যাদের অভাব অনুভব করবে বিশ্বকাপ

ক্যারিয়ারের শুরুতে থাকা আর্লিং হলান্ডের মতো সায়াহ্নে থাকা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের পায়ের ছাপ পড়বে না কাতার আসরে। 

অনীক মিশকাতঅনীক মিশকাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2022, 08:30 AM
Updated : 19 Nov 2022, 08:30 AM

“স্ট্রাইকার লাগবে? কোনো সমস্যা নেই। আমাদের হাতে একজন আছে! কাতারে তো এক জায়গাতেই বিশ্বকাপ হচ্ছে। হেলিকপ্টারে করে প্রতি ম্যাচে এক অর্ধ করে দুই দলের হয়ে খেলতে পারবে আমাদের গোল মেশিন,” অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয় কার কথা বলা হচ্ছে। দল বাছাইপর্ব উতরাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বকাপে খেলা হচ্ছে না আর্লিং হলান্ডের। তার মানের একজন স্ট্রাইকারের অভাব এই টুর্নামেন্টে অনেক দলেরই অনুভব করার কথা।

ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে তখন দুর্দান্ত ছন্দে হলান্ড। মাঠে নামলেই হয়ে যাচ্ছে হ্যাটট্রিক! সে সময়েই টুইটারে তার ভক্তরা মেতেছিলেন এক পিটিশনে। বেশ সাড়াও পেয়েছিলেন তারা। দেখাচ্ছিলেন, কীভাবে এখনও বিশ্ব মঞ্চে দেখা যেতে পারে নরওয়ের তুমুল প্রতিভাবান ফরোয়ার্ডকে।   

অবশ্যই বাস্তবসম্মত নয়। তবে এই পিটিশন কাণ্ডেই স্পষ্ট, হলান্ডের অভাব কতটা অনুভব করছেন ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বকাপে তো তারার অভাব নেই। লিওনেল মেসি, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর মতো মহাতারকা খেলবেন এবারও। থাকবেন নেইমার, কিলিয়ান এমবাপে, হ্যারি কেইনরা। তারপরও আছেন কয়েকজন, যাদের অনুপস্থিতিতে কাতার আসরের দ্যুতি একটু হলেও রঙ হারাবে।  

আলফ্রেদো দি স্তেফানো, জর্জ বেস্ট, জর্জ উইয়াহ, এরিক কাঁতোয়া, লাজলো কুবালার মতো ফুটবল গ্রেটরা খেলতে পারেননি বিশ্বকাপে। ২২ বছর বয়সী হলান্ডের সামনে এখনও ঢের সময় আছে বিশ্ব মঞ্চের অভিজ্ঞতা নেওয়ার।

ক্যারিয়ারে এই তরুণের বিপরীত অবস্থানে থাকা জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচকে দেখা যাবে না এবারের আসরে। মোহামেদ সালাহ, রিয়াদ মাহরেজ, লুইস দিয়াস, ভিক্টর ওসিমহেন, জানলুইজি দোন্নারুম্মাদেরও পা পড়বে না কাতারের এবারের মঞ্চে।

আর্লিং হলান্ড

কী দারুণ সময়ই না কাটছে হলান্ডের। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া নরওয়ের এই স্ট্রাইকার ম্যানচেস্টার সিটিতে প্রতিনিয়ত যেন স্পর্শ করছেন নতুন উচ্চতা। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবটির হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৩ ম্যাচে করেছেন ১৮ গোল।

এর মধ্যে রয়েছে তিন হ্যাটট্রিক। যার সৌজন্যে ভেঙেছেন এক গাদা রেকর্ড। আভাস দিয়েছেন আরও অনেক রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার। প্রথম ফুটবলার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মাত্র ২০ ম্যাচে করেছেন ২৫ গোল।

নরওয়ের হয়েও তার পারফরম্যান্স অসাধারণ; এখন পর্যন্ত ২১ ম্যাচে করেছেন ২৩ গোল। 

নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকাপকে ‘মিস’ করবেন হলান্ড। তবে এমন দুর্দান্ত ছন্দে থাকা একজনের শূন্যতা হয়তো বিশ্বকাপই বেশি অনুভভ করবে। আর ডিফেন্ডাররা বেঁচে গেলেন ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন থেকে।

বাছাইয়ে নরওয়ের ব্যর্থতার পর হলান্ডের নামই বেশি আসছে। তবে মার্টিন ওডেগোর্ডের অভাবও ভালোভাবেই অনুভব করার কথা ফুটবল ভক্তদের। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষে আর্সেনালের থাকার পেছনে এই মিডফিল্ডারের দারুণ অবদান।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। তবে ইউরোপের সফলতম ক্লাবে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। যেটা পেরেছেন আর্সেনালের জার্সিতে। এবার আট ম্যাচে করেছেন তিন গোল, অবদান রেখেছেন একটিতে। গোলের এই পরিসংখ্যান ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ দলে তার অবদান।

