আবাহনী লিমিটেড ক্লাবের অফিস ভবনের সবকিছু লুট করে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা; বাদ যায়নি প্রায় ৫২ বছর ধরে অর্জিত ক্লাবটির সাফল্যের স্মারক কোনো ট্রফি।
Published : 10 Aug 2024, 07:03 PM
মূল ফটক তালাবদ্ধ। বাইরে থেকেই স্পষ্ট, গত সপ্তাহে হওয়া ভাংচুরের দৃশ্য। ফটকে বসে থাকা নিরাপত্তাকর্মীর অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, জড়ো করে রাখা কিছু আসবাবপত্র। আরও সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের আগুনে পোড়া প্রতিকৃতি। অফিসের প্রতিটি কক্ষে ভাংচুর ও লুটপাটের ছাপ।
আবাহনী ক্লাবের শনিবারের দুপুরের চিত্র ঠিক এমনই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর লুটপাটের শিকার হয় দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। অস্থায়ী ভবনের ৮টি কক্ষের প্রতিটিতে ভাংচুর করা হয়। নগদ অর্থের পাশাপাশি লুট করা হয় ক্লাবের ৫২ বছরের অর্জনের সব স্মারক ট্রফি। ভাংচুর, লুটপাট হয় শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবেও।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সোমবার বিকেল ৫টার পর অজ্ঞাত প্রায় তিনশ-চারশ বিক্ষোভকারী এসে চড়াও হয় অস্থায়ী অফিস ভবনে। তখন সেখানে থাকা ক্লাবের এক গোলরক্ষক চেষ্টা করেন তাদের থামাতে। প্রথমে তার অনুরোধে বিক্ষোভকারীরা সাড়া দিলেও, পরে আরেকটি মিছিল এসে লুটপাট চালায়।
আবাহনী ক্লাবের পুরোনো ভবন ভেঙে চলছে ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতার নামে শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ। বাহ্যিক কাঠামো দাঁড়িয়ে যাওয়া কমপ্লেক্সটি অক্ষত রয়েছে। মুছে দেওয়া হয়েছে নামফলক। খেলোয়াড়দের থাকার ২০ কক্ষের একতলায় ভবনে অবশ্য কোনো ভাংচুর হয়নি।
মূল ফটক বরাবর থাকা আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এতে অর্ধেকের বেশি পুড়ে গেছে প্রতিকৃতি। এছাড়া অফিস ভবনে ঢুকে প্রতিটি কক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, ল্যাপটপ, কম্পিউটার- সব কিছুই লুট হয়ে গেছে। অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র তছনছ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বাদ যায়নি ট্রফি রাখার কক্ষটিও। প্রায় ৫২ বছর ধরে ক্লাবের যত অর্জন ও ট্রফি ছিল, সবগুলো নিয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা। এত মানুষের সামনে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না সেখানে উপস্থিত থাকা অন্তত তিনজন সাবেক জাতীয় ফুটবলার, ক্রিকেট দলের ম্যানেজার শেখ মামুন, ফুটবলে দলের কোচিং স্টাফের সঙ্গী মোহাম্মদ নেহাল, ক্লাবের প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো কর্মী রফিকুল ইসলামদের।
সেদিনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না নেহাল। শনিবার খেলোয়াড়দের থাকার এক তলা ভবনে কিছু কাজ সেরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে কান্না জড়িত কণ্ঠেই সেই হামলা ও ভাংচুরের কথা বলেন তিনি।
“কী বলব? চোখের সামনে যা কিছু দেখেছি, বিশ্বাস করার মতো না আসলে। শো-কেস থেকে কাপগুলো নিয়ে যাচ্ছে। লাইট, ফ্যান পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে। এখনও ভাবতে পারছি না কীভাবে এমন হয়ে গেল।”
লুটপাটের শেষ দিকে ক্লাবে উপস্থিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা। তাদের বাধার মুখে অফিস ভবনের কিছু জিনিসপত্র রেখে যেতে বাধ্য হয় বিক্ষোভকারীরা। সেগুলো এখনও জড়ো হয়ে পড়ে আছে ক্লাবের অফিস ভবনের বাইরে।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ক্লাবের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির একটা ধারণা দেন ক্রিকেট দলের ম্যানেজার শেখ মামুন।
“আমার নিজের কিছু টাকা ছিল একটা আলমারিতে। কয়েকজন খেলোয়াড়ের টাকা ছিল। এর বাইরে ক্লাবের ফান্ডের প্রায় ৭ লাখ টাকার মতো ছিল। এছাড়া ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, এসি, বাতি, পাখা; সবই তো নিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ১০ লাখ টাকার কম হবে না। আরও বেশিই হবে হয়তো। ক্লাবের কাগজপত্রও কিছু রাখেনি। সবই নিয়ে গেছে।”
তবে আর্থিক ক্ষতি নিয়ে ভাবতে চান না আবাহনীর ক্রিকেট ম্যানেজার। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির দীর্ঘ দিনের অর্জন ও সাফল্যের স্মারক হিসেবে থাকা ট্রফিগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান তিনি।
“ক্লাব লুটপাট হয়েছে, ভাংচুর হয়েছে, টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে। এসব নিয়ে আফসোস নেই। কিন্তু আমাদের ট্রফির ঘরটা তো দেখেছেন? একটা ট্রফিও বাকি রাখেনি। সবগুলো নিয়ে গেছে। ক্লাবের ৫০ (আসলে ৫২) বছরের সব অর্জন ছিল সেখানে। আমি শুধু এই ট্রফিগুলো ফেরত চাই। যারাই নিয়েছে, তারা যদি ফিরিয়ে দিত... জানি না আদৌ এগুলো ফেরত পাওয়া যাবে কিনা না।”
সে দিন ক্লাবেই ছিলেন মামুন। প্রতিহত করার চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। উল্টো বিক্ষোভকারীদের মারধরে গলায় ও ঊরুতে আঘাত পান তিনি। গত কয়েক দিনে সুস্থ হয়ে ওঠা ক্লাবটির সাবেক ফুটবলার নিয়মিতই যান প্রিয় আঙিনায়। ধ্বংসস্তূপের মাঝে আবার মাথা উঁচু করে ওঠার আশা তার।
“আমি চেষ্টা করেছিলাম ঠেকাতে। কিন্তু এত লোক এসেছিল, আটকানো সম্ভব ছিল না। তারা আমাকেও মারধর করে। এখন সুস্থ আছি। প্রতিদিনই ক্লাবে যাই। আশায় আছি, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো সময় লাগবে। এর আগেও তো আমরা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। তখনও ক্লাব চলেছে। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এবারও আশা করি, আবার সব সুন্দর হবে।”
“এখন হয়তো আর্থিক দিক থেকে কিছুটা চাপে থাকব। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক বেশি দিতে পারব না আমরা। দলও হয়তো অত বড় বাজেটের হবে না। তবে আমরা ঘুরে দাঁড়াব।”