ফ্লোর তুলে দেওয়ার ‘গুজব’ পুঁজিবাজারে, বিএসইসি বলছে ‘না’

“ফ্লোর প্রাইস উঠে যাবে এরকম গুজব সকালে একটু শুনলাম। এরকম গুজব প্রতিদিনই শোনা যায়”, বললেন, মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2023, 09:30 AM
Updated : 26 Feb 2023, 09:30 AM

টানা দরপতনে থাকা পুঁজিবাজারে সাপ্তাহিক ছুটি শেষে নতুন একটি সপ্তাহ শুরু হল বিনিয়োগকারীদের আরও ক্ষতির মধ্য দিয়ে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে বারবার নাকচ করা হলেও আবার ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে দেওয়ার গুজবে প্রভাবিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। যেসব কোম্পানির দর বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দরের চেয়ে বেশি, সেগুলো ব্যাপক হারে দর হারিয়েছে। যেগুলোর দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা এক শতাংশ, সেগুলো দর হারাচ্ছে ওই হারেই।

যদিও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিশ্চিত করা হয়েছে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।

দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশের তালিকা পূর্ণ হচ্ছে না বেশ কিছুদিন ধরে। এর মধ্যে রোববার দেখা গেল আরও করুণ চিত্র। দর বেড়েছে কেবল তিনটি কোম্পানির, এর মধ্যে দুটির বেড়েছে ০ দশমিক ৫ শতাংশের কম; অন্যদিকে দর হারিয়েছে ১৪৯টি।

সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধি পাওয়া আলহাজ্ব টেক্সটাইলের দর বেড়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।

অন্যদিকে সব মিলিয়ে একটির দর ১০ শতাংশের বেশি; ৯ ও ৮ শতাংশের বেশি একটি করে, ৭ ও ৬ শতাংশের বেশি একটি করে, তিনটির দর ৫ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৪ শতাংশের বেশি, সাতটির দর ৩ শতাংশের বেশি, আটটির দর ২ শতাংশের বেশি, ১১টির দর ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। বাকিগুলোর দর কমেছে এক শতাংশের বেশি।

১৩১টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে আগের দিনের দরে। এদিন একটি শেয়ারও হাতবদল হয়নি– এমন কোম্পানির সংখ্যা ১০৭টি।

এদিন লেনদেন আবার পৌঁছেছে দুইশ কোটির ঘরে। হাতবদল হয়েছে ২৩১ কোটি ৪১ লাখ ৭২ হাজার টাকা, কয়েক মাস আগে বাজার যখন চাঙ্গা ছিল, তখন একটি কোম্পানিতেই এর চেয়ে বেশি লেনদেন হতে দেখা গেছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আরও ২৩ পয়েন্ট কমে নেমেছে ৬ হাজার ১৮২ পয়েন্টে। বেশিরভাগ শেয়ারের দর কমা সম্ভব নয়, এমন পরিস্থিতিতে এটা ‘বড় দরপতন’ হিসেবেই ধরা যায়।

সূচকের এই অবস্থান গত ২ জানুয়ারির পর সর্বনিম্ন; সেদিন তা ছিল ৬ হাজার ১৭৭ পয়েন্ট।

এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতেই পড়েছে ৯৫ পয়েন্ট আর গত ১২ কর্মদিবসে পড়েছে ১১৩ পয়েন্ট।

ফ্লোর প্রাইস নিয়ে ‘ফের গুজব’

টানা এই দরপতনের শুরু মূলত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। এই সময়ে ফ্লোর প্রাইস নিয়ে বারবার কথা হচ্ছে। বাজার ব্যবস্থাপকদের একটি অংশ এটি তুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তবে বিএসইসি বলছে, বাজার স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত তা চালু থাকবে।

কিন্তু ‘ফ্লোর তুলে দেওয়া হচ্ছে’ এমন গুজব বিনিয়োগকারীদের ‘অস্থিরতা বাড়াচ্ছে’ বলে মনে করেন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছায়েদুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ফ্লোর প্রাইস উঠে যাবে এরকম গুজব সকালেও একটু শুনলাম। এরকম গুজব প্রতিদিনই শোনা যায়। তবে অথেনটিক কোনো তথ্য নাই। এখন কী করার?”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, “যখন (ফ্লোর প্রাইস) দেওয়া হয়েছিল, তখনই জানানো হয়, এটা স্বল্পতম সময়ের জন্য। পরে ১৬৮টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে দিয়ে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ১ শতাংশ কর হয়। বাকি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস কবে তোলা হবে, সেটি নিয়ে এখন পর্যন্ত কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি। যতক্ষণ না এ নিয়ে কোনো আলোচনা না হবে, ততক্ষণ তো আমরা কিছু বলতে পারছি না।”

কিন্তু বাজারে তো জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে- এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “পৃথিবীর সব দেশে রিউমার থাকে। আমরা চেষ্টা করছি এই গুজবগুলোকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমরা বারবার আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করছি। এরপরেও মূলত ফেইসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে। এখানেও আমাদের ব্যবস্থা আছে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।”

