নির্মাণের পর মুক্তি নিয়ে সংকট এবং মন্দা বাজারে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নিয়ে বিনিয়োগ করতে চান না প্রযোজকেরা।
Published : 01 Apr 2025, 01:22 AM
“তখন আমরা একদম গেদা ছিলাম, আমাদের বাসা ছিল অভয় দাস লেনে। টিকাটুলিতে আমার বাবার অফিস ছিল। সেখানে 'অভিসার' ও 'মধুমিতা' দুইটা সিনেমা হল ছিল। তখন এমন একটা নিয়ম ছিল, বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাওয়া হত। হয় ৬টার শো, না হয় ৯টার শো দেখতাম। সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যেতাম। গভীর রাতে বাসায় ফিরতাম।"
ছোটবেলায় হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা এভাবেই বলছিলেন অনিমেষ আইচ। ৪৫ বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘ডানপিটে ছেলে’ সিনেমার একটি গান, কিছু দৃশ্য এখনো তার মনে দাগ কেটে আছে।
“হায়রে আমার মন মাতানো দেশ, হায়রে আমার সোনা ফলা মাটি' এই গান ছিল। সিনেমাটা দেখে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। জলাতাঙ্ক হয়ে মারা যায় কিনা সেই চিন্তায় খুব মন খারাপ হয়েছিল। আর গানটা তখন অনেক প্রিয় ছিল।”
'ডুমুরের ফুল', 'ছুটির ঘণ্টা', ‘পুরস্কার’, 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী'র মত আরো অনেক সাড়া জাগানো শিশুতোষ সিনেমা তখন হলে বসে দেখেছেন অনিমেষ। আফসোস করে তিনি বললেন, “সেই রকম জনপ্রিয় শিশুতোষ সিনেমা এখন আর কই!"
অনিমেষ আইচ বলছিলেন গত শতকের আশির দশকের কথা। আরো পরে নব্বইয়ের দশকে মুক্তি পাওয়া 'দীপু নাম্বার টু' এবং ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া 'আমার বন্ধু রাশেদ' সিনেমাও আলোড়ন তুলেছিল দর্শক মনে। সিনেমাগুলো দেখতে প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়া ভিড়, ছিল দর্শকদের মধ্যে উন্মাদনা ছিল।
এরপর বিভিন্ন সময়ে অনেক নির্মাতা ও প্রযোজক শিশুদের নিয়ে শিশুদের জন্য সিনেমা নির্মাণ করেছেন, কিংবা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, সরকারি অনুদান নিয়েও সিনেমা নির্মাণে হেলা বা আলোচিত না হওয়া- এমন নানা কারণে দেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র হচ্ছে একেবারেই কম।
আগের মত আলোচিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না কেন, এই সংকটের কারণ কী- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পরিচালক, প্রযোজক, হল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল নানা সমস্যার কথা।
ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০), ডানপিটে ছেলে (১৯৮০), পুরস্কার (১৯৮৩), রামের সুমতি (১৯৮৫), কাঁঠাল বুড়ির বাগান (১৯৮৮), দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬), দূরত্ব (২০০৪), দূরবীন (২০০৯), আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১), বৈষম্য (২০১৪), আঁখি ও তার বন্ধুরা (২০১৭)- উল্লেখযোগ্য এসব শিশুতোষ চলচ্চিত্রের বাইরে মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা মাঝে মধ্যে কিছু শিশু চরিত্র জনপ্রিয় হয়েছে।
যেমন- ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), অশিক্ষিত (১৯৭৮), মাটির ময়না (২০০২), ঘেঁটুপুত্র কমলা (২০১২) সেই অর্থে শিশুতোষ নয়, শিশুদের ভূমিকা সিনেমাগুলোকে ব্যবসা সফল করেছে।
সরকারি অনুদান: পিছিয়ে না কি উপেক্ষা?
