প্রচারের শেষ মুহূর্তেও মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
Published : 19 Jun 2023, 09:33 PM
নির্বাচন কাছে চলে এলেও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থীদের নিয়ে ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না; বরং নিজের পাড়া-মহল্লায় কাউন্সিলর পদে কে বিজয়ী হতে পারেন তা নিয়ে মশগুল ভোটাররা।
বুধবার অনুষ্ঠেয় সিটি করপোরেশনের পঞ্চম ভোটে বিএনপি না থাকায় নির্বাচন সেভাবে জমেনি বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তারপর ইসলামী আন্দোলনের মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় মানুষ আরও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
তবে প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রায় ১০ জন করে কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। পাড়া-মহল্লায় উত্তেজনাও আছে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে।
সোমবার মধ্যরাত থেকে নির্বাচনের প্রচার বন্ধ হচ্ছে। তবে শেষদিনে বৃষ্টির মধ্যেই প্রার্থীরা প্রচার চালিয়েছেন। বিকালে বৃষ্টি কমলে প্রার্থিরা শেষবারের মত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, ভোটকে শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার নগরজুড়ে থাকবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও।
নির্বাচন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সিলেট সিটির মেয়র পদে আটজন প্রার্থী রয়েছেন। ৪২টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৭৩ জন, ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর পদে ৮৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই নগরীতে মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬০৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৬৩ জন এবং নারী ২ লাখ ৩২ হাজার ৮৪২ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৯০টি এবং ভোটকক্ষ ১ হাজার ৩৬৪টি।
২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। ২০০৩ সালে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী বদর উদ্দিন কামরান, ২০০৮ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও কারাগার থেকে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৩ সাল থেকে মেয়র পদে আছেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। তবে এবার তিনি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না।
নগরীর ধোপাদিঘীরপাড়ের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির চৌধুরী বলেন, “এবারের ভোটে মেয়র প্রার্থী নিয়ে কোনো উত্তাপ নেই। তবে ওর্য়াডগুলো একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যেহেতু এবার বড় রাজনৈতিক দল আসেনি; তাই গত নির্বাচনগুলোর মত ভোট পড়ার সম্ভাবনা নেই।”
নগরীর মদিনা মার্কেটে কথা হয় অটোরিকশার চালক সাজ্জাত মিয়ার সঙ্গে। তার ভাষ্য, “নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। মেয়র কে হচ্ছেন তা কনফার্ম, সবাই জানে। তবে উনাকে আমরা ভালো করে চিনি না। আর মাঠে অন্য যারা আছেন (লাঙ্গল-ঘোড়া) তারা তো একই ঘরের।
“তাই মনে করছি, ভোটকেন্দ্রে যাওয়া না যাওয়া সমান। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে যেতে হবে। আমরা চাচ্ছি, আমাদের পাড়ার প্রার্থী যেন কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করেন। তাহলে নিজ এলাকার মানুষজন তাকে কাছে পাবেন।”
একই এলাকার টং দোকানি আফজাল ইসলাম বলেন, “এবারের নির্বাচনে মেয়র নিয়ে মানুষজন তেমন আলোচনা করেন না। চা খেতে আসা লোকেরা কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়েই বেশি কথা বলেন। আমাদের ওয়ার্ডে বেশ কয়েকজন প্রার্থী হয়েছেন। তারাও বার বার প্রচারে আসেন। তবে এ বছর বৃষ্টির কারণে ভোটের প্রচার কম হচ্ছে।“
ভোটের মাঠে থাকা নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আব্দুল করিম কিম বলেন, “আমি নির্বাচনী প্রচারে নামার পর থেকে ভোটারদের ভালো সাড়া পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে, অতীতের মতো এবারও নগরবাসী ভোট কেন্দ্রে যাবেন; ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।”
৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদপ্রার্থী শ্যামলী সরকার জানান, সোমবার তিনি নগরীর পল্লবী আবাসিক এলাকা পনিটুলা, বাগবাড়ী, এতিম স্কুল রোড, বর্ণমালা পয়েন্ট, কালীবাড়ি, করেরপাড়া, হাওলাদার পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেছেন।
