প্রতিপক্ষ পাকিস্তান ছিল বলেই কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের আঙিনায় এমন উদযাপনে মেতেছিলেন সাবিনা খাতুন-কৃষ্ণা রানী সরকাররা।
Published : 11 Sep 2022, 04:55 PM
পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলল উপভোগ্য ফুটবল। ছয়বার করল গোলের উৎসব। পাশাপাশি মেয়েদের উদযাপনও ছিল নজরকাড়া। ব্যতিক্রমী এই উদযাপনের রহস্যই সাবিনা খাতুন-কৃষ্ণা রানী সরকাররা খোলাসা করলেন। জানালেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অনুপ্রাণিত করেছিল তাদেরকে।
কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে মালদ্বীপকে হারিয়ে কোনো উদযাপন করেনি বাংলাদেশ। কিন্তু শনিবার পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে হারানো ম্যাচে অচেনা এক ভঙ্গিতে উদযাপনে মেতেছিলেন দলের সবাই। যে উদযাপন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি স্যালুট, বিজয়সূচক চিহ্ন আর প্রতিপক্ষকে গুলি করার ভঙ্গির দারুণ মিশেল!
মালদ্বীপকে হারিয়ে, পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে সাফের সেমি-ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। আগামী মঙ্গলবার ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ সেরা হওয়ার লড়াইয়ে নামবে দল। প্রতিযোগিতার পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে মহারণ সামনে রেখে রোববার দশরথের লাগোয়া আর্মি হেডকোয়াটার মাঠে হালকা অনুশীলন সেরেছে মেয়েরা।
মূলত এদিন ছিল রিকভারি। সেশনের শুরুতেও দেখা মিলল একই উদযাপনের! ভঙ্গিটা ঠিকঠাক হচ্ছিল না কৃষ্ণা রানী সরকারের। অধিনায়ক সাবিনা কিছুটা ভারিক্কি কণ্ঠে বলে উঠলেন-তোকে এর অনুশীলন করাতে হবে। অধিনায়কের কথা শুনে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠলেন সবাই। মারিয়া ওই সেলিব্রেশনের ভঙ্গি করে বললেন-দ্যাখ, এভাবে করতে হবে। মনিকা-সাজেদারা অনুকরণ করতে লাগলেন মারিয়ার ভঙ্গি। চারদিকে অদ্ভূত এক দ্যেতনা, সুর বেজে উঠল যেন।
কিভাবে এলো পাকিস্তানের বিপক্ষে এভাবে উদযাপনের পরিকল্পনা? সাবিনা-কৃষ্ণাদের কেউ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিভৎষতা, বর্বরতা দেখেননি। কিছুটা পড়েছেন বইয়ের পাতায়, কিংবা দেখেছেন টিভির পর্দায়। টিম ম্যানেজার আমিরুল ইসলাম বাবু জানালেন, ম্যাচের আগের রাতে মেয়েদের তাতিয়ে দিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প শুনিয়েছিলেন তারা।
“ম্যাচের আগের রাতের টিম মিটিংয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিক বৈরিতার বিষয়টি মেয়েদের আমরা বুঝিয়েছিলাম। যুদ্ধের সময় তো এই মেয়েদের কারো জন্ম হয়নি। সেমি-ফাইনালে উঠতে আমাদের পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়টি দরকারও ছিল, তাই মেয়েদের তাতিয়ে দিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অতীতটা তাদের বুঝিয়ে বলেছিলাম।”
৬-০ স্কোরলাইন দেখাচ্ছে সেই বুঝিয়ে বলাটা কী দারুণভাবেই না কাজে দিয়েছে। ওই উদযাপন নিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর।
পাকিস্তান ম্যাচে মিডফিল্ডের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় রেখে প্রতিপক্ষকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন মারিয়া। দলের মাঝমাঠের প্রাণভোমরা জানালেন সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিতে কতটা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি।
“আগের রাতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পাকিস্তানের বিপক্ষে গোল পেলে আমরা এভাবে উদযাপন করব। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ মানেই আমাদের ১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে যায়।”
রাইট-ব্যাক শিউলি আজিম পাকিস্তানের কোনো খেলোয়াড়কে ডান দিক দিয়ে আক্রমণের সুযোগ দেননি। ১৮ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডারও মারিয়ার সুরে সুর মেলালেন।
“ওদের বিপক্ষে ম্যাচ মানেই তো মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে যাওয়া। আমাদের মনের জোর বেড়ে যায়। আরও ভালো খেলার জন্য, ওদেরকে হারানোর জন্য অন্যরকম অনুপ্রেরণা অনুভব করি।”
একই অনুভূতি কৃষ্ণা-সানজিদা খাতুনের। ফরোয়ার্ড কৃষ্ণা কথা শেষ করতে পারলেন না। তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করেই আমাদের এই উদযাপন”-বলতেই তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলেন সানজিদা।
“যেহেতু পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল, ওই যুদ্ধে আমাদের ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন, এ কারণেই আমরা ওদের বিপক্ষে জিতে ওই উদযাপন করেছি।”
পাকিস্তানের জালে ম্যাচে এক গোল করেছিলেন সিরাত জাহান স্বপ্না। বজ্র কণ্ঠে ২১ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের সেই নির্মমতা মনে রেখেই নেমেছিলেন তারা।
“যেহেতু প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান, আমরা সবাই এমন কিছুই করতে চেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে ওরা আমাদের সঙ্গে যেটা করেছিল, সেটা তো আমরা ভুলতে পারি না। কখনই ভোলা সম্ভব নয়।”
“যারা যুদ্ধ করেছিলেন, যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের পরিকল্পনা ছিল গোল করার পর আমরা এভাবে সেলিব্রেশন করব।”
দুদিন পর ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। এর আগে প্রতিবেশি দেশটির সঙ্গে লড়াইয়ে কয়েক দফায় হয়েছে স্বপ্ন ভঙ্গ। এবার তাই খুব সতর্ক বাংলাদেশ দল।
“ভারত ম্যাচে…দেখা যাক আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি, খেলার পর দেখা যাবে কিভাবে উদযাপন করব।”
পাকিস্তানের জালে হ্যাটট্রিক উপহার দেওয়া অধিনায়ক সাবিনাও ছোট্ট কথায় বুঝিয়ে দিলেন, সেলিব্রেশনের ধারায় থাকতে টগবগ করে ফুটছে দল।
“পাকিস্তানের বিপক্ষে যেভাবে উদযাপন করার পরিকল্পনা ছিল, সেটা আমরা করেছি। আপনারা একটু দোয়া করেন। আশা করি, আমরা আরও অনেক সেলিব্রেশন করব।”