১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান দেওয়া শুরু হয়। সে বছর অনুদান পাওয়া বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ সিনেমাটি ব্যাপক আলোচিত হয় এবং এখনো শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মধ্যে এটিকে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে ধরা হয়।
১৯৭৮ সালে সরকারের অনুদানের নীতিমালায় শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, যেখানে বলা হয়, তিনটি সিনেমার মধ্যে একটি হতে হবে শিশুতোষ। কিন্তু দেখা গেছে, অনুদান নেওয়ার পর সিনেমা নির্মাণে দীর্ঘ সময় নেওয়া, নির্মাণের পর দর্শক সমাদৃত না হওয়াসহ অনেক কারণেই অনুদানের সিনেমাগুলো গুরুত্ব হারিয়েছে।
২০০৬ সাল পর্যন্ত সরকারের অনুদান বন্ধ থাকে। এরপর ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান দেওয়া হচ্ছে। তবে ২০০৭ সালের অনুদান তালিকায় শিশুতোষ চলচ্চিত্র ছিল না।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া 'আমার বন্ধু রাশেদ' শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মধ্যে এখনো বেশ জনপ্রিয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অনুদানের শিশুতোষ সিনেমা ‘কাজলের দিনরাত্রি’ মুক্তি পায় ২০১৩ সালে। ২০১০-১১ অর্থবছরে অনুদানে নির্মিত ফারুক হোসেনের 'কাকতাড়ুয়া' মুক্তি পায় ২০২৪ সালে।
২০১১-১২ অর্থবছরে শিশুতোষ সিনেমা হিসেবে অনুদান পেয়েছিল ‘হাডসনের বন্দুক’। অনুদান পাওয়ার আট বছর পর সিনেমাটি ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর মুক্তি পায়।
২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুদানের সিনেমা মান্নান হীরার 'একাত্তরের ক্ষুদিরাম' মুক্তি পেয়েছিল ২০১৪ সালে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মুশফিকুর রহমান গুলজারের ‘লাল সবুজের সুর' শিশুতোষ চলচ্চিত্রটি যথাসময়েই মুক্তি পায়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছয়টি চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়া হয়। এর মধ্যে শিশুতোষ সিনেমা অনুদান পায়নি, তবে মাসুদ পথিকের ‘মায়া-দ্য লস্ট মাদার’ সিনেমায় যুদ্ধশিশুদের গল্প ছিল।
২০১৫-১৬ অর্থবছর সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমাকে অনুদান দেওয়া হয়। এর মধ্যে শিশুতোষ চলচ্চিত্র ছিল মোর্শেদুল ইসলামের ‘আঁখি ও তাঁর বন্ধুরা’। সিনেমাটি ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মুক্তি পায়।
২০১৭ -১৮ অর্থবছরে শিশুতোষ বিভাগে একটি সিনেমা অনুদান পায়। মানিক মানবিকের সিনেমা 'আজব ছেলে' মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা নয়টি। এর মধ্যে শিশুতোষ শাখায় আবু রায়হান মো. জুয়েলের ‘নসু ডাকাত কুপোকাত’ পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে 'অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন' নামে ২০২৩ সালে মুক্তি পায়।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পূর্ণদৈর্ঘ্য বিভাগে সরকারি অনুদান পেয়েছিল দুটি সিনেমা ‘মেঘ রোদ্দুর খেলা’ ও 'রাসেলের জন্য অপেক্ষা'। আউয়াল রেজা পরিচালিত ‘মেঘ রোদ্দুর খেলা’ মুক্তি পায় ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে 'মাইক' ও 'নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়' দুটি সিনেমা অনুদান পেয়েছিল। এফ এম শাহীন পরিচালিত মাইক সিনেমাটি ২০২৩ সালে মুক্তি পেয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুটি সিনেমা অনুদান পেয়েছে। তরুণ পরিচালক নিয়ামূল মুক্তার সিনেমা ‘চলনবিলের মানিক’ ও প্রযোজক রাইদ মোরশেদ ও পরিচালক তাওকীর ইসলামের ‘অদ-ভূত’ চলচ্চিত্র সরকারি অনুদান পেয়েছে।
