লাতিন আমেরিকার দুই পরাশক্তি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চতুর্থ শিরোপা জিতল জার্মানি।
Published : 17 Nov 2022, 04:51 PM
তিন যুগ পর বিশ্বকাপ ফিরল লাতিন আমেরিকায় কিন্তু কাপ নিয়ে যায় জার্মানি! ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেব তারা গড়ে এই কীর্তি। সব মিলিয়ে চতুর্থ ও পুনরেকর্ত্রীকরণের পর প্রথম শিরোপা জেতার পথে তারা হারায় টুর্নামেন্টের দুই ফেভারিট ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে।
২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্বকাপের ২০তম আসরের স্বাগতিক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ব্রাজিলকে। ১২ জুন থেকে ১৩ জুলাই অনুষ্ঠিত এই আসর দিয়ে বিশ্বমঞ্চে অভিষেক হয় বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার।
সরাসরি খেলে স্বাগতিক ব্রাজিল। বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসে ৩১ দেশ। এর মধ্যে ১৩টি দেশ ইউরোপের। পাঁচটি করে দেশ আসে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা থেকে। চারটি দেশ অংশ নেয় এশিয়া ও কনমেবল অঞ্চল থেকে।
এই আসরে খেলে বিশ্বকাপ জেতা সব দল। ফ্রান্সের মতোই প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয় স্পেন। তাদের অনুসরণ করে ইতালি ও ইংল্যান্ড।
প্রথম রাউন্ড
ফরম্যাটে কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই ৩২ দল খেলে আট গ্রুপে। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল যায় দ্বিতীয় রাউন্ডে।
গ্রুপ ‘এ’: ব্রাজিল, মেক্সিকো, ক্রোয়েশিয়া, ক্যামেরুন
গ্রুপ ‘বি’: নেদারল্যান্ডস, চিলি, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া
গ্রুপ ‘সি’: কলম্বিয়া, গ্রিস, কোত দি ভোয়া, জাপান
গ্রুপ ‘ডি’: কোস্টা রিকা, উরুগুয়ে, ইতালি, ইংল্যান্ড
গ্রুপ ‘ই’: ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, একুয়েডর, হন্ডুরাস
গ্রুপ ‘এফ’: আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা
গ্রুপ ‘জি’: জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগাল, ঘানা
গ্রুপ ‘এইচ’: বেলজিয়াম, আলজেরিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া
গ্রুপ ‘এ’ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় ব্রাজিল ও মেক্সিকো। দুই জয় ও নিজেদের মধ্যে ড্রয়ে এই দুই দলের পয়েন্ট ছিল সমান- ৭। গোল পার্থক্যে এগিয়ে থেকে গ্রুপ সেরা হয় ব্রাজিল।
ক্যামেরুনকে হারিয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় হয় ক্রোয়েশিয়া। আফ্রিকার দলটি বিদায় নেয় সব ম্যাচে হেরে।
গ্রুপ ‘বি’ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় নেদারল্যান্ডস ও চিলি। এই গ্রুপে কোনো ম্যাচ ড্র হয়নি। তিন জয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় নেদারল্যান্ডস। দুই জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ চিলি।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৫-১ গোলের হার দিয়ে শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে বাজে শুরু করে স্পেন। পরের ম্যাচে চিলির বিপক্ষে হারে ২-০ ব্যবধানে। বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়াকে হারায় ৩-০ গোলে।
গ্রুপ ‘সি’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় কলম্বিয়া ও গ্রিস। তিন জয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় কলম্বিয়া। একটি করে জয় ও ড্রয়ে রানার্সআপ গ্রিস।
এক জয়ে ৩ পয়েন্ট পায় কোত দি ভোয়া। ১ পয়েন্ট নিয়ে তলানিতে থেকে আসর শেষ করে জাপান।
গ্রুপ ‘ডি’ যেন ছিল মৃত্যুকূপ। তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের সঙ্গী হয়েছিল কোস্টা রিকা। সম্ভাবনায় সবচেয়ে পিছিয়ে রাখা হচ্ছিল তাদের। তবে দারুণ চমকে দেখিয়ে গ্রুপ সেরা হয়ে যায় তারাই! দুই জয়ের সঙ্গে এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট পায় কনমেবল অঞ্চলের দেশটি।
দুই জয়ে ৬ পয়ন্টে নিয়ে তাদের সঙ্গী হয় উরুগুয়ে। ইউরোপের দুই দল বাদ পড়ে যায় গ্রুপ পর্ব থেকেই। শেষ ম্যাচে কোস্টা রিকার সঙ্গে গোল শূন্য ড্র করে ইংল্যান্ড। অন্য ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ১-০ গোলে হারে ইতালি।
বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সেটিই হয়ে আছে তাদের শেষ ম্যাচ। ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপে যে মূল পর্বে যেতে পারেনি চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
গ্রুপ ‘ই’ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় ফ্রান্স। দুই জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ সুইজারল্যান্ড।
একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় একুয়েডর। সব ম্যাচ হেরে ফেরে হন্ডুরাস।
গ্রুপ ‘এফ’ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া। তিন জয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় আর্জেন্টিনা। একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ নাইজেরিয়া।
