উপেক্ষা করে লেনদেন চালিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।’’

অন্যদিকে সূচক পতন, কারিগরি ত্রুটি ইত্যাদি বিষয়ে সরেজমিন ধারণা নিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একটি প্রতিনিধি দল ডিএসইতে যায়।

বিএসইসি থেকে যাওয়া দুই সদস্যের প্রতিনিধি দলকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে পরিদর্শন প্রতিবেদন জমা দিতে নিদের্শনা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলে জানান মুখপাত্র রেজাউল।

এদিকে বেলা ২টার দিকে ডিএসই ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘‘কারিগরি ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে। এখন সঠিক সংখ্যা দেখাচ্ছে সব সূচক।’’

বিভ্রান্তিকর তথ্য

এমন ঘোষণার পরও দিন শেষে দেখা যায় সকালে ৬ হাজার ১১২ পয়েন্ট অবস্থান থেকে লেনদেন শুরু করা ডিএসইএক্স সূচকের সবশেষ অবস্থান নেমেছে ১৪১ দশমিক ৫৬ পয়েন্টে। এতে আগের দিনের চেয়ে ৫ হাজার ৯৭১ পয়েন্ট বা প্রায় ৯৮ শতাংশ কমেছে ডিএসইএক্স।

সূচকের এমন তথ্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে জানিয়েছেন ডিএসই ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলছেন, সূচকের হিসাব পদ্ধতি ও শেয়ার দর ওঠানামা সংক্রান্ত সার্কিট ব্রেকারের নিয়ম অনুযায়ী এক দিনে কোনো সূচকেরই ৯৮ শতাংশ পতন হওয়ার সুযোগ নেই।

লেনদেন সময় শেষ হওয়ার পরে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হাসান হাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা বৈঠকে বসেছি। ত্রুটি কেন হলো তা জানতে।’’

এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

এদিকে লেনদেন শেষে শরীয়াহ সূচক ডিএসইএস আগের দিনের চেয়ে হারিয়েছে ১ হাজার ৩০৪ দশমিক ৯৯ পয়েন্ট। রোববার দিন শেষে ডিএসইএস সূচক দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট। আগের দিন যা ছিল ১ হাজার ৩৩৫ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট।

ডিএস৩০ সূচক লেনদেন শেষে হয় ২ হাজার ৮৯ পয়েন্ট। একদিনে কমে ১০ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট। আগের দিন শেষে যা ছিল ২ হাজার ৯৪ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট।

ডিএসইতে সূচকের হিসাবে বিভ্রাটের কারণে বিনিয়োগকারীরা পুরো বাজারের গতি প্রকৃতি লেনদেনের সময় এবং দিনশেষে কেমন ছিল তা জানতে পারছেন না।

এক ব্যক্তি বিনিয়োগকারী আফতাব উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের বেশির ভাগের দাম পড়লে সূচক কমবে, বাড়লে সূচক বাড়বে। সূচক দেখে বুঝতে পারি বাজার ভালো না খারাপ যাচ্ছে। আজকে তো বুঝতে পারলাম না।

“বড় বড় কোম্পানির দর কমলো আর সূচক কমলো না। তাইলে কী বুঝব বলেন? ঝামেলা কে পাকাচ্ছে বুঝতে পারছি না।’’

স্বাভাবিক সিএসই

এদিকে অপর পুঁজিবাজার সিএসইতে স্বাভাবিক লেনদেন চলেছে। দিন শেষে সার্বিক সূচক সিএএসপিআই হয় ১৭ হাজার ৪২১ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট। আগের দিনের চেয়ে কমেছে ১২৯ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট। মোট ২৩৪টির মধ্যে দর বেড়েছে ১৪৯টির, কমেছে ৫৪টির পরিবর্তন হয়নি ৩১টির। মোট লেনদেন ১১ কোটি ৫১ লাখ টাকার।

এ এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেছেন, “রোববার আমাদের লেনদেন শেষ হয়েছে নির্বিঘ্নে।“

লেনদেনে পিএলএফএস

প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক কোম্পানি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএস) লেনদেন এদিন চালু হয়।

আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর কোম্পানিটিকে অবসায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল উচ্চ আদালত। পরে অবসায়ন না হলেও গত ২০১৯ সালের জুলাই থেকে এটির শেয়ার লেনদেন বন্ধ ছিল। এখন অবসায়নের পথে না গিয়ে এটিকে পুনরায় চালুর পদক্ষেপ নিয়ে কাজ চলছে। সেই প্রেক্ষিতে এটির লেনদেন আবার চালু করা হয়েছে।