“ভোটারদের ভালো সাড়া পাচ্ছি; ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিবেন বলেও ভোটারা আশ্বাস দিচ্ছেন।”
বেশি প্রার্থী বেশি ভোটার নিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেটে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ৩৬৮ জনের মত প্রার্থী রয়েছেন। একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী থাকার কারণে নির্বাচনের দিন ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন ভোট দিতে। তাই বলা যেতে পারে, অন্য তিন সিটির চেয়ে সিলেটে ভোট বেশি পড়বে।”
সেই সঙ্গে তিনি বলেন, “তবে এবার সিটি নির্বাচনে বিএনপি না থানায় ভোট উৎসব দেখা যাচ্ছে না। মানুষজন ভোট নিয়ে এত আলোচনা করছেন না।”
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানে ভোট পড়েছিল ৭৫ শতাংশ। এরপর ২০১৩ সালে প্রায় ৬২ শতাংশ এবং সবশেষ ২০১৮ সালে পড়েছিল ৬৩ শতাংশের উপর।
‘বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না’
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৪৩ নেতাকর্মীকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তবে সমর্থক ও স্বজনরা তাদের ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন বলে মনে করছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
সিলেট বিএনপির এক নেতা বলেন, “বহিষ্কার হয়েও যারা নির্বাচন থেকে সরে আসেননি; এসব নেতাদের কর্মীরা নির্বাচনে ভোট দিতে যাবেন। তাছাড়া নির্বাচনে থাকা কিছু প্রার্থীর স্বজনরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন নিজের প্রার্থীদের ভোট দিতে।”
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, “বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। সিলেটে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল তাদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তাই আমাদের দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। বিএনপি ভোটে নয়, সরকার পতনের আন্দোলনে রয়েছে।”
মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, “নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য বার-বার আমাদের নেতাকর্মীদের জানানো হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনী যেকোনো কাজে অংশগ্রহণ না করতেও বলা হয়েছে।“
প্রচারে ব্যস্ত আনোয়ারুজ্জামান ও বাবুল
প্রচারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নগরীর চালিবন্দর এলাকায় গণসংযোগ করেন।
এ সময় তিনি বলেন, “আপনাদের সেবার জন্য নৌকা নিয়ে এসেছি। ২১ জুনের নির্বাচনে যদি আপনাদের ভালোবাসায় ধন্য হওয়ার সুযোগ পাই তাহলে অবশ্যই সিলেট নগরবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। জনসেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছি; এখন আপনাদের ভালোবাসা চাই।
“প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও আধুনিক ও স্মার্ট নগরী গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সবাই নির্ধারিত সময়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং নৌকায় রায় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন তৎপরতার প্রতি আপনাদের সমর্থন জানাবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।”
এ সময় তিনি স্থানীয় অধিবাসী, ব্যবসায়ী ও পথচারীদের মধ্যে প্রচারপত্র ও ইশতেহারের কপি বিতরণ করেন।
এদিকে, সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশিদ চত্বরে লাঙ্গল প্রতীকের সমর্থনে প্রচার মিছিল বের হয়।
এ সময় জাতীয় পার্টির মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল বলেন, “সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে লাঙ্গলের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সরকার প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সরকার যদি কোনো ধরনের তামাশা খেলার চেষ্টা করে তাহলে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা ঘরে বসে থাকবে না।“
তিনি আরও বলেন, “ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পেশীশক্তি প্রয়োগও চলছে। কিন্তু পবিত্র এই নগরীর নাগরিকরা তাদের সব ষড়যন্ত্রের সমুচিত জবাব দেবেন ইনশাআল্লাহ।”
প্রচার মিছিলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন, আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট জেলা শাখার সদস্যসচিব সাইফুদ্দিন খালেদ, মহানগর শাখার সদস্যসচিব আব্দুস শহিদ লস্কর বশির উপস্থিত ছিলেন।