সরকারি অনুদান পাওয়ার পরও আলোর মুখ দেখেনি অনেক শিশুতোষ চলচ্চিত্র।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ছয়টি চলচ্চিত্রের মধ্যে শিশুতোষ সিনেমা ছিল ‘প্রিয় জন্মভূমি’। ছটকু আহমেদের কাহিনীতে এ ছবির পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান এই নির্মাতা। সিনেমাটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৯ থেকে ২০২৩ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া 'রাসেলের জন্য অপেক্ষা', ‘মাটির রাজ কুমার’ ও ‘মস্ত বড়লোক’ সিনেমাগুলো এখনো ‘নির্মাণাধীন’ বলে নির্মাতারা জানিয়েছেন।
একই সময়ে অনুদান পাওয়া ‘নুলিয়াছড়ি সোনার পাহাড়’ সিনেমাটি মুক্তির প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়ে নির্মাতা লুবনা শারমিন বলেন, “সিনেমার নির্মাণ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে সিনেমাটি দেখানো হয়েছে। এখন সার্টিফিকেশন বোর্ডে জমা দেওয়া আছে, সেখান থেকে সেন্সর পেলে এ বছরই মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হবে।”
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ২২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে শিশুতোষ শাখায় ‘মাটির রাজকুমার’ ও ‘মস্ত বড়লোক’ দুটি সিনেমা অনুদান পেয়েছে।
'মাটির রাজকুমার' সিনেমার অগ্রগতি জানতে চাইলে নির্মাতা রুবেল শঙ্কর গ্লিটজকে বলেন, “আমাদের প্রি-প্রোডাকশন কাজ শেষ। শুটিং শুরুর অপেক্ষায় আছি, প্রস্তুতি চলছে।”
সিনেমাটির গল্প ও চিত্রনাট্য লিখেছেন নির্মাতা নিজেই। দুই থেকে তিনশ শিশুর অংশগ্রহণে নির্মিত হবে সিনেমাটি।
আকা রেজা গালিব নির্মাণ করছেন 'মস্ত বড়ো লোক' সিনেমাটি।
শুটিং শেষ করে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ চলছে জানিয়ে নির্মাতা বলেন, “গত ডিসেম্বরে সিনেমার শুটিং শেষ হয়েছে, আরও আগেই শেষ হত। জুলাই আন্দোলনের জন্য আটকে গিয়েছিল। পোস্ট প্রোডাকশন শেষ করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে, মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি মিললে মুক্তির তারিখ ঘোষণা করা হবে।”
স্মৃতি আর আক্ষেপ
১৯৮৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘পুরস্কার’ সিনেমার স্মৃতি অভিনেতা নাসির উদ্দিন খানের মনে এখনো অমলিন।
গ্লিট্জকে তিনি বলেন, “আমার বড় ভাই আমানুল্লাহ খানের সাথে আমি, আমার বন্ধু কাঞ্চন ও আমার ভাতিজা শাহেদ তিনজন মিলে চট্টগ্রামের আলমাস সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখি। খুব ভালো লেগেছিল।
'ছুটির ঘণ্টা' সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, নাসির উদ্দিন খান তখন মাধ্যমিক স্কুলে পড়েন। ঈদের ছুটি শুরুর আগের দিন সবার অজান্তে স্কুলের বাথরুমে আটকা পড়া এক কিশোরের মর্মান্তিক গল্প তুলে ধরা হয়েছে সেই ছবিতে।
“আমাদের স্কুলের ওয়াশরুম ছিল দোতালার নিচে। ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখার পর ভয়ে একা সেখানে যেতাম না।তখন ওই সিনেমাগুলো আমাদের মনে বড় একটা প্রভাব ফেলত। এখন সেরকম সিনেমা হয় না।”
কী কারণে সিনেমা হয় না? এই অভিনেতা বললেন, “আমি জানি না।
“তবে সেরকম সিনেমা খুব মিস করি। আমাদের দেশে শিশুদের নিয়ে অনেক গল্প আছে। সেসব সুন্দর করে নির্মাণ করলে বাবা মা শিশুদের নিয়ে হলে সিনেমা দেখতে যাবে।"
