শিরোপা উৎসবের জোয়ারে ভাসছে নেপলস

৩৩ বছরের খরা ঘুচিয়ে নাপোলির সেরি আ শিরোপা জয়ে গোটা শহরে বইছে আনন্দের বন্যা, না থেকেও এই উৎসবে প্রবলভাবে মিশে আছেন নাপোলির রূপকথার নায়ক দিয়েগো মারাদোনা।

স্পোর্টস ডেস্ক
Published : 5 May 2023, 05:32 AM
Updated : 5 May 2023, 05:32 AM

দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকে আগেই আতশবাজি নিষিদ্ধ করেছিল পুলিশ। কিন্তু এমন রাতে সেসব বাধায় কান দেয় কজন! খেলা শেষ হতেই আতশবাজির আলোয় উদ্ভাসিত হলো নেপলসের রাতের আকাশ। ম্যাচটি ছিল উদিনেসের মাঠে। তবে শেষ বাঁশি বাজার পর উদিনে শহর থেকে উচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়ল ৮০০ কিলোমিটার দূরে নেপলসে। চারপাশ প্রকম্পিত করে বাজি পুড়তে থাকল, রাতের আকাশে দেখা গেল রঙের খেলা। মানুষের চিৎকার, গান আর স্লোগান মিলিয়ে নেপলস যেন উৎসবের নগরী। সমর্থকদের হাসি, উল্লাস আর আনন্দের কান্না যেখানে মিলেমিশে একাকার।

তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল নেপলসবাসী। ইতালির ফুটবলে মিলান-তুরিনের মতো অভিজাত শহরের ক্লাবদের দাপটে বরাবরই কোণঠাসা নাপোলিকে সেই আশির দশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলেন দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা নামের এক রূপকথার নায়ক। অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে দলকে উপহার দিয়েছিলেন ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০ সেরি আ শিরোপা। তারপর থেকেই আরেকটি শিরোপার অপেক্ষায় ছিল এই ক্লাব, এই শহর আর সমর্থকদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

অবশেষে ৩৩ বছরের সেই খরা ঘুচে গেল এবার। উদিনেসের মাঠে বৃহস্পতিবার ১-১ গোলে ড্র করে ৫ ম্যাচ বাকি থাকতেই নাপোলি নিশ্চিত করল শিরোপা। নেপলস এখন আনন্দনগরী!

উদিনেসের মাঠে দলের শিরোপা জয়ের স্বাক্ষী ছিলেন ১১ হাজার দর্শক। মাঠের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন আরও হাজার পাঁচেক। ম্যাচ শেষে দর্শকের অনেকে মাঠে ঢুকে যান। কোচ-ফুটবলারদের সঙ্গে মিলে যোগ দেন শিরোপার উৎসবে। সেখানে প্রতিপক্ষ সমর্থকদের সঙ্গে দাঙ্গার ঘটনাও ঘটে, হস্তক্ষেপ করতে হয় পুলিশকে। তবে আসল উৎসব তো নেপলসে।

খেলা প্রতিপক্ষের মাঠে হলেও নিজেদের মাঠ দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা স্টেডিয়ামে সব আয়োজনই ছিল। ৫০ হাজার দর্শকে ঠাসা গ্যালারি খেলা উপভোগ করে ৮টি বড় পর্দায়। খেলা শেষ হওয়ার পরই শুরু হয় উদযাপন।

মাঠে থাকা সমর্থকদের একজন, রাফায়েলে মানফ্রেদোনিয়া রয়টার্সকে বলেন, “আজকেই সেই দিন, সবচেয়ে উপযুক্ত দিন…”, আরেক সমর্থক রবের্তো সান্তোনিয়েলো চিৎকার করে বলেন, “ইয়েস… আমরাই চ্যাম্পিয়ন।” গোটা নেপলসবাসীর উচ্ছ্বাস আর অনুভূতি ফুটে ওঠে যেন আরেক দর্শক কেভিনের কণ্ঠে, “বিশৃঙ্খলা হবে, গণ্ডগোল হবে, যা ইচ্ছা করব আমরা। আজকে রাতে আমরা ঘুমাব না, কোনো কাজ করব না…।”

ফুটবল তো আসলে স্রেফ মাঠের খেলাই নয়। প্রতিনিয়তই তা স্পর্শ করে জীবনের সীমানা। তাই স্রেফ ফুটবল অনুরাগী বা সমর্থকেরাই নয়, সাফল্যের এই ছোঁয়ার প্রাণবন্ত গোটা নগরীই। শিরোপা সুবাস পেয়ে শহরের বাড়িতে বাড়িতে ক্লাবের পতাকা উড়ছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। দেয়ালে দেয়ালে, রাস্তার মোড়ে ফুটবল নায়কের ছবি, ব্যানার, ফেস্টুন তো আছেই।

শহরের বাস, ট্রাম, ট্রেনে আঁকা হয়ে গেছে "Campioni D'Italia 2022/23" (চ্যাম্পিয়ন অব ইতালি)। এমনকি কেক, পিৎজা, দোকানে দোকানে খাবারের প্যাকেট, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রবের প্যাকেট, সবকিছুতেই লেখা লেখা বা আঁকা থাকছে "Campioni D'Italia 2022/23".

দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলার শঙ্কায় আতশবাজির মতো নিষিদ্ধ করা হয় সিটি সেন্টারে গাড়ী ও বাইকের র‌্যালিও। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা ভাঙতেও দেখা গেছে অনেককে।

এই উৎসবে অবধারিতভাবেই উপস্থিতি মারাদোনার। পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি আড়াই বছর আগে। তবে নেপলসে তো প্রবলভাবে জীবন্ত প্রতিটি দিনই। এবারের এই উল্লাসের জোয়ারে তো তিনি থাকবেনই! সমর্থকদের হাতে হাতে মারাদোনার ছবি, পোস্টার, ব্যানার। এই শহরে তিনি অমর।

এই উৎসবের প্রস্তুতি চলছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। শিরোপার সুবাস পাচ্ছিলেন তারা যে বেশ আগে থেকেই! মৌসুম শুরুর আগে যদিও আগের অনেক বছরের মতোই নাপোলিকে নিয়ে আশা খুব বেশি ছিল না তেমন কারও।  বিশেষ করে ক্লাবের বড় তারকা লরেন্সো ইনসিনিয়ে, রেকর্ড গোলস্কোরার ড্রিস মের্টেন্স ও ডিফেন্সের মহীরূহ কালিদু কলিবালি ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার পর বাজে কিছুর আশঙ্কাই ছিল। তবে মৌসুমের শুরু থেকেই তারা চমকপ্রদ পথচলায় ছুটতে থাকে। মৌসুমের প্রথম ১৫ ম্যাচেই ক্লাবটি ছিল অপরাজিত, এর মধ্যে ছিল টানা ১১ ম্যাচে জয়ের ধারাও!

প্রথম হারের স্বাদ পায় তারা ইন্টার মিলানের মাঠে। তবে এরপরই আবার ৮ ম্যাচের অপরাজেয় ধারা। শীর্ষে তাদের অবস্থান সংহত তখন দুইয়ে থাকা দলের চেয়ে ১৮ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে। শেষ দিকে এসে অবশ্য কিছুটা হোঁচট খেতে হয় তাদের। এপ্রিলে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৭ ম্যাচে স্রেফ ২টি জয় ধরা দেয় তাদের। এর মধ্যে ছিটকে পড়তে হয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকেও।

তবে লিগে আগেই তারা কাজ এতটা এগিয়ে রেখেছিল যে, পরে আর ঝামেলা হয়নি। গত রোববারই তারা শিরোপা উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু সেদিন শেষ দিকে গোল হজম করে অপেক্ষা বাড়ে একটু। উদিনেসের বিপক্ষে এই ম্যাচেও কিছুটা শঙ্কা জেগেছিল আগে গোল হজম করে। তবে অসাধারণ পারফরম্যান্সে এই শিরোপা জয়ের মূল নায়ক যিনি, সেই ভিক্টর ওসিমহেন আরও একবার দলকে উল্লাসের উপলক্ষ এনে দেন সমতা ফেরানো গোল করে, যেটি শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় শিরোপা নিশ্চিত করা গোল।

এই সাফল্যের নেপথ্য নায়ক কোচ লুসিয়ানো স্পাল্লেত্তি শিরোপা জয়ের পর ধরে রাখতে পারেননি আবেগ। কান্নাভেজা চোখ ও ধরে আসা কন্ঠে তিনি শিরোপা উৎসর্গ করেন নেপলসবাসীকে।

“মানুষের মুখের হাসি ও এই খুশিই আমার সবচেয়ে আবেগের জায়গা। এই শিরোপা নাপোলির জন্য, আপনাদের জন্য। অনেক অনেক মানুষ তাদের জীবনের কঠিন সময়কে জয় করতে পারবে, কারণ তারা আজকের দিনটি মনে রাখবে। এমন আনন্দ আর উল্লাস এই মানুষগুলোর প্রাপ্য।”

নেপলসের মাঠে শিরোপা জয়ের উৎসবে সমর্থকদের সঙ্গে যোগ দিলেন ক্লাব প্রেসিডেন্ট অরেলিও দে লাউরেন্তিস ও নেপলসের মেয়র গাইতানো মানফ্রেদি। পরস্পরকে জড়িয়ে উল্লাসে মাতেন তারা।

২০০৪ সালে যখন ক্লাবের দায়িত্ব নেন দে লাউরেন্তিস, ক্লাব তখন দেউলিয়া। তৃতীয় বিভাগ থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে তারা। সেই ক্লাব আজ সেরি আ চ্যাম্পিয়ন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মধুর প্রাপ্তির তৃপ্তি তার কণ্ঠে।

“আপনারা বলেছিলেন, ‘আমরা জিততে চাই’, দেখুন, আজকে আমরা জিতেছি। আমরা সবাই একসঙ্গে জিতেছি। ৩৩ বছর ধরে চলে আসা স্বপ্নের বাস্তবায়নের সময় এটি। লম্বা সময়ের প্রক্রিয়া। কিন্তু আমরা পেরেছি।”