বিশ্বকাপ অভিষেকে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার প্রাপ্তি ইরানের বিপক্ষে জয়। এশিয়ার দলটি ১ পয়েন্ট নিয়ে তলানিতে থেকে আসর শেষ করে।
গ্রুপ ‘জি’ শেষ ষোলোয় যায় জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় জার্মানি। একটি করে জয় ও ড্রয়ে সমান ৪ পয়েন্ট করে পায় যুক্তরাষ্ট্র ও পর্তুগাল। গোল পার্থক্যে এগিয়ে থাকায় পরের ধাপে যায় যুক্তরাষ্ট্র।
কঠিন গ্রুপে ঘানার প্রাপ্তি ১ পয়েন্ট।
গ্রুপ ‘এইচ’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় বেলজিয়াম ও আলজেরিয়া। তিন জয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় বেলজিয়াম। একটি করে জয় ও ড্রয়ে রানার্সআপ আলজেরিয়া।
দুই ম্যাচ ড্র করে রাশিয়া, এক ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়া।
দ্বিতীয় রাউন্ড
শেষ ষোলোয় মুখোমুখি হয়: ব্রাজিল-চিলি, কলম্বিয়া-উরুগুয়ে, নেদারল্যান্ডস-মেক্সিকো, কোস্টা রিকা-গ্রিস, ফ্রান্স-নাইজেরিয়া, জার্মানি-আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা-সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম-যুক্তরাষ্ট্র।
২৮ জুনের প্রথম ম্যাচে দাভিদ লুইসের গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। ৩২তম মিনিটে সমতা ফেরান চিলির স্ট্রাইকার আলেক্সিস সানচেস। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময় শেষ হয় ১-১ সমতায়। টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে জিতে টিকে থাকে ব্রাজিল।
পরের ম্যাচে হামেস রদ্রিগেসের জোড়া গোলে উরুগুয়েকে ২-০ ব্যবধানে হারায় কলম্বিয়া
পরদিন মেক্সিকোর বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতে নেদারল্যান্ডস। ৪৮তম মিনিটে জিওভানি দস সান্তোসের গোলে এগিয়ে যায় মেক্সিকো। শেষ দিকের দুই গোলে তাদের হতাশায় ডুবায় নেদারল্যান্ডস।
দিনের অন্য ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের অতিরিক্ত সময় শেষ হয় ১-১ সমতায়। টাইব্রেকারের গ্রিসকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে এগিয়ে যায় কোস্টা রিকা।
৩০ জুনের প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়াকে ২-০ গোলে হারায় ফ্রান্স। পরের ম্যাচে আলজেরিয়াকে ২-১ গোলে হারায় জার্মানি। তিনটি গোলই হয় অতিরিক্ত সময়ে।
পরদিন অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো প্রথম ম্যাচে আনহেল দি মারিয়ার একমাত্র গোলে সুইজারল্যান্ডকে হারায় আর্জেন্টিনা। পরের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রেক ২-১ গোলে হারায় বেলজিয়াম। তিনটি গোলই হয় অতিরিক্ত সময়ে।
কোয়ার্টার-ফাইনাল
শেষ আটে মুখোমুখি হয় ফ্রান্স-জার্মানি, ব্রাজিল-কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস-কোস্টা রিকা।
৪ জুলাইয়ের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারায় জার্মানি। পরের ম্যাচে কলম্বিয়াকে ২-১ গোলে হারায় ব্রাজিল।
পরদিনের প্রথম ম্যাচে গনসালো হিগুয়াইনের একমাত্র গোলে বেলজিয়ামকে হারায় আর্জেন্টিনা। অন্য ম্যাচ নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ও গোলশূন্য থাকার পর টাইব্রেকারে গড়ায়। সেখানে ৪-৩ গোলে কোস্টা রিকাকে হারিয়ে এগিয়ে যায় নেদারল্যান্ডস।
সেমি-ফাইনাল
স্বপ্নের ফাইনাল কী সম্ভব? প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে কী দেখা হবে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার? এমন নানা আলোচনা কী নির্মমভাবেই না থামিয়ে দিল জার্মানি।
স্বপ্নের বিশ্বকাপ ব্রাজিলের জন্য হয়ে গেল দুঃস্বপ্ন। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে টুর্নামেন্টের সফলতম দলটি হেরে গেল ৭-১ গোলে! বিশ্বকাপ তো বটেই ফুটবলে ব্রাজিলের এটাই সবচেয়ে বড় হার।
২৩তম মিনিটের গোলে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নিজের করে নেন জার্মানি মিরোস্লাভ ক্লোসা।
পরদিনের আরেক সেমি-ফাইনালে উৎসব দূরের কথা কোনো গোলই হয়নি। টাইব্রেকারে ৪-২ ব্যবধানে জিতে আর্জেন্টিনা পৌঁছায় ফাইনালে, ১৯৯০ আসরের পর প্রথমবার।
১২ জুলাই তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারায় নেদারল্যান্ডস।
ফাইনাল
১৩ জুলাই, ২০১৪। রিও দে জেনেইরোর মারাকানা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও জার্মানি। আগের ম্যাচের মতো অতো দাপট দেখাতে পারেনি ইউরোপের দলটি। বরং তিনটি খুব ভালো সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। তবে এর কোনোটি কাজে লাগানো দূর, গোলরক্ষককে পরীক্ষায়ও ফেলতে পারেনি তারা।
মনে হচ্ছিল ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়াতে যাচ্ছে। ১১৩তম মিনিটে দারুণ এক গোলে ব্যবধান গড়ে দেন মারিও গোটসে। চতুর্থবারের মতো বিশ্বকাপ জেতে জার্মানি।
খুব কাছে গিয়েও শিরোপা না জেতার আক্ষেপ নিয়ে ফেরে আর্জেন্টিনা।
২০তম বিশ্বকাপ
· স্বাগতিকঃ ব্রাজিল
· চ্যাম্পিয়নঃ জার্মানি
· রানার আপঃ আর্জেন্টিনা
· মোট ম্যাচঃ ৬৪
· মোট গোলঃ ১৭১
· গোল গড়ঃ ২.৬৭
· সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ হামেস রদ্রিগেস (কলম্বিয়া- ৬ গোল)
· সেরা খেলোয়াড়ঃ লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)