কেবল ঈদ উৎসব ঘিরে নয় বছরজুড়ে ব্যবসার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার তাগিদ দিয়েছেন হল মালিক এবং প্রদর্শক সমিতির হর্তাকর্তারা।
Published : 15 Apr 2025, 01:28 AM
ঢালাও মুক্তিতে লাগাম টেনে এবারের রোজার ঈদে ছয়টি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে আসায় যে পরিমাণ টিকেট বিক্রি হয়েছে তাতে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন প্রেক্ষাগৃহের মালিকরা। বহু দর্শক ছয়টির মধ্যে চারটি সিনেমা দেখছেন।
সিনেমা মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহেও ঢাকায় যেসব দর্শক অগ্রিম টিকেট কেটেছিলেন, তারাই কেবল সিনেমা দেখতে পেরেছেন। টিকেট না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে অনেককে।
তবে সারাবছর সিনেমা দেখিয়ে যা আয়-রোজগার, তাতে হতাশাই বেশি প্রযোজকদের। দেশে ‘বক্স অফিস’ পদ্ধতি না থাকায় প্রকৃত আয়ের হিসাবও পাচ্ছেন না তারা।
ব্যবসায়িক সাফল্য ধরে রাখতে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন, নির্ভরযোগ্য বণ্টনব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামো চান তারা।
অপরদিকে ঈদে ‘ভালো ব্যবসা’ হলেও ‘মৌসুমি’ এই সাফল্য দিয়ে সারাবছরের লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না বলে জানিয়েছেন হল মালিকরা।
ঈদ ঘিরে ব্যবসার যে সাফল্য, তার ধারাবাহিকতা বছরজুড়ে ধরে রাখার তাগিদ দিয়েছেন হল মালিক এবং প্রদর্শক সমিতির কর্তারা।
ঈদে প্রেক্ষাগৃহে এসেছে ছয়টি সিনেমা। সিনেমাগুলো হল মেহেদী হাসান হৃদয় পরিচালিত ‘বরবাদ’, ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘অন্তরাত্মা’, এম রহিমের ‘জংলি’, শিহাব শাহীনের পরিচালনায় ‘দাগি’, কামরুজ্জামান রোমানের ‘জ্বীন ৩’ এবং শরাফ আহমেদ জীবনের ‘চক্কর’।
এর মধ্যে ‘বরবাদ’ ও ‘অন্তরাত্মা’ ঢাকাই সিনেমার সুপারস্টার শাকিব খানের। এছাড়া মোশাররফ করিম, আফরান নিশো, সিয়াম আহমেদ, তমা মির্জা, শবনম বুবলী ও নুসরাত ফারিয়াকে পাওয়া গেছে বাকিগুলোয়।
এগুলোর মধ্যে ‘দর্শক আগ্রহ না থাকায়’ সিনেপ্লেক্স থেকে ‘অন্তরাত্মা’ নামিয়ে ফেলা হয় ঈদের দ্বিতীয় দিনই। ব্যবসা করতে না পারায় মুক্তির ১২ দিনের মাথায় ‘জ্বীন ৩’ সিনেমাটি স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে নিয়েছে। দেশের অন্য কোনো প্রেক্ষাগৃহেও সিনেমাটি আর চলেনি।
ঈদের পর দুই সপ্তাহ ধরে যেহেতু প্রেক্ষাগৃহে আছে, তাই শাকিবের ‘বরবাদ’, নিশোর ‘দাগি’ এবং সিয়াম আহমেদের ‘জংলি’ এই ৩টি সিনেমাকে ‘ব্যবসা সফল’ বলছেন হল মালিকরা। এছাড়া মোশাররফ করিমের ‘চক্কর’ চলছে শুধু স্টার সিনেপ্লেক্সে।
দর্শক বাড়ায় খুশি হল মালিকরা
‘বরবাদ’ সিনেমা দিয়ে চার মাস বন্ধ থাকার পর ঈদের দিন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা সিনেমা হলের দুয়ার খোলে।
মধুমিতার কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ গ্লিটজকে বলেন, “ভালো চলছে, এটা মনে হয় সর্বোচ্চ বিক্রি সিনেমা হবে। ‘তুফান’, ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার সব বিক্রিকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রচুর দর্শক হচ্ছে।”