ফ্লোর তোলা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি- এ বিষয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি কমিশনের পক্ষ থেকে আসবে কি না জানতে চাইলে রেজাউল বলেন, “আমি মুখপাত্র হিসেবে জানাচ্ছি, বারবার বলছি। এখন আলাদা করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কিছু নেই।

“এটি খুবই সংবেদনশীল বিষয়। যখনই কোনো সিদ্ধান্ত হবে, আমরা ১০ মিনিটের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেব।”

‘অস্থিরতাও দায়ী’

ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছায়েদুর রহমান বিনিয়োগকারীদের অস্থিরতাকেও বাজারের দরপতনের জন্য দায়ী করেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা বিনিয়োগকারীদের মাইন্ড সেটআপ। এটা নিয়ে কিছু বলার নেই৷ বিনিয়োগ করলে একটা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিছু সময়ের জন্য দাম কমে যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের সেই ধৈর্য নাই।

“পত্রিকা খুললেই তো অর্থনীতির নেতিবাচক খবর দেখা যায়। সেগুলোরও তো কিছু প্রভাব আছে। বাদ দেওয়ার মত নয়।”

মাথায় হাত যাদের

দরপতন ঠেকাতে গত বছরের ৩১ জুলাই থেকে আরোপ করা ফ্লোর প্রাইসের কারণে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমতে পারছে না। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সর্বনিম্ন দরে শেয়ারের ক্রেতা নেই। গত ১৬ নভেম্বর থেকে দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা এক শতাংশ করে ফ্লোর প্রতাহার করা হয়েছে, এমন বহু কোম্পানির দর প্রতিদিনই কমছে এক শতাংশের কাছাকাছিই।

যেসব কোম্পানির দর ‘ফ্লোরের’ চেয়ে বেশি ছিল, সেগুলোর এখন দর হারাচ্ছে বেশি। আর এই কিছু কোম্পানির ওপরই নির্ভর করছে লেনদেন। দর হারাতে থাকায় কমছে কেনাবেচা, এর প্রভাবে কমছে লেনদেনও।

গত মাসে পাঁচ শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া লেনদেন এখন আবার ঢুকেছে দুই শ কোটির ঘরে। দর বৃদ্ধির শীর্ষ দশের তালিকা পূর্ণ হচ্ছে না। হাতে গোনা এক দুটি বাদে কমছে বাকি সবগুলোর দর। ফ্লোরের বাধা নেই, এমন কোম্পানির দর কমছে আরও বেশি।

যেমন মেট্রো স্পিনিং মিলস লিমিটেডের দর গত ১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৪৩ টাকা ৯০ পয়সা। সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ টাকা ৫০ পয়সায়। রোববার এটি ছিল দরপতনের শীর্ষ ১০ তালিকার দ্বিতীয় স্থানে।

প্রথম স্থানে ছিল পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর উৎপাদনে ফেরা এমারেল্ড অয়েল। বন্ধ থাকার সময় পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৭ থেকে তিন বছরের জন্য আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কোম্পানি। লোকসানের কারণে দেয়া হয়নি লভ্যায়শ। আর এই কোম্পানির দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ১ শতাংশ হলেও আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে সীমা ছিল না। এটি দর হারিয়েছে ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

‘ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৫ টাকা ৫০ পয়সায় লেনদেন হওয়া ওরিয়ন ইনফিউশন নেমে এসেছে ৩০৪ টাকা ৮০ পয়সায়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর ছাড়ায় চার শ টাকা।

জেনেক্স ইনফোসিসের দর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে ছিল ১১০ টাকা। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ৮২ টাকা ৪০ পয়সায়।

একইভাবে আমরা নেটওয়ার্কের দর ৭০ টাকা ৮ পয়সা থেকে ৫৪ টাকা ৬০ পয়সায়, সাধারণ বীমা খাতের বিজিআইসির দর ৬৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৪৪ টাকা ৯০ পয়সায়, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের দর ৮০ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৬৪ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

এই সময়ে মনোস্পুল পেপারের দর ২৭০ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি ছাড়ায় তিন শ টাকার ঘর। সেটি নেমে এসেছে ২৪৩ টাকা ৮০ পয়সায়।

মেঘনা লাইফ ইন্সুরেন্সের দর ৮৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৭৬ টাকা ৭০ পয়সায়, ইস্টার্ন হাউজিংয়ের দর ১০৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৮৬ টাকা ৪০ পয়সায়, জেমিনি সি ফুডের দর ৪৩৪ টাকা থেকে ৪০৩ টাকা ৮০ পয়সায় নেমেছে। এই কোম্পানিটির শেয়ার দর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পাঁচ শ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এছাড়া ইউনিক হোটেল ৬৮ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৫৯ টাকা ৩০ পয়সায়, বসুন্ধরা পেপার মিলের দর ৮৭ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৭২ টাকা ২০ পয়সা, পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্সের দর ৮০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬৫ টাকা ১০ পয়সায় এবং জেএমআই হসপিটালের দর ৮৫ টাকা ১০ পয়সা থেকে নেমেছে ৭১ টাকা ৭০ পয়সায়।