১৯৫০ এর জুন থেকে ১৯৫৬ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৫০ ম্যাচে হাঙ্গেরির হার কেবল একটি, বিশ্বকাপ ফাইনালে!
Published : 16 Nov 2022, 10:14 AM
সিংহাসনে বসতে হলে জিততে হবে বিশ্বকাপ। পরতে হবে মুকুট। সমর্থকদের মন জয় করতেও উঁচিয়ে ধরতে হবে ট্রফি। অন্যথায়? লেখা হবে ব্যর্থতার গল্প, জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে না পাওয়ার হাহাকার। ফুটবলে এসবই চিরাচরিত নিয়ম। তবে আছে কিছু ভিন্নতাও। সমর্থক থেকে শুরু করে বোদ্ধাদের মুখে মুখে শোনা যায় তেমনই কয়েকটি ‘বিশ্বজয়ী’ দলের গল্প। যাদের মাথায় নেই কোনো মুকুট। তবে সুন্দর, দাপুটে আর নজরকাড়া ফুটবলে তারা জয় করে নিয়েছিল সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের মন।
বিশ্বসেরার মঞ্চে সেই দলগুলো আবির্ভুত হয়েছিল সম্ভাব্য সেরা হিসেবে, ফেভারিটের তকমা গায়ে মেখে। রক্ষণ, মাঝমাঠ কিংবা আক্রমণভাগ-কোনোখানেই কোনো ঘাটতি ছিল না তাদের। তাদের একমাত্র ক্ষুধা ছিল সাফল্য, জয়টাকে অভ্যাসে পরিণত করেছিল তারা। প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ঙ্কর, আর সমর্থকদের চোখে শিল্পী। কিন্তু শেষটা তাদের হয়েছিল অবিশ্বাস্য; বিশ্ব সেরা হওয়ার হাতছানিতে এসে ফিরতে হয়েছিল একরাশ হতাশা নিয়ে।
জয়ীদের নামই মনে রাখে সবাই। দ্বিতীয় কে হয়েছিল মনে রাখে না কেউ। উজ্জ্বল তিন ব্যতিক্রম আছে ফুটবলে- ১৯৫৪ বিশ্বকাপের হাঙ্গেরি, ১৯৭৪ বিশ্বকাপের নেদারল্যান্ডস এবং ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দল।
কাতার আসরকে সামনে রেখে ফিরে দেখার প্রথম পর্বে থাকছে ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করা, ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঘটনের একটির শিকার ‘দা ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’ হাঙ্গেরির কথা।
⚽️ 27 goals in one World Cup ????
— FIFA World Cup (@FIFAWorldCup) June 4, 2020
⚽️ An average of 5.4 per match ????
???????? Hungary tore up the #WorldCup record books in 1954 with their groundbreaking style and dazzling attack of Hidegkuti, Kocsis & Puskas ???? pic.twitter.com/0NJ9ytgmFh
ক্ষুধা মিটল না হাঙ্গেরির
‘ওরা হারতে জানে না, ওরা হারতে পারে না,’ সেই সময়ের হাঙ্গেরি দলটিকে নিয়ে হয়তো এমন সব কথাই বলা হতো। আর কেনই বা নয়, বল পায়ে তারা যে হয়ে উঠেছিল দুর্বার, তাদের হারানোর সাধ্য কার!
সেই অদম্য, অজেয় হাঙ্গেরিয়ান ফুটবল দলটির গল্প যেন রূপকথার অংশ। সেখানে আছে নিদারুণ এক ট্র্যাজেডি। একের পর এক বিজয়গাঁথার মাঝেই আঘাত হানে একটি পরাজয়, যা দেশটির ফুটবলকেই স্তব্ধ করে দেয়।
ফুটবলের সবুজ ময়দানে সেই সময়ের হাঙ্গেরি দল আক্ষরিক অর্থেই ছিল অপ্রতিরোধ্য। জয় তো ছিল নিত্য দিনের সঙ্গী। তবে সেটা আসতো এমনভাবে যে প্রতিপক্ষের মনোবল গুঁড়িয়ে যেত। ছোট-মাঝারি-বড় কোনো দলই রক্ষা পায়নি তাদের হাত থেকে। পরিসংখ্যানের পাতায় আছে এর স্পষ্ট ছাপ।
দলটির অজেয় হয়ে ওঠার প্রথম অধ্যায় ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ এর সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো দেশ ছিল বিধ্বস্ত, কিন্তু চরম দুরাবস্থার মাঝেও তাদের ফুটবল ছিল আলো ঝলমলে। বাস্তবিক অর্থেই তখন হারের কথা ভুলে গিয়েছিল তারা।
ওই পাঁচ বছরে একটিও ম্যাচ হারেনি হাঙ্গেরি; ২৭ ম্যাচ খেলে গোল করে ১০৫টি! এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পর অনেকেই ৫০-এর বিশ্বকাপে তাদেরকেই সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া যে বিশ্বযুদ্ধ তাদের ফুটবলকে টলাতে পারেনি, সেই যুদ্ধই অজেয় দলটির বিশ্বকাপে যাওয়া আটকে দেয়।