ঈদের দিন থেকে স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পায় ৬টি সিনেমা। ‘অন্তরাত্মা’ ও ‘জ্বীন ৩’ না চলায় সেখানে চলছে ৪টি সিনেমা।
মুক্তির প্রথম সপ্তাহ থেকেই ‘দাগি’র শো বেড়েছে। এছাড়াও ‘অন্তরাত্মা’ ও ‘জ্বীন ৩’ নামিয়ে সেই জায়গায় ‘দর্শক চাহিদা থাকা সিনেমাগুলোর’ শো বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্টার সিনেপ্লেক্সের মিডিয়া অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন।
তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় সপ্তাহে স্টার সিনেপ্লেক্সে ৪ সিনেমা চলছে। সেগুলোর মধ্যে ‘বরবাদ’ সিনেমার শো চলছে ৩৯টি, ‘দাগি’র ৩০টি, ‘জংলি’ ১৩টি, এবং ‘চক্কর’ সিনেমার ৪টি শো চলছে।
টিকেট বিক্রি নিয়ে মেসবাহ উদ্দিন গ্লিটজকে বলেন, “‘বরবাদ’ সিনেমার চাহিদা বেশি। শো হাউসফুল যাচ্ছে। দর্শক টিকেট না পেয়ে ফেরত যাচ্ছে, অগ্রিম টিকেট বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসা ভালো চলছে।”
লায়ন সিনেমা হলে শুক্রবার থেকে চলছে ‘বরবাদ’, ‘জংলি’ ও ‘দাগি’।
এই প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেক গ্লিটজকে বলেন, “‘বরবাদ’ খুবই ভালো যাচ্ছে। শুক্রবার রাতে তিনটি স্পেশাল শো চালানো হয়েছে। বাকি দুই সিনেমাও হাউসফুল যাচ্ছে।”
ঈদের দিন থেকে পরের ১০ দিনে টিকেট বিক্রির সংখ্যা কেমন প্রশ্নে খালেক বলেন, “বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টিকেট বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার ৬৭৭টি, এর মধ্যে বরবাদের টিকেট বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজারের মত।
“আট হাজারের মত টিকিট বিক্রি হয়েছে অন্য সিনেমার।”
শাকিবের গত ঈদের সিনেমা ‘তুফান’র টিকেট বিক্রিকে ছাড়িয়ে যাবে ‘বরবাদ’, মনে করেন তিনি।
ঢাকার ‘শ্যামলী’ সিনেমা হলে চলছে ‘বরবাদ’। প্রথম দিকে সবকটি শোয়ে ‘বরবাদ’ ভালো চললেও দ্বিতীয় সপ্তাহে সকাল ও দুপুরের শোতে দর্শক কিছুটা কম হয়েছে। তারপরেও গেলবারের তুলনায় এবার ব্যবসা ভালো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হলের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হাসান।
তিনি বলেন, “আমাদের এখানে চারটি শো চলছে, এর মধ্যে বেলা ১২টা এবং দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের শোতে দর্শক কম হচ্ছে। বাকি দুইটা শো হাউসফুল যাচ্ছে। গত বছরগুলোর তুলনায় এই ঈদে ভালো দর্শক আসছে। অগ্রিম টিকেট বিক্রি হচ্ছে, আমাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছে।”
সিনেমা চলেছে মধ্যরাতেও
দর্শকদের ‘চাপ সামলাতে’ মধ্যরাতে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে শাকিবের ‘বরবাদ’ সিনেমার। এই বিশেষ শো হয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমাস ও বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সে।
মধুবনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোকনুজ্জামান ইউনূস বলেন, “আমাদের এখানে শুরু থেকেই সিনেমাটি ভালো চলেছে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার টিকেট বিক্রি হয়েছে। দর্শকের অনুরোধে আমরা রাতে বিশেষ শো চালিয়েছি। ঈদের দ্বিতীয় দিন রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে আমাদের শো চলেছে। শুক্রবার রাতেও বিশেষ শো চলেছে।