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইবতিদা খানম তুহা দুই বছর আগে ভাইয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল স্টার সিনেপ্লেক্সে। ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ সিনেমাটি দেখেছিল সে। এরপর আর কোনো দেশি সিনেমা দেখা হয়নি তার। তবে সে নিয়মিত হলিউডের অ্যানিমেশন সিনেমা দেখে।
তুহা গ্লিটজকে বলে, "আমার সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ সিনেমা মুক্তির পর সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলাম, মোটামুটি ভালো লেগেছে। এরপর অ্যাডভেঞ্চার নেওয়ার মত কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি “
ভাইয়ের ল্যাপটপে 'র্যাটাটুলি', 'হাউ টু ট্রেইন ইউর ড্রাগন', 'মাইগ্রেশন', 'কোকো', 'মোয়ানা'র মত অ্যানিমেশন সিনেমা দেখার কথা জানিয়ে এই কিশোরী বলে, “এসব আমার পছন্দের সিনেমা। আমাদের দেশে এমন সিনেমা হয় না, হলে খুব ভালো হত।"
গত বছরের ডিসেম্বরে দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল অ্যানিমেশন সিনেমা 'মোয়ানা টু'। চার বছরের বোনের ছেলেকে নিয়ে সিনেমাটি দেখেছেন অথৈ জামান।
তিনি বলেন,"বাচ্চাকে নিয়ে বেবিল্যান্ডে এসেছিলাম, পোস্টার দেখে সিনেমা দেখতে আসা। এখন আর বাচ্চাদের সিনেমা হয় না। টিভিগুলোতে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। একটা চ্যানেল আছে সেখানে কিছু কার্টুন দেখা যায়।
“আগে শিশুদের নিয়ে অনেক ধরনের কনটেন্ট হত, অনেক চর্চা হত, তা এখন নেই। চলচ্চিত্র নেই, কোনো প্রোগ্রাম নেই। শিশুদের জন্য ভালো সিনেমা তৈরি হওয়া উচিত।"
হল মালিকরা চান ‘ভালো’ সিনেমা, প্রযোজকরা বিমুখ
সরকারি অনুদানের বাইরে খুব একটা শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না, প্রযোজকরাও আগ্রহী হন না বিনিয়োগে।
প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু গ্লিটজকে বলেন, “এখন মূলধারার চলচ্চিত্রের অবস্থাই ভালো না। চলচ্চিত্র এখন একজন শিল্পী নির্ভর হয়ে গিয়েছে। এটা কিন্তু একটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভালো কিছু না। সিনেমা চলে না, দর্শক পছন্দ করে না। ভালো গল্প হয় না, ভালো নির্মাতা নাই। যার কারণে এই মন্দা অবস্থায় আর কেউ শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ইনভেস্ট করতে চায় না।”
‘অপ্রতুল’ সরকারি অনুদান এবং শিশুতোষ সিনেমা চালানোর ক্ষেত্রে হল মালিকদের অনীহাকেও কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন খসরু।
“সিনেমা নির্মাণ করে মুক্তি নিয়ে কিন্তু সংকটে পড়তে হয়। হলগুলো বাণিজ্যিক উপাদান না থাকায় মুক্তি দিতে চায় না। আর আমাদের দেশে নির্মাণ টেকনোলজিও খুব উন্নত না, ভিএফএক্স নাই, যন্ত্রপাতি নাই। তাই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ আমাদের জন্য সহজসাধ্য নয়। "
২০২৩ সালের ১৮ অগাস্ট প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘আম কাঁঠালের ছুটি’। এর পরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান। সিনেমাটি প্রযোজনাও করেছেন নির্মাতা।
প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে কতটুকু সংকট বা সম্ভাবনা দেখেছেন–এ প্রশ্নে নূরুজ্জামান বলেন, “সংকটের কথা যদি বলি, শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র কম৷ এখানে যারা টাকা লগ্নি করেন তারা মনে করেন টাকা উঠে আসবে না। অন্যান্য কমার্শিয়াল সিনেমায় যেসব উপাদান থাকে, সেসব উপাদান তো শিশুতোষ চলচ্চিত্রে নেই। এই সিনেমার দর্শক ও তুলনামূলক কম হয়৷