ছন্দে থাকা এই তরুণদের নরওয়ে ইউরোপ অঞ্চলের বাছাইপর্বে ‘জি’ গ্রুপে নেদারল্যান্ডস ও তুরস্কের পেছনে থেকে তৃতীয় হয়।

‘দা গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর অনন্য এক কীর্তি আছে নরওয়ের। একবিংশ শতাব্দীতে এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ খেলতে না পারা দেশটি সবশেষ খেলেছিল ১৯৯৮ আসরে। সেবার গ্রুপ পর্বে তারা হারিয়েছিল ব্রাজিলকে। একাধিক ম্যাচ খেলেও পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে হারের স্বাদ না পাওয়া একমাত্র দল নরওয়ে। ব্রাজিলের বিপক্ষে চার ম্যাচে তাদের ফল- দুটি করে জয় ও ড্র!

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ

“আমাকে ছাড়া বিশ্বকাপে দেখার মতো কিছু নেই। তাই বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা অর্থহীন”, ৯ বছর আগে বলেছিলেন ইব্রাহিমোভিচ। ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে সুইডেন উঠতে ব্যর্থ হওয়ার পর এই মন্তব্য করেছিলেন তিনি। সেবার ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর হ্যাটট্রিকসহ চার গোলে দুই লেগে প্লে-অফে পর্তুগালের বিপক্ষে হেরে ছিটকে গিয়েছিল সুইডেন।

আরও একটা বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ফুটবলের এই বর্ণময় চরিত্রকে ছাড়াই। রবের্ত লেভানদোভস্কির পোল্যান্ডের বিপক্ষে প্লে-অফে হেরে কাতারের টিকেট কাটতে ব্যর্থ হয় সুইডেন।

সম-সাময়িক প্রায় সবাই তো কত আগেই তুলে রেখেছেন বুট জোড়া। সেখানে এখনও শীর্ষ পর্যায়ে খেলে যাচ্ছেন ইব্রাহিমোভিচ। চোটের জন্য শঙ্কা থাকলেও ২০২৩ পর্যন্ত এসি মিলানে থাকছেন তিনি।

কত দিন খেলবেন, গত সেপ্টেম্বরে এমন প্রশ্নের জবাবে ইব্রাহিমোভিচ বলেছিলেন, “যতদিন আমার চেয়ে শক্তিশালী কোনো খেলোয়াড়কে না দেখি।”

তেমন কেউ কি আসবেন কাতার বিশ্বকাপে?

মোহামেদ সালাহ

বাছাই পর্ব অদ্ভূত এক পরিস্থিতির সামনে ফেলেছিল। হয় সাদিও মানে নয়তো মোহাম্মদ সালাহ যাবেন বিশ্বকাপে। প্লে-অফে যে মুখোমুখি হয়েছিল দুই তারকার দল।

সেনেগালের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ভাঙে মিশরের। তার কিছু দিন আগে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে একইভাবে আফ্রিকান নেশন্স কাপের ফাইনালে হেরেছিল সালাহর দল।

বিশ্বকাপে যাওয়ার লড়াইয়ে টাইব্রেকারে গোল করতে ব্যর্থ হন লিভারপুলের তারকা স্ট্রাইকার সালাহ। অন্য দিকে তার এক সময়ের ক্লাব সতীর্থ মানের গোল সেনেগালকে তোলে বিশ্বকাপে।

সালাহর রোমাঞ্চকর ও আক্রমণাত্মক ফুটবল দেখা যাবে না বিশ্বকাপে। দুর্ভাগ্য, চোটের জন্য শেষ সময়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছেন মানে নিজেও।

আফ্রিকার সবচেয়ে উজ্জ্বল তারার দুটি জ্বলবে না এবারের বৈশ্বিক আসরে।

লুইস দিয়াস

লাতিন আমেরিকার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বাছাই পেরিয়ে কাতার যেতে পারেনি কলম্বিয়া। এর অর্থ রামাদেল ফালকাও, হামেস রদ্রিগেস, হুয়ান কুয়াদরাদো এবং তারকা হয়ে ওঠার পথে থাকা দিয়াসকে দেখা যাবে না বিশ্বকাপে।

পোর্তো থেকে লিভারপুলে যাওয়ার পর থেকে আলো ছড়াচ্ছেন দিয়াস। গতিময় এই ফুটবলার ভীতি ছড়াতে পারেন যে কোনো রক্ষণে। গোল করতে পারেন, করাতে পারেন। আকর্ষণ জাগানোর সকল সামর্থ্যই আছে তার।

