১৯৯০ বিশ্বকাপ: গোল খরার আসর

আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে পশ্চিম জার্মানি।

ইকবাল শাহরিয়ারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2022, 01:30 PM
Updated : 14 Nov 2022, 01:30 PM

ফুটবল গোলের খেলা, সেই গোলই যদি না হয় তাহলে মজাটা থাকে কোথায়? ৫২ ম্যাচে গোল মোটে ১১৫টি। ম্যাচ প্রতি কেবল ২.২টি করে, এখন পর্যন্ত যা সবচেয়ে কম গোলের রেকর্ড। এই টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে তৃতীয় শিরোপা জেতে পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপের সফলতম দলের তালিকায় বসে ব্রাজিল ও ইতালির পাশে।

১৯৮৪ সালে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফিফার সভায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ১১-৫ ভোটে হারায় ইতালি। এতে ১৯৩৪ সালের পর দীর্ঘ বিরতি শেষে ১৯৯০ সালে আবার বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায় দেশটি।

৮ জুন থেকে ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে খেলা হয় আগের আসরের ফরম্যাটেই। মেক্সিকোর পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে দুটি আসর আয়োজনা করা ইতালি এবং গত আসরের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা জায়গা করে নেয় সরাসরি। ১১৬ দেশের বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসে বাকি ২২ দল।

সবচেয়ে বেশি ১৪ দেশ অংশ নেয় ইউরোপ থেকে। লাতিন আমেরিকা থেকে আসে চারটি। কনমেবল অঞ্চল, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসে দুটি করে দেশ। 

বিশ্বকাপে অভিষেক হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, কোস্টা রিকা, আয়ারল্যান্ডের। 

এই আসরেই শেষবারের মতো অংশ নেয় পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপ জয়ের কয়েক মাস পর পূর্ব জার্মানির সঙ্গে ঘটে পুনরেকত্রীকরণ। 

লাল কার্ড দেখানো হয় ১৬টি, এই আসরেই প্রথমবারের মতো ফাইনালে লাল কার্ড দেখেন কোনো খেলোয়াড়। প্রথমবার ফাইনালে গোল করতে ব্যর্থ হয় কোনো দল- আর্জেন্টিনা। প্রথমবার শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে নিজ মহাদেশের বাইরের কোনো প্রতিপক্ষকে হারাতে পারে ইউরোপীয় কোনো দল। 

রক্ষণাত্মক ফুটবল বন্ধ করতে ইতালি আসরের পর গোলরক্ষকের দিকে ব্যাক পাস নিয়ে নিয়ম করে ফিফা। এরপর থেকে ব্যাক পাস দিলে আর হাত দিয়ে বল ধরতে পারেন না গোলরক্ষকরা। আর প্রতিটি জয়ের জন্য ২ এর জায়গায় দেওয়া হয় ৩ পয়েন্ট। যা কার্যকর আছে এখনও। 

প্রথম পর্ব 

২৪ দলকে ভাগ করা হয় ৬ গ্রুপে। প্রতিটি গ্রুপের সেরা দুই দল এবং তৃতীয় সেরা চারটি দল যায় পরের রাউন্ডে। 

১৬ দলের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই শুরু হয় নক আউট পর্ব। সেখান থেকে ধাপে ধাপে হয় কোয়ার্টার-ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল ও ফাইনাল। 

  • গ্রুপ ‘এ’: ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

  • গ্রুপ ‘বি’: আর্জেন্টিনা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, রোমানিয়া, ক্যামেরুন

  • গ্রুপ ‘সি’: ব্রাজিল, কোস্টা রিকা, স্কটল্যান্ড, সুইডেন

  • গ্রুপ ‘ডি’: পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া, কলম্বিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত

  • গ্রুপ ‘ই’: স্পেন, বেলজিয়াম, উরুগুয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া  

  • গ্রুপ ‘এফ’: ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, মিশর 

গ্রুপ ‘এ’ থেকে পরের ধাপে যায় ইতালি ও চেকোস্লোভাকিয়া। তিন জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় ইতালি। দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ চেকোস্লোভাকিয়া। এক জয়ে ২ পয়েন্ট পাওয়া অস্ট্রিয়া ব্যর্থ হয় তৃতীয় স্থান পাওয়া সেরা চার দলের মধ্যে থাকতে। সব ম্যাচ হেরে শূন্য হাতে ফেরে যুক্তরাষ্ট্র।  

গ্রুপ ‘বি’ থেকে পরের ধাপে যায় ক্যামেরুন, রোমানিয়া ও আর্জেন্টিনা। দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে গ্রুপ সেরা হয় ক্যামেরুন। উদ্বোধনী ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে অবাক করে দেয় ফুটবল বিশ্বকে। পরে জেতে রোমানিয়ার বিপক্ষেও। 

একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট করে পায় রোমানিয়া ও আর্জেন্টিনা। দুই দলের গোল পার্থক্যও ছিল সমান। গোল কম করায় তৃতীয় হয় আর্জেন্টিনা। 

ক্যামেরুনকে ৪ গোলে উড়িয়ে আসর শেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপরই পতন ঘটে তাদের। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব মঞ্চে এটাই ছিল তাদের শেষ উপস্থিতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া, ইউক্রেন খেলে বিশ্বকাপে। 

গ্রুপ ‘সি’ থেকে শেষ ষোলোয় যায় ব্রাজিল ও কোস্টা রিকা। তিন জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় ব্রাজিল। দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ কোস্টা রিকা। এক জয়ে ২ পয়েন্ট পাওয়া স্কটল্যান্ড থাকতে পারেনি তৃতীয় স্থানে থাকা সেরা চার দলের মধ্যে। সব ম্যাচ হেরে শূন্য হাতে ফেরে সু্ইডেন।   

‘ডি’ গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোয় যায় পশ্চিম জার্মানি, যুগোস্লাভিয়া ও কলম্বিয়া। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় পশ্চিম জার্মানি। দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয় কলম্বিয়া। একটি করে জয় ও ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয়। সব ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত।  

গ্রুপ ‘ই’ থেকে পরের ধাপে যায় স্পেন, বেলজিয়াম ও উরুগুয়ে। সব ম্যাচে হেরে বিদায় নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। 

দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ সেরা হয় স্পেন। দুই জয়ে ৪ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ বেলজিয়াম। একটি করে জয় ও ড্রয়ে তৃতীয় হয় উরুগুয়ে। 

গ্রুপ ‘এফ’ থেকে পরের ধাপে যায় ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৫ পয়েন্ট পেয়ে গ্রুপ সেরা হয় ইংল্যান্ড। তিনটি করে ড্রয়ে ৩ পয়েন্ট নিয়ে পরের দুটি স্থানে যথাক্রমে আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। 

এই দুই দলের গোল পার্থক্য ছিল সমান, গোল করেছিলও সমান। তাই ড্রয়ে অবস্থানের ভিত্তিতে দ্বিতীয় হয় আয়ারল্যান্ড, তৃতীয় নেদারল্যান্ডস। এই গ্রুপের ৫ ম্যাচ হয় ড্র, একমাত্র হারের তেতো স্বাদ পায় মিশর। ১৯৮২ সালের পর কেবল দ্বিতীয়বারের মতো কোনো গ্রুপ ম্যাচে মাত্র একটি জয় এলো। 

দ্বিতীয় রাউন্ড 

শেষ ষোলোয় মুখোমুখি হয়: কামেরুন-কলম্বিয়া, কোস্টা রিকা-চেকোস্লোভাকিয়া, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, পশ্চিম জার্মানি-নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড-রোমানিয়া, ইতালি-উরুগুয়ে, স্পেন-যুগোস্লাভিয়া, ইংল্যান্ড-বেলজিয়াম। 

দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। প্রথম ৯০ মিনিট জালের দেখা পায়নি ক্যামরুন ও কলম্বিয়া। পরে রজার মিলারের জোড়া গোলে ২-১ ব্যবধানে জিতে কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় ক্যামেরুন। একই দিন অন্য ম্যাচে কোস্টা রিকাকে ৪-১ গোলে হারিয়ে তাদের সঙ্গী হয় চেকোস্লোভাকিয়া। 

২৪ জুন তুরিনে মুখোমুখি হয় লাতিন আমেরিকার দুই পরাশক্তি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ৮১তম মিনিটে দিয়েগো মারাদোনার দুর্দান্ত পাসে ক্লাদিও কানিজিয়ার চমৎকার ফিনিশিং গড়ে দেয় ব্যবধান। ১-০ গোলে জিতে পরের ধাপে যায় আর্জেন্টিনা। দিনের অন্য ম্যাচে নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারায় পশ্চিম জার্মানি। 

রোমানিয়া ও আয়ারল্যান্ড নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর গোল পায়নি অতিরিক্ত সময়েও। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ৫-৪ গোলে জিতে এগিয়ে যায় আয়ারল্যান্ড। দিনের অন্য ম্যাচে উরুগুয়েকে ২-০ গোলে হারায় ইতালি। 