“আমি নিজের টাকায় তৈরি করেছি, আমার কাছে মনে হয়েছিল এটা নিয়ে কাজ করাটা জরুরি। এই টাকাটা উঠে আসা সম্ভব। আমি কিন্তু টাকাটা তুলতে পেরেছি। আমার ইনভেস্টমেন্ট উঠে গেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে সাহস নিয়ে কাজ করলে এটা উঠানো সম্ভব।”
শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা মুক্তি দিতে চান না–এমন দাবির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করলেন স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমরা কিন্তু শিশুতোষ চলচ্চিত্র চালাই, সিনেমা নির্মাণ হলে অবশ্যই চালাব। কিন্তু নির্মাণ না হলে তো আমাদের কিছু করার নেই।”
শিশুদের নিয়ে নির্মিত বিদেশি সিনেমাগুলো ভালো চলছে জানিয়ে মেসবাহ বলেন, “আমাদের হলিউড মুভির দর্শক হয়, ব্যবসা হয়। ‘কুংফু পান্ডা ৪', ‘হাইকিউ: দ্য ডাম্পস্টার ব্যাটেল’, ‘মোয়ানা-২’ এসব সিনেমা কিন্তু আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ চালিয়েছি। দর্শক চাহিদা আমরা দেখি। সেই জায়গায় কেন বাংলা সিনেমা চালাব না?
“শিশুতোষ চলচ্চিত্র হওয়া উচিত। ভালো সিনেমা হলে আমাদের দেশের দর্শকরা দেখবে। শুধু বড়দের জন্য বিনোদন থাকবে, ছোটদের জন্য না, সেটা তো হয় না। তাই শিশুতোষ সিনেমা নির্মাণ হওয়া দরকার।”
শিশুদের নিয়ে ভালো সিনেমা হলে হলগুলো দর্শক টানতে পারবে বলে মনে করেন প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বলও।
তিনি বলেন, “সিনেমা ব্যবসার অবস্থা তো ভালো না, সারা বছরে পাঁচ থেকে ছয়টি ব্যবসা সফল সিনেমাই আমরা পাচ্ছি না। সেখানে শিশুতোষ চলচ্চিত্র চালানোর সুযোগ কম। তবে ভালো সিনেমা, আলোচিত সিনেমা হলে সেগুলো অবশ্যই চলে। ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ আমরা চালিয়েছি। এরপর আর শিশুতোষ এমন সিনেমা মুক্তি পায়নি।”
হতাশা ওটিটিতেও
ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও শিশুতোষ চলচ্চিত্রগুলোর অবস্থা সুখকর নয়।
‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ সিনেমার সহপ্রযোজক ‘বঙ্গ’ এর চিফ কনটেন্ট অফিসার মুশফিকুর রহমান মঞ্জুর জানালেন, এ সিনেমায় বিনিয়োগ করা টাকা উঠে আসেনি।
“এটা খুবই কঠিন একটা শ্যুট ছিল। সুন্দরবন দেখানো, বা একটা খরচের ব্যাপার ছিল। আমরা কিন্তু টাকাটা রিটার্ন পাইনি। মনে করেন ভরাডুবি অবস্থা একদম। বাজেটটা বেশি ছিল। কিন্তু সেটার আয় হিসেবে ১০-১৫ লাখ টাকাও আসেনি।”
মঞ্জুর বলেন, “আমাদের শিশুতোষ সিনেমা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আছে, কিন্তু একবার ব্যবসায়িক লস হয়েছে, যদি ৫০ শতাংশ টাকাও ফেরত আসত, তাহলে আবার উদ্যোগ নেওয়া যেত। এখন আমরাও প্রস্তুত না, তবে শিশুতোষ নিয়ে আমাদের আলাদা একটা ভাবনা আছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে ওটিটি তো এখনো মার্কেট প্লেস তৈরি করার মত জায়গায় যেতে পারেনি। এখন হয়ত এক কোটি লোক ওটিটি দেখছে, কিন্তু এই এক কোটি লোকও পয়সা দিয়ে দেখছে না। ফ্রি ডাউনলোড করে দেখছে। যেহেতু ওটিটি ভিন্ন একটা মাধ্যম হিসেবে জায়গা দখল করছে, সেই জায়গা থেকে শিশুদের নিয়েও কাজ তৈরি করা দরকার। তবে শুধু আমরা বানালেই তো হবে না, দর্শকেরও এগিয়ে আসতে হবে।”
শিশুদের নিয়ে কনটেন্ট নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা থেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে শিশুদের জন্য 'কিডস টেলস' নামে একটি কর্নার তৈরি করেছে।