“তাছাড়া আমাদের সকাল ১০টায় শো ছিল না, দর্শকের বিপুল আগ্রহ ও চাহিদার কারণে ১০টায় শো চালু করেছি। শো ফুল গেছে। আশা করছি পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত শো হাউসফুল যাবে।”
মুদ্রার উল্টোপিঠ
ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহগুলোতেও দর্শকরা হলমুখী হওয়ায় ‘ব্যবসা ভালো’ চলছে বলে জানিয়েছেন হল মালিকরা। যশোরের ‘মণিহার’ সিনেমা হলে চলছে ‘বরবাদ’ এবং মণিহার সিনেপ্লেক্সে চলছে ‘দাগি’।
‘ব্যবসা ভালো যাচ্ছে’ জানিয়ে হলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিয়াউল ইসলাম গ্লিটজকে বলেন, “মণিহারে ১২০০ আসন হাউসফুল না গেলেও কাছাকাছি ছিল। ‘বরবাদ’ মানুষ পছন্দ করছে, যার জন্য আমরাও একটু লাভবান হচ্ছি। আমাদের মাল্টিপ্লেক্সে ‘দাগি’ সিনেমাও ভালো চলছে। ৬৬ আসন হাউসফুল যাচ্ছে।”
হলে আগের থেকে ‘দর্শক বেড়েছে’ জানিয়ে এই হল মালিক বলেন, “এবারের সিনেমা দেখে বুঝা গেল ভালো সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শক হলমুখী হন। আমাদের ভালো সিনেমা দরকার।”
খুলনার ‘সংগীতা’ সিনেমা হলে চলছে ‘জংলি’।
হলের বুকিং এজেন্ট মো. আসাদ্দুজামান টুটুল বললেন, ‘জংলি’ ভালো চলছে।
“১২ দিনে বেশ ভালো দর্শক হয়েছে। আমাদের খুলনা শহরে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রায় সব সিনেমাগুলোই চলছে। সেই জায়গা থেকে ‘জংলি’ সিনেমার প্রায় তিন থেকে চার লাখ টাকার টিকেট বিক্রি হয়েছে।”
আছে হতাশার চিত্রও। বরিশালে আগে পাঁচটি সিনেমা হল থাকলেও এখন কেবল টিকে আছে ‘অভিরুচি’ নামের একটি মাত্র হল। সেখানে এই ঈদে ‘বরবাদ’ চলছে।
এই হলের ব্যবস্থাপক রেজাউল কবীর জানিয়েছেন, ব্যবসা ভালো চলছে, দর্শকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। তবে সাফল্যের পাশাপাশি আক্ষেপের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
তার ভাষ্য, “এতদিন বলতাম হলে দর্শক আসে না, এখন থেকে এটা বলার সুযোগ নেই। এখন বলব সিনেমা নাই, কারণ ‘বরবাদ’ চলছে, ‘তুফান’ চলেছে, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’, ‘প্রিয়তমার’ সময় তো দর্শক পাওয়া যাচ্ছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজকদের বলব আমাদের নিয়মিত সিনেমা দিন। দর্শকের রুচি বোঝে সিনেমা তৈরি করুন।”
দুই ঈদ ছাড়া বছরের অন্য সময়ে ‘ভালো সিনেমা আসে না’ জানিয়ে রেজাউল কবীর বলেছেন, দুই চারজন মানুষ নিয়ে তার হল চালু রাখতে হয় বাকি সময়ে।
‘অভিরুচির’ অবস্থাও ‘নিভু নিভু’ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদেরটাও বন্ধ হয়ে যাবে যেকোনো সময়। ভালো সিনেমা না থাকলে হল থাকবে কী করে? ‘বরবাদ’ চালানোর পর চিন্তা করতে হচ্ছে কোরবানি পর্যন্ত কী সিনেমা চালাব।”
আক্ষেপ করে এই হল মালিক গ্লিটজকে বলেন, “সারা বছর সিনেমা হল কেমন চলছে, আছে নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- এই খোঁজটাও কেউ নেয় না। চলচ্চিত্রের সব উন্নয়ন এফডিসিকেন্দ্রিক। একসময় দেখা যাবে প্রযোজকদেরও সিনেমা তৈরি করে মুক্তির জন্য হলও তৈরি করতে হবে। তাই এক ঈদ সিনেমা ভালো চলেছে এই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার চেয়ে এই ভালো চলা নিয়মিত হওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”
