জন্মভূমির মুখোমুখি মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগি।
Published : 14 Dec 2022, 08:55 AM
কাতারে একের পর এক বিস্ময় আর অঘটনের জন্ম দেওয়া মরক্কো দলটি ঠাসা প্রবাসী সব খেলোয়াড়ে। আফ্রিকান দলটির ডাগআউটের নেতা ওয়ালিদ রেগরাগিও ফ্রান্স প্রবাসী। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, ফুটবলের দুনিয়ায় প্রবেশ-সবকিছুই ফ্রান্সের মাটিতে। তাই বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে ফ্রান্স ও মরক্কোর মুখোমুখি লড়াই হিচেম সায়াদির মতো অনেককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ‘আনুগত্যের পরীক্ষার’ সামনে।
প্যারিসের দক্ষিণের এক শহরতলিতে নিজের ক্রীড়া হল থেকে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন সায়াদি। এখান থেকেই মরক্কোর কোচ রেগরাগি ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন। ফরাসি-আলজেরিয়ান ২৯ বছর বয়সী সায়াদি অবশ্য শেষ পর্যন্ত মরক্কোকেই সমর্থন দেবেন।
“রেগরাগি এখানকার, আমরা যেখানে খেলি সেখানেই তিনি (রেগরাগি) খেলেছেন। আর বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে এটি (মরক্কো) আফ্রিকান দল... বিষয়টি ঐতিহাসিক। আবার কিলিয়ানের (এমবাপে) বিপক্ষে সমর্থন দিতে হবে, আমার জন্য খুব খুব কঠিন।”
৪৭ বছর বয়সী রেগরাগিকে মরক্কো কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় গত অগাস্টে, বিশ্বকাপ শুরুর তিন মাসেরও কম সময় আগে। তার জন্ম ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ৩০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের কোবেই-ইয়েসনে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। ফুটবলের হাতেখড়িও সেখানে।
আজাকসিও, দিজোঁসহ ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি ক্লাবে খেলেছেন তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মরক্কো জাতীয় দলের জার্সিতে খেলেছেন ৪৫ ম্যাচ।
তার কোচিংয়েই মরক্কো গড়েছে ইতিহাস। বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মতো দলকে হারিয়ে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে উঠেছে তারা।
সায়াদির মতো আফ্রিকান বংশোদ্ভূত অনেক ফরাসি বলছেন, তাদের হৃদয় যেন এখন ‘দোদুল্যমান।’ বুধবারের ম্যাচটি যে তাদের একাধিক পরিচয় আর খেলাধুলার আনুগত্যের বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে।
ফ্রান্স-মরক্কোর লড়াইয়ে ক্লাব সতীর্থ ও বন্ধুরাও মুখোমুখি হচ্ছে একে অন্যের। ফরাসি ফরোয়ার্ড এমবাপে ও মরক্কোর ডিফেন্ডার আশরাফ হাকিমি খেলেন পিএসজির হয়ে। ভালো বন্ধুও তারা। রেগরাগি ২০০৮ সালে গুহোনবলের হয়ে ফরাসি স্ট্রাইকার অলিভিয়ে জিরুদের সঙ্গে খেলেছেন।
ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে মরক্কো টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিয়েছে তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিকে। বিশ শতকে স্পেনের উপনিবেশ ছিল মরক্কো। এখনও দুটি ছিটমহল স্পেনের নিয়ন্ত্রণে আছে। মরক্কোর এবারের প্রতিপক্ষ যারা, সেই ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে তারা স্বাধীন হয় ১৯৫৬ সালে।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের মুখোমুখি হওয়ার আগে রেগরাগি অবশ্য বললেন, খেলার বাইরে অন্য কিছু তিনি ভাবতে চান না।
“আমি দ্বৈত নাগরিক (ফ্রান্স ও মরক্কোর)। ফ্রান্সের বিপক্ষে খেলতে পারাটা সম্মানের, একই সঙ্গে আনন্দেরও। কিন্তু এটা স্রেফ ফুটবল খেলা... আমি এখানে একজন ফুটবল কোচ হিসেবে এসেছি এবং আমার মূল লক্ষ্য জয়।”
কোবেই-ইয়েসনেতে ছোটবেলায় রেগরাগিকে যারা চিনতেন তারা বলছেন, ম্যাচ খেলার জন্য তিনি ট্রেনে করে যেতেন। যদিও তার সমবয়সীদের মধ্যে তিনি সেরা ছিলেন না, তবে সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
রেগরাগি যখন পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখন প্রায়ই তিনি আশেপাশের কিশোর-কিশোরীদের ক্লাবে নিয়ে যেতেন। যাদের মধ্যে সায়াদিও ছিলেন।
সেই ‘ঐতিহ্য’ রেগরাগি ধরে রেখেছেন বিশ্বকাপেও। তার মা এবং কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে কাতারের দোহায় নিয়ে এসেছেন তিনি।
ফ্রান্সে এখন অতি-ডানপন্থীদের ক্ষমতা বেড়েছে। তুলুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য ও নাগরিক স্বাধীনতার আইনি গবেষক রিম সালাহ মনে করেন, মরক্কো-ফ্রান্স ম্যাচটি অভিবাসী ফরাসি নাগরিকদের জন্য ‘আনুগত্যের পরীক্ষা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“(ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা) স্বীকার করেন না যে, ফ্রান্স বিকশিত হয়েছে এবং একটি নতুন প্রজন্ম আছে যারা তাদের একাধিক পরিচয়ে আত্মবিশ্বাসী।”
মঁকনসেইলের ২০ বছর বয়সী ফয়সিল আচৌচে বলছেন, অনেক টুর্নামেন্টে তিনি ফ্রান্সকে সমর্থন করেছেন এবং এখন তার আরেক দেশ মরক্কোকে সমর্থন করতে চান।
"ফ্রান্সের জয় দেখার আবেগ কেমন, আমি জানি। এখন মরক্কো বিশ্বকাপে, আমরা তাই তাদের সমর্থন করতে পারি।”