স্পেনের বিপক্ষে ৭৮ মিনিটে এগিয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া। ৮৪তম মিনিটে সমতা ফেরায় স্পেন। অতিরিক্তি সময়ের শুরুতেই আবার গোল হজম করে পিছিয়ে পড়ে তারা। সেই ব্যবধান ধরে রেখেই কোয়ার্টার-ফাইনালে যায় যুগোস্লাভিয়া। শেষ ম্যাচ তো প্রায় টাইব্রেকারে চলেই যাচ্ছিল। ১১৯তম মিনিটের গোলে বেলজিয়ামকে হারিয়ে শেষ আট নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড। 

কোয়ার্টার-ফাইনাল 

শেষ আটে মুখোমুখি হয়: আর্জেন্টিনা-যুগোস্লাভিয়া, ইতালি-আয়ারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি-চেকোস্লোভাকিয়া ও  ইংল্যান্ড-ক্যামেরুন। 

কোয়ার্টার-ফাইনাল শুরু হয় টাইব্রেকার দিয়ে। নির্ধারিত নব্বই মিনিটের পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও কোনো গোল করতে পারেনি আর্জেন্টিনা ও যুগোস্লাভিয়া। সের্হিও গয়কোচিয়ার বীরত্বে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে জিতে সেমি-ফাইনালে যায় আর্জেন্টিনা। একই দিনের অন্য ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে তাদের সঙ্গী হয় ইতালি। 

চেকেস্লোভাকিয়াকে পেনাল্টি থেকে লোথার মাথেউসের একমাত্র গোরে হারিয়ে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করে পশ্চিম জার্মানি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরেক ম্যাচে প্রবল লড়াই করে ক্যামেরুন। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ ২-২ ড্র ছিল। পরে ১০৫তম মিনিটে গ্যারি লিনেকার সফল স্পট কিকে এগিয়ে নেন দলকে। ৩-২ গোলে জিতে শেষ চারে যায় ইংল্যান্ড। 

সেমি-ফাইনাল 

ফাইনালে যাওয়ার দুটি লড়াইয়েরই নিষ্পত্তি হয় টাইব্রেকারে। ১৭তম মিনিটে ইতালিকে এগিয়ে নেন সালভাতোরে শিলাচি। ৬৭তম মিনিটে আর্জেন্টিনাকে সমতায় ফেরান কানিজিয়া। টুর্নামেন্টে ইতালির জালে এটাই ছিল প্রথম গোল! 

টাইব্রেকারে আবার জাদু দেখান গয়কোচিয়া। ৪-৩ গোলে জিতে ফাইনালে পৌঁছায় আর্জেন্টিনা। বিদায় নেয় স্বাগতিকরা। 

তুরিনে পরের দিন পশ্চিম জার্মানি ও ইংল্যান্ডের ম্যাচও নির্ধারিত সময়ে ১-১ ব্যবধানে শেষ হয়। অতিরিক্ত সময়ে গোল পায়নি কোনো দলই। টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতে প্রথম দল হিসেব টানা তিন আসরের ফাইনালে পৌঁছায় পশ্চিম জার্মানি। 

তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারায় ইতালি। 

ফাইনাল 

৮ জুলাই, ১৯৯০। রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও পশ্চিম জার্মানি। গত আসরের ফাইনালের পুনর্মঞ্চায়ন হলেও খেলা তেমন হয়নি। নিষেধাজ্ঞা ও চোটের জন্য আর্জেন্টিনা পায়নি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন খেলোয়াড়কে। 

রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে ম্যাচ টাইব্রেকারে নেওয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য। ৬৫তম মিনিটে ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে লাল কার্ড দেখেন আর্জেন্টিনার পেদ্রো মনসন। সফল স্পট কিকে ৮৫তম মিনিটে পশ্চিম জার্মানিকে এগিয়ে নেন আন্ড্রেয়াস ব্রেহমে। এর দুই মিনিট পরে গুস্তাভো দেসোতিকে লাল কার্ড দেখান রেফারি এদগার্দো কোদেসাল। ৯ জনের দলে পরিণত হয় আর্জেন্টিনা। 

শেষ পর্যন্ত ১-০ গোলে জিতে শিরোপা উল্লাস করে পশ্চিম জার্মানি। 

এক নজরে চতুর্দশ বিশ্বকাপ 

·                  স্বাগতিকঃ ইতালি

·                  চ্যাম্পিয়নঃ পশ্চিম জার্মানি

·                  রানার্স আপঃ আর্জেন্টিনা

·                  মোট ম্যাচঃ ৫২

·                  মোট গোলঃ ১১৫

·                  গোল গড়ঃ ২.২২

·                  সর্বোচ্চ গোলদাতাঃ সালভাতোরে শিলাচি (ইতালি -৬ গোল)

·                  সেরা খেলোয়াড়ঃ সালভাতোরে শিলাচি (ইতালি)