নারায়ণগঞ্জের ‘নিউ মেট্রো’ সিনেমা হলে চলছে ‘বরবাদ’। মুক্তির পর কিছুদিন ভালো চললেও এখন দর্শকখরায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন হলের কর্মী রবি বাবু।
বাবু বলেন, “এখানে সিনেমার চার শো চলছে, তবে হাউসফুল হচ্ছে না। প্রথম তিন চারদিন ভালো ছিল। শুক্রবারও দর্শক নেই।”
অগ্রিম টিকেট কাটলেই দেখা যাচ্ছে সিনেমা
সিনেমা মুক্তির দশদিন পেরিয়েও এবারে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে দর্শকের ভিড় দেখা গেছে। তবে আগে থেকে যারা টিকেট কেটে রেখেছেন তারাই সিনেমা দেখতে পারছেন। হলে এসে টিকেট না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে অনেককে।
২৫ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করেন মাহবুব জুয়েল। তবে কখনো হলে গিয়ে সিনেমা দেখা হয়নি তার। এবারই প্রথম ‘বরবাদ’ সিনেমা দেখতে উত্তরায় স্টার সিনেপ্লেক্সের নতুন শাখায় আসেন তিনি।
সিনেমা কেমন লেগেছে প্রশ্নে জুয়েল বলেন, “বেশ ভালো লেগেছে। গল্পটা ভালো। নির্মাণও সুন্দর হয়েছে। গল্পের গভীরতা, গান সব মিলিয়ে এন্টারটেইনমেন্টমূলক সিনেমা।”
বন্ধুদের নিয়ে ‘জংলি’ সিনেমা দেখতে আসা ফাহিম টিকেটে কেটেছেন আগে।
ফাহিম বলেন, "আমরা সাতজন বন্ধু একসঙ্গে এসেছি মগবাজার থেকে। সিনেমা ভালো লেগেছে, সিয়াম আহমেদ দারুণ করেছেন। খুব ইমোশনাল একটি সিনেমা।"
শনির আখড়া থেকে স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখতে এসে টিকেট পাননি আমিনুল।
তিনি বলেন, "কাউন্টারে এসে শুনি টিকেট নাই, আগে থেকে যারা কেটে রেখেছেন তারাই সিনেমা দেখতে পারছেন।"
ঈদে ‘দাগি’ ও ‘চক্কর’ দুইটি সিনেমা দেখেছেন রাব্বি নামের এক তরুণ।
তিনি বলেন, "এবার ঈদে মুক্তি পাওয়া সবগুলো সিনেমাই দেখার মত, অন্তত তিন-চারটা সিনেমা তো দেখতে হবেই। এরইমধ্যে 'দাগি’ ও ‘চক্কর’ দেখেছি। দুটি সিনেমা দেখেই আনন্দ পেয়েছি। অভিনয়, গল্প, সংলাপ সবকিছু সুন্দর।"
টিকেটের দাম কোথায় কেমন
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সিনেমার টিকেট দামে তারতম্য আছে। ঢাকার মধ্যেও দামের পার্থক্য আছে। মধুমিতা সিনেমা হলে ডিসি শাখায় টিকেটের দাম ২৫০ এবং রিয়াল শাখায় ২০০ টাকা করে।
ঢাকার লায়ন সিনেমা হলে দুই ক্যাটাগরির টিকেট পাওয়া যায়। প্রিমিয়াম টিকেটের দাম সাড়ে ৩০০ টাকা এবং রেগুলার টিকেটের দাম ৩০০ টাকা।
স্টার সিনেপ্লেক্সের বিভিন্ন শাখায় টিকেটের দাম ভিন্ন। হল অনুযায়ী কয়েক ক্যাটাগরির টিকেট পাওয়া যায়, যা ৪০০ থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ১৮০০ টাকা পর্যন্ত রাখা হয় টিকেটের দাম।
যশোরের মণিহার সিনেমা হলে টিকেটের দাম ২১০ টাকা এবং মণিহার সিনেপ্লেক্সে টিকেটের দাম ২৬০ টাকা।
বগুড়ার মধুবন সিনেপ্লেক্সে তিন ক্যাটাগরির টিকেট পাওয়া যায়। গোল্ড ৩০০ টাকা, প্রিমিয়াম টিকেটের দাম ২০০ টাকা, এবং স্ট্যান্ডার্ড টিকেটের দাম ১০০ টাকা।
প্রযোজকবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলার তাগিদ
সিনেমার এই সাফল্যের মধ্যেও হতাশা প্রকাশ করেছেন ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার প্রযোজকরা। ই-টিকেটং, বক্স অফিস বা সিনেমা হলের সঠিক অবকাঠামো না থাকায় লগ্নি তুলতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে বলে ভাষ্য তাদের।