প্ল্যাটফর্মটির অপারেশন ম্যানেজার আসাদ ইসলাম বলেন, "'কিডস টেলস' কর্নারে আমরা শিশুদের নিয়ে আফসানা মিমির নির্মাণে 'অফ দ্যা মার্ক' সিনেমাটি রেখেছি। 'বিগ ফাইভ' নামে কোরিয়ান কার্টুন বাংলায় ভাষান্তর করে প্রচার করা হচ্ছে।
“এছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের 'ছোটকাকু' সিরিজের সব নাটক সেখানে দেওয়া হয়েছে। এবার ঈদেও 'ছোটকাকু চ্যাপ্টার টু' সিরিজের 'মিশন মুন্সিগঞ্জ' টিভিতে প্রচারের পর সেখানে মুক্তি দেওয়া হবে। এসবের বাইরেও শিশুতোষ চলচ্চিত্র 'আম কাঁঠালের ছুটি' ও 'মাইক' আইস্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে।”
আইস্ক্রিন শিশুদের কনটেন্টে নির্মাণে গুরুত্ব দেয় দাবি করে আসাদ বলেন, “আমার সবসময় শিশুদের কনটেন্ট নিয়ে ভাবি এবং আমাদের কাজ চলমান। আমরা শিশুদের নিয়ে ভালো গল্প পেলে, কোনো নির্মাতা যদি শিশুদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখায় আমরা তার পাশে সবসময় থাকি, তাদের চিত্রনাট্যে গুরুত্ব দিই, নির্মাণের চেষ্টা করি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, টেলিভিশন বা যে কোনো ভিজ্যুয়াল মাধ্যমেই আসলে শিশুদের নিয়ে ভাবা উচিত, অনেক ভালো ভালো কাজ হওয়া উচিত বলেই আমরা মনে করি।”
পৃষ্ঠপোষকতার অভাব দেখছেন মোরশেদুল ইসলাম
সবচেয়ে বেশি শিশুতোষ সিনেমা নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। তার 'দূরত্ব', দীপু নাম্বার টু 'আমার বন্ধু রাশেদ', 'আঁখি ও তার বন্ধুরা', 'শরৎ ৭১' সিনেমাগুলো বেশ আলোচিত ও জনপ্রিয় ছিল।
শিশুতোষ চলচ্চিত্র আগের মত নির্মাণ হয় না কেন, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল তার কাছে।
এই নির্মাতা বলেন, “শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ না নেওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। শিশুতোষ চলচ্চিত্র তো বাণিজ্যিক সিনেমা হবে না। যেহেতু বাণিজ্যিক উপাদান নেই, সাধারণ প্রযোজক যারা আছেন, তারা মনে করেন এই সিনেমা বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে না। তারা শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান না।”
মোরশেদুল ইসলাম বলেন, “সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে শুরু হয়েছে, অনুদানের সিনেমার মধ্যে একটি সিনেমা শিশুতোষ হতে হবে। এখানেও আমরা দেখছি যে যারা অনুদান পাচ্ছে তারা সিনেমা নির্মাণ করছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো খুব দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলতে পারছে না। শিশুতোষ চলচ্চিত্র বানানো সহজ কাজ না। শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা বুঝে এটা বানাতে হয়। এখানে ফাঁকি দেওয়ারও উপায় থাকে না। তাদের সঙ্গে নিজেকেও শিশু বানাতে হয়৷ এই কারণে অনেক নির্মাতাই সিনেমা বানাতে পারেন না। এটা নির্মাতাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা।”
শিশুতোষ চলচ্চিত্রকে যে ভালো স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, সে কথাও বললেন তিনি।
“শিশুতোষ চলচ্চিত্র বা শিশুদের জন্য যে কোনো কাজকেই আমরা খুব ছোট মনে করি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শিশুতোষ চলচ্চিত্রকে মূল শাখায় পুরস্কার দেওয়া হয় না। শুধু একটা অংশ থাকে শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেতা৷ এইখানেও কিন্তু ছোটদের কাজকে উপেক্ষা করা হয়। এসব সম্মিলিত কারণেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ কম হয়।”
শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে অনুদানে বৈষম্যের কথাও তুলে ধরেছেন এই নির্মাতা।
তিনি বলেন,"২০২৩-২৪ অর্থবছরে চারটি শাখায় সরকার ২০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি চলচ্চিত্র পেয়েছে ৭৫ লাখ টাকা করে। আর চারটি চলচ্চিত্র ৫০ লাখ টাকা করে। এর মধ্যে দুটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘চলনবিলের মানিক’ ও ‘অদ-ভূত’ ৫০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে।
"এটা খুবই বৈষম্যমূলক আচরণ। কারণ ছোটদের সিনেমা নির্মাণ করতে তো আর কম টাকা লাগে না। বরং বেশি টাকা লাগে। ছোটদের সিনেমাকে দেওয়া হয়েছে কম টাকা বড়দের দেওয়া হয়েছে বেশি টাকা। এসব সিনেমাকে ছোট করে দেখা হয়, অবহেলা করা হয়। এসব কারণেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে কেউ এগিয়ে আসে না।"
শিশুতোষ চলচ্চিত্রের করুণ দশার মধ্যেও গড়ে উঠেছিল 'চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ' নামে একটি সংগঠন। ২০০৬ সালের ৬ অগাস্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রায় প্রতি বছরই তারা 'আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব’ আয়োজন করে আসছে। তবে কয়েক বছর ধরে ওই উৎসব খুব বড় আকারে হচ্ছে না।
এ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, “এখানেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। আগে আমরা সরকার থেকে একটা ফান্ড পেতাম, সেটা কয়েক বছর ধরে পাচ্ছি না। চলচ্চিত্র উৎসব তো বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তাই আমরা ছোট আকারে করি।”
এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় কী? তিনি বললেন, “উত্তরণের কোনো সহজ পথ হয়ত বলা যাবে না। আমাদের শিশুতোষ চলচ্চিত্রকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সব নির্মাতাকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভালো নির্মাতা যারা আছেন, অনেক সফল সিনেমা নির্মাণ করছেন তারা, কিন্তু শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন না। তারা এগিয়ে এলে এই সংকট কাটতে পারে এবং একটা দায়িত্বশীল প্রতিযোগিতা হতে পারে।”
আসছে শিশু একাডেমির দুটি সিনেমা
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রযোজনায় নির্মিত হয় খান আতাউর রহমানের 'ডানপিটে ছেলে', সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকির 'গল্প দাদুর গল্প কথা' নামের দুটি চলচ্চিত্র। এছাড়া বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় শিশু একাডেমির প্রযোজনায়। এখন পর্যন্ত ৫৭টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান।
মাঝখানে কিছুটা বিরতি পড়লেও দুটি সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জানিয়েছে শিশু একাডেমি।
একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক আনজীর লিটন গ্লিটজকে বলেন, শিশু একাডেমি থেকে আগে অনেক সিনেমা নির্মাণ হত, মাঝখানে বিভিন্ন কারণে একটা বিরতি পড়ে গিয়েছিল।
“কিন্তু চলতি বছরে দুটি সিনেমার দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। যেগুলো সেন্সর ছাড়পত্রও হয়ে গেছে, শিগগিরই মুক্তি পাবে।”
এর মধ্যে নির্মাতা ও অভিনেতা আফজাল হোসেন পরিচালনা করেছেন 'মানিকের লাল কাঁকড়া'। আর শুভ পাল বানিয়েছেন 'সবুজ পাখি'।