ব্রাজিলের ওই আসরে দলকে পাঠানোর সামর্থ্য ছিল না হাঙ্গেরি সরকারের! আগের পাঁচ বছরের খুনে রূপ নিয়ে তারা বিশ্ব মঞ্চে পা রাখলে কী হতে পারত, সেটা এখন শুধু একরাশ আক্ষেপ নিয়ে কল্পনাই করা যায়।
বিশ্বকাপে যেতে না পারার হতাশা থাকলেও তা হাঙ্গেরিয়ানদের দুর্দান্ত পথচলায় বাধা হতে পারেনি। সর্বজয়ী সেই হাঙ্গেরি দলের ১৯৪৯ সালে দায়িত্ব নেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কোচ গুস্তাভ সেভেস। তার স্কোয়াডে ছিল ইউসেফ বোসিক। ভয়ঙ্কর সেন্টার-ফরোয়ার্ড সান্দোর ককসিস; আন্তজার্তিক ফুটবলে ম্যাচের চেয়ে যার গোল ছিল বেশি (৬৮ ম্যাচে ৭৫ গোল!) এবং উইঙ্গার জ্লোতান চিবোর; সাইডলাইন ধরে আক্রমণে উঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণ চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে যার জুড়ি মেলা ভার।
দলটির আসল ‘ফলস নাইন’ ছিলেন নান্দোর ইদেকুটি। ফরোয়ার্ড পজিশন থেকে আচমকা নেমে এসে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতেন, তাতে জায়গা তৈরি হতো সতীর্থদের (তারপরও ১৯৫৪ বিশ্বকাপে করেছিলেন চার গোল)। আর এই নামগুলোর ভিড়ে ছিলেন কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাস, ফুটবল ইতিহাসের সেরা ১০ খেলোয়াড়ের তালিকা করলে যার নাম থাকবে অবধারিতভাবে।
৫০’র বিশ্বকাপে খেলতে না পারার দুঃখ ভুলে দুই বছর বাদে ১৯৫২ অলিম্পিকসে সোনার পদক জেতে হাঙ্গেরি। এরপর, বিধ্বংসী সেই হাঙ্গেরি ১৯৫৩ সালে বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের জানান দেয় আরেক নাটকীয় ঢংয়ে।
যা আগে কেউ কখনও পারেনি তাই করে দেখায় তারা; প্রথম দল হিসেবে ইংল্যান্ডকে তাদের মাটিতেই হারিয়ে দেয়। তাও আবার যেনতেনভাবে নয়, ওয়েম্বলির আঙিনায় ইংলিশদের গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ৬-৩ গোলে। ৬ মাস পর বুদাপেস্টে ইংল্যান্ডকে আবার পেয়ে ৭-১ গোলের জয়োৎসব করে তারা। দ্বিতীয় ওই হারের পর ইংল্যান্ডের সেন্টার-ব্যাক সিড ওয়েন বলেছিলেন, “খেলাটা যেন হলো মানুষের সঙ্গে ভিনগ্রহীদের।”
পুসকাস-চিবোরদের দলটিকে ডাকা হতো নানা নামে, ‘দা গোল্ডেন টিম’, ‘দা মাইটি ম্যাগিয়ার্স’, ‘দা ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’, আরও কত কী। তাদের জয়রথ ছুটছিল সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই তারকাকে ছাড়াই। তার একজন লাজলো কুবালাকে রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৯ সালে দেশ ছাড়তে হয়েছিল আর ফেরেঙ্ক ডিক জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলেন অদ্ভূত এক কারণে, কারণ তিনি ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছিলেন! একবার এক মৌসুমে ৩৪ ম্যাচ খেলে ৬৬ গোল করেছিলেন সেন্টার-ফরোয়ার্ড ফেরেঙ্ক।
স্বপ্নময় পথচলায় ১৯৫০ এর জুন থেকে ১৯৫৬ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৫০ ম্যাচ খেলে রেকর্ড ৪২টি জেতে তারা, ড্র করেছিল সাতটি। পরাজয় কেবল একটি, ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেই হারটিই জন্ম দিয়েছিল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডির।
সুইজারল্যান্ডের আসরে প্রত্যাশিতভাবেই দুর্দান্ত শুরু করেছিল হাঙ্গেরি; গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ গোলে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর তারা শক্তিশালী পশ্চিম জার্মানিকে উড়িয়ে দিয়েছিল ৮-৩ গোলে।
পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচেই ঘটে যায় বড় এক দুর্ঘটনা। ম্যাচের বাকি তখন ১৫ মিনিট, প্রতিপক্ষের এক বাজে ফাউলে ছিটকে যান হাঙ্গেরির স্বপ্নসারথী পুসকাস। ফাইনালের আগ পর্যন্ত আর ফিরতে পারেননি তিনি।