'বরবাদ’ ঈদে মুক্তি পেয়েছে ১২০টি প্রেক্ষাগৃহে। এই সিনেমার ব্যবসা কেমন হচ্ছে প্রশ্নে সিনেমার প্রযোজক শাহরিন আক্তার সুমী জানিয়েছেন, সিনেমার এক সপ্তাহের ‘গ্রস কালেকশন’ সারা দেশ থেকে ২৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। তবে প্রযোজকের ঘরে হিসেবে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকাও যায়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
সুমী গ্লিটজকে বলেন, “সিনেমা ভালো চলছে, দর্শক ফিরেছে, কিন্তু আমরা প্রযোজকরা সত্যিকার অর্থে কতটা আয় করছি তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একেকটি টিকিটের দাম থেকে নানা রকম কমিশন কেটে আমাদের হাতে আসে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এর মধ্যে থাকে হল মালিক, এজেন্ট ও অন্যান্য খরচ। সবচেয়ে বড় সংকট হলো, দেশে কোনো বক্স অফিস রিপোর্টিং সিস্টেম নেই। ফলে কেউই জানে না প্রকৃত আয় কত।"
এই অনিশ্চয়তা প্রযোজকদের ‘নিরুৎসাহিত করছে’ জানিয়ে সুমী বলেন, "এখানে পোস্টার, ব্যানার প্রিন্ট করাও এখন প্রযোজকের দায়িত্ব। এমনকি যারা লাখ লাখ টাকা আয় করছেন, তারাও এসব খরচ নিজেরা নিতে চান না। আমরা যদি সিনেমা শেষ হওয়া পর্যন্ত ১৫ কোটি টাকা বাজেট ধরি সিনেমা মুক্তির পর অন্য খরচ বাবদ সেটা কিন্তু বাড়ছে। দিন শেষে আমরা প্রযোজকবান্ধব সিস্টেম পাচ্ছি না। আমরা স্বচ্ছভাবে জানতে পারছি না আমাদের সিনেমার বিক্রি কেমন হচ্ছে।”
সরকার ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রতি এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়ে এই প্রযোজক বলেন, “একটা দীর্ঘমেয়াদী, প্রযোজকবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা হোক, যাতে সবাই টিকে থাকতে পারে এবং ভালো সিনেমা বানাতে পারে।”
‘দাগি’ সিনেমার কেমন ব্যবসা হয়েছে জানতে চাইলে সিনেমার প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল গ্লিটজকে বলেন, “আমাদের সিনেমার কেমন দর্শক হয়েছে, কেমন টিকিট বিক্রি হয়েছে বাংলাদেশে সেই হিসাব বলা খুব খুব মুশকিল। এখানে ই টিকেটিং সিস্টেম নাই, বক্স অফিস সিস্টেম নাই।
"আমাদের সিনেমার বাজেট সাড়ে চার কোটি। বাংলাদেশের যেসব সিনেমা হল আছে এবং তাদের দর্শক ধারণক্ষমতা যথেষ্ট ভালো, তবে ই-টিকেটিং বা বক্স অফিস না থাকায় আমরা প্রপার ইনফরমেশন টাই পাই না। এই জায়গা থেকে বাংলাদেশের প্রযোজকরা খুব অসহায়।"
শাকিল বলেন, "একটা সিনেমা হলে ১৮ লাখ টাকা বিক্রি করার ক্যাপাসিটি আছে, কিন্তু সেই সিনেমাটাই তারা মুক্তির আগে ৪ লাখ বা পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে রেন্টাল হিসেবে দুই সপ্তাহের জন্য নিয়ে যায়। সিনেমা যদি হাউসফুল যায় তাহলে তো ১৮ লাখের ডাবল বিক্রি হওয়ার কথা, কিন্তু প্রযোজকরা সেই চার পাঁচ লাখ টাকাই পায়।"
অবকাঠামো ঠিক করার তাগিদ দিয়েছেন এই প্রযোজকও।
তার ভাষ্য, সেন্ট্রাল সার্ভার, ই টিকেটিং বা বক্স অফিস না থাকলে এখানে প্রযোজকদের লগ্নি ফেরত পেতে কষ্ট হয়ে যায়।
'জ্বীন ৩' সিনেমাটি গত শুক্রবার স্টার সিনেপ্লেক্স ও লায়ন সিনেমা থেকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে।
তবে সিনেমাটি মোটামুটি ভালো ব্যবসা করেছে বলে জানিয়েছেন সিনেমার প্রযোজক আব্দুল আজিজ।