বয়স কেবল ২৫। এখনও যথেষ্ট সময় আছে বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরার। কানাডা-যুক্তরাষ্ট-মেক্সিকো আসরে হয়তো তিনিই দলকে বিশ্বকাপে ফেরানোয় নেতৃত্ব দিতে পারেন।

কলম্বিয়াকে অসংখ্য ড্রয়ের মাশুল দিতে হয় বাছাইয়ে বাদ পড়ে। ১৮ ম্যাচে কেবল ২০ গোল করতে পেরেছিল দলটি। যেখানে শীর্ষ দল ব্রাজিল করেছিল ৪০ গোল।

ভিক্টর ওসিমহেন

নাপোলির হয়ে কী দুর্দান্ত সময়ই না কাটছে ওসিমহেনের। নাইজেরিয়ার হয়েও মেলে ধরছেন নিজেকে। বাছাইয়ের গ্রুপ পর্বে করেছেন চার গোল।

কিন্তু সব গড়বড় হয়ে যায় ঘানার বিপক্ষে লড়াইয়ে। প্রতিপক্ষের মাঠে গোলশূন্য ড্রয়ের পর দেশের মাটিতে ১-১ গোলে ড্র করে নাইজেরিয়া। প্রতিপক্ষের মাঠে গোলের সুবাদে এগিয়ে যায় ঘানা।

এই ব্যর্থতায় বড় ধাক্কা খান ওসিমেন। দুঃখ প্রকাশ করেন ভক্তদের কাছে।

“সবার আগে নাইজেরিয়ানদের কাছে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। প্রচুর মানুষ এখনও আমাদের সমর্থন করে। আমাদের যা করতে হবে তা হলো, তাদের শতভাগ সমর্থন ফেরাতে হবে। আমরা সঠিক পথেই আছি। নতুন কোচ ও টেকনিক্যাল স্টাফদের সঙ্গে ভালো করছি।”

“তবে সবাই ব্যথিত। কেউই খুশি নয়। এমনকি এখনও ব্যথাটা আছে এবং সব সময় থাকবে।” 

বয়স মোটে ২৩, তাই সব ঠিক থাকলে আবারও চেষ্টা করার সুযোগ তার সামনে থাকছেই।

রিয়াদ মাহরেজ

আলজেরিয়ার রিয়াদ মাহরেজের জাদুকরী ফুটবলও দেখা যাবে না কাতারে। লেস্টার সিটিতে আলো ছড়িয়ে এখন দারুণ সময় কাটাচ্ছেন ম্যানচেস্টার সিটিতে।

আলজেরিয়ার জন্যও তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাছাই পর্বে পাঁচ গোল করে ‘এ’ গ্রুপে দলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে রাখেন বড় ভূমিকা।

এরপর প্লে-অফে প্রথম রাউন্ডে ক্যামেরুনের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতে বিশ্বকাপে এক পা দিয়েই রেখেছিল আলজেরিয়া। কিন্তু ঘরের মাঠে পরের ম্যাচে ২-১ গোলে হেরে যায় তারা। প্রতিপক্ষের মাঠে বেশি গোলের সৌজন্যে কাতারে জায়গা করে নেয় ক্যামেরুন।

বয়স হয়ে গেছে ৩১। আর হয়তো একটি সুযোগ পেতে পারেন তিনি।

জানলুইজি দোন্নারুম্মা

ওয়েম্বলিতে কিছু দিন আগেও দোন্নারুম্মা ছিলেন নায়ক। ইউরো ২০২০ এর ফাইনালে গড়ে দিয়েছিলেন ব্যবধান। টাইব্রেকারে তার নৈপুণ্য ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ইতালি। কিন্তু গ্লাভস থেকে ফস্কে গেছে বিশ্বকাপের মূল পর্ব।

সুইজারল্যান্ডের পেছনে থেকে বাছাইয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হয় ইতালি। প্লে-অফ সেমি-ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ নর্থ মেসিডোনিয়া। এই দলটি গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে বাছাইয়েই শেষ করে দেয় ইতালির বিশ্বকাপ।

টানা দ্বিতীয়বার মূল পর্বে খেলছে না চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলটি। এক ঝাঁক তরুণ খেলোয়াড় আছে তাদের। যাদের কাঁধে ভর করে ২০২৬ আসর দিয়ে বিশ্বকাপে ফিরতে পারে ইতালি। এদের নেতৃত্ব দিতে পারেন আজকের ২৩ বছর বয়সী দোন্নারুম্মা।

লাতিন আমেরিকার কঠিন বাছাই পর্বে আটকে গেছে চিলি ও পেরু। কোস্টা রিকার বিপক্ষে আন্ত:মহাদেশীয় প্লে-অফে হেরে বাদ গেছে নিউ জিল্যান্ড। তাই ওশেনিয়া থেকে নেই কোনো প্রতিনিধি।