দলের সেরা খেলোয়াড়কে ছাড়াই কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর সাত মিনিটের মধ্যে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় তারা। রেফারির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ, অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম এবং এমনকি মারামারিতেও জড়িয়ে পড়ে দুই দলের খেলোয়াড়রা। ইতিহাসের পাতায় ‘দা ব্যাটল অব বার্ন’ নামে পরিচিত ম্যাচটি ৪-২ গোলে জেতে হাঙ্গেরি।
সেমি-ফাইনালে উরুগুয়েকেও ৪-২ ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা লড়াইয়ের মঞ্চে জায়গা করে নেয় ‘দা ম্যাগনিফিসেন্ট ম্যাগিয়ার্স’ হাঙ্গেরি। সামনে প্রতিপক্ষ সেই পশ্চিম জার্মানি, যাদের নিয়ে গ্রুপ পর্বে ছেলেখেলা করেছিল পুসকাসরা।
শিরোপা লড়াইয়ে শুরুতে যখন দুই অধিনায়ক হাত মেলালেন ওই মুহূর্তের ছবিটার মাঝেই লুকিয়ে দুই দলের মাঝে বিশাল পার্থক্য। এক পাশে ওই সময়ের বিশ্বসেরা ফুটবলার পুসকাস, আরেক পাশে জার্মান অধিনায়ক ফ্রিৎস ওয়াল্টার। যিনি ছিলেন একজন ব্যাঙ্কার, একই সঙ্গে একটি লন্ড্রিও চালাতেন তিনি।
অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আসা তখনকার জার্মান দলটিকে সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে ‘সেমি-প্রফেশনাল।’ তাইতো তাদের বিপক্ষে সেদিনের হাঙ্গেরির পরাজয়কে আজও দেখা হয় ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঘটন হিসেবে।
ম্যাচটি তাই আজও পরিচিত ‘দা মিরাকল অব বার্ন’ নামে।
সেই অঘটনের মঞ্চে ম্যাচের শুরুটা অবশ্য হয়েছিল চেনা চিত্রনাট্য মেনে। ষষ্ঠ মিনিটে জার্মানির জালে বল, দুই মিনিট পর আবার। গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ের পুনরাবৃত্তিই কি হতে চলেছে? অনেকের মনে সেই সম্ভাবনা বা শঙ্কাও হয়তো উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু কে জানতো চিত্রনাট্যের শেষাংশে অবিশ্বাস্য, অভাবনীয় এক ফল অপেক্ষা করছে। জার্মানদের জয় নিয়ে সিনেমা হবে ‘দা মিরাকল অব বার্ন’ নামে! (২০০৩ সালে তৈরি হয়েছিল)।
দুই গোল হজমের ধাক্কা সামলাতে অলৌকিক কিছু প্রয়োজন ছিল জার্মানির। মাক্সিমিলিয়ান মারলক ও হেলমুট রানের গোলে পরের ১০ মিনিটে স্কোরলাইন ২-২ করে জার্মানরা। এতদিনের দুর্দান্ত, চমকপ্রদ হাঙ্গেরি এরপর যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলে। উদ্ভ্রান্ত, দিকভ্রান্ত হয়ে ভুলে যায় গোলের পথ। শেষ দিকে ৮৪তম মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোলে দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ উপহার দেন রান। স্বপ্ন ভাঙে হাঙ্গেরির।
জার্মানদের মাথায় বিশ্বসেরার মুকুট, অবশই কোনো হতবাক করা ঘটনা ছিল না। তবে, হারের স্বাদ ভুলে যাওয়া হাঙ্গেরির ফাইনালে এসে এতদিনের চেনা পথটা ভুলে যাওয়া ছিল বড় বিস্ময়কর। কিছু তথ্য-উপাত্ত সেটাকে আরও বিস্ময়কর করে তোলে।
সেদিনের আগে কোনো দল বিশ্বকাপের ফাইনালে দুই গোলে এগিয়ে যাওয়ার পরও হারেনি। সেই আসরের আগে কোনো দল টানা ৩০ ম্যাচ অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে যায়নি (মাত্র দ্বিতীয় দল হিসেবে এই কীর্তি গড়তে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা)। গ্রুপ পর্বে কোনো প্রতিপক্ষকে ৮-৩ গোলের মতো বড় ব্যবধানে হারানোর পর সেই দলের বিপক্ষেই আবার ফাইনালে নামেনি কোনো দল।
এমন অবিশ্বাস্য এক পরাজয়ের গল্প লিখে, আফসোস বাড়ানো অনেক প্রথমের জন্ম দিয়ে হাঙ্গেরি মাঠ ছেড়েছিল সেদিন। যে ফাইনাল হাঙ্গেরির জন্য হতে পারতো সাফল্যের মহাকাব্য, পুসকাস-ইদেকুটিরা হতে পারতেন বীর, সেটাই ইতিহাসের বুকে জায়গা করে নেয়, ‘দা আনফরগেটেবল ট্র্যাজেডি’ নামে; চিরদিনের জন্য পুসকাররা হয়ে যান ‘ট্র্যাজিক হিরো।’।