তিনি বলেন, "খারাপ না, যা ব্যবসা করেছি ভালো করেছি।"
'চক্কর' সিনেমার নির্মাতা ও প্রযোজক শরাফ আহমেদ জীবন বলেন, "ঈদের প্রথম সপ্তাহে একটা গোলমেলে অবস্থা ছিল, বড় বাজেটের সিনেমার সঙ্গে হল পাওয়া মুশকিল। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে সিনেমা ভালো শো পেয়েছে। আমাদের আয় করতে একটু সময় লাগবে।“
শরাফ আহমেদ জীবনের প্রথম সিনেমা এটি। কী কী সংকট দেখেছেন প্রশ্নে তিনি বলেন, "আমার যেহেতু প্রথম সিনেমা, প্রথম প্রোডিউস করা, আমি হয়ত একটু কমই জানি, এই জায়গার স্ট্রাকচারটা অন্য রকম। যেটা শেখা ও বুঝার অনেক কিছু আছে। তবে বক্স অফিস সিস্টেমটা দরকার।"
ব্যবসা কেমন?
ঈদে সিনেমার ব্যবসা কেমন হয়েছে প্রশ্নে প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল গ্লিটজকে বলেছেন দর্শক ‘বেড়েছে’।
“ঈদে পরিবার পরিজন নিয়ে দর্শক সিনেমা দেখছেন। অনেক বছর পর সারা দেশের এই জোয়ার দেখা গেছে। প্রত্যেকটা প্রেক্ষাগৃহ সুপার ডুপার হিট ব্যবসা করছে।"
ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসার সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন।
তার কথায়, কেবল ঈদ কেন্দ্রিক ব্যবসা দিলে হবে না।
“বছরে ৩০টা সিনেমা হোক, ভালো গল্পের পাঁচটি ছয়টি হিট সিনেমা দিলে হলের পরিস্থিতি ফিরবে। হলে দর্শক ফিরলে হল সংস্করণ, সিনেমার উন্নয়নসহ সব কাজ করা সম্ভব হবে।"
প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস গ্লিটজকে বলেন, এবার ঈদে সিনেমার যে ‘ভালো ব্যবসা’ হয়েছে, সেটির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা দরকার।
“কীভাবে বজায় রাখা যায়, কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে খুব শিগগিরই আমরা বৈঠকে বসব। হল মালিকদের পরামর্শ দিব, যারা ঈদে যে সিনেমা চালিয়েছে, তারা সেটার পর যেন বিকল্প আরেকটা সিনেমা চালায়। তাহলে ঈদের সব সিনেমাগুলোই ব্যবসা করতে পারবে।”
লায়ন প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেকের কাছে গ্লিটজের প্রশ্ন ছিল, ঢাকাই সিনেমার সুদিন ফিরছে বলে তিনি মনে করেন কী না।
তিনি বলেন, "সুদিন ফিরছে কী না এখনই বলা যাচ্ছে না, গত কোরবানি ঈদের পর তো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হল। অগাস্টের পর থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত আমি আমার সিনেমা হলে প্রায় বেয়াল্লিশ লাখ টাকা পুঁজি ঘাটতি দিয়েছি। মানে স্টাফ খরচ, বিল সব মিলিয়ে লসে সিনেমা হল চালিয়েছি। এই ঈদে সিনেমা খুব ভালো গেছে। তবে তাতে আমার যে আট মাসের ব্যবসায়িক লস সেটা উঠানো গেল কী?”
কেবল ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা করা যাবে না বলে বলছেন খালেকও।
তার ভাষ্য, “এই ঈদে ব্যবসা করলাম আবার কোরবানির ঈদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, ঈদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তো আবার পরের দশ মাস চিন্তায় থাকতে হবে হল কীভাবে চালাব?”
দেশের প্রযোজক, নির্মাতারা শুধু ঈদ উৎসব ঘিরে সিনেমার কথা ভাবেন, এই বিষয়টিকে চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ‘সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার’ বলেও মনে করছেন লায়ন প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার।