একে তো প্রবাহ নেই, তার ওপর খুলনা নগরীর ২২টির বেশি নালার মুখ এই নদের সঙ্গে যুক্ত; স্বাভাবিকভাবেই, ময়ূর হয়ে ওঠে আবর্জনা ফেলার ‘আদর্শ স্থান’।
Published : 30 Jun 2023, 08:00 PM
খুলনা নগরীর হৃদপিণ্ড হিসেবে একসময় পরিচিত ছিল ময়ূর নদ। যদিও সেই হৃদপিণ্ড এখন কচুরিপানায় ঢাকা, দুই পাড়ে জমেছে আবর্জনার স্তূপ।
এসবের মধ্যে থেকে ময়ূর নদ খুঁজে নিতে রীতিমতো ‘জহুরির চোখ’ প্রয়োজন। কুচকুচে কালো নদের পানির দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে স্থানীয়দের নাক চেপে পথ চলতে হয়।
খুলনা শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার নদ ময়ূর মূলত ভৈরব নদের একটি স্রোতধারা; যা কাজীবাছা-ভৈরব হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে।
বটিয়াঘাটার পুঁটিমারী ও তেঁতুলতলা গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গল্লামারী ব্রিজ থেকে ময়ূর নদ নামে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে জলধারাটি। এরপর রায়েরমহল হয়ে খুদিয়ার খাল নামে বিল ডাকাতিয়ায় গিয়ে মিশেছে। এর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার। প্রশস্ততা স্থান ভেদে ৪০ থেকে ১০০ ফুট এবং গভীরতা ১৫ থেকে ২৪ ফুট।
খুলনার অন্যতম প্রবেশদ্বার গল্লামারী সেতু এলাকা দিয়েই নগরে প্রবেশ করেছে ময়ূর। দখলে-দূষণে একসময়ের খরস্রোতা জলাধার এখন কেবল মরা খাল। আগে রূপসার সঙ্গে ময়ূরের সরাসরি সংযোগ থাকলেও ময়ূর এখন বদ্ধ নদ, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।
ময়ূরের এ মৃতপ্রায় অবস্থার কারণ হিসেবে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা বলছেন নানা কারণের কথা। এর মধ্যে রয়েছে, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা না থাকা, জনসংখ্যার চাপ, স্থানীয়দের মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতার অভাব এবং অপর্যাপ্ত পানিপ্রবাহ।
বর্ষায় ময়ূরের মূলধারা প্রবাহিত পানির চাপ নিতে না পারায় পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আশির দশকে রূপসার আলুতলা এলাকায় ১০ বেন্টের জলকপাট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরপর থেকেই অস্তিত্বের সংকট শুরু ময়ূরের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলকপাটের মাধ্যমে নদীর জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত হলেও বেশিরভাগ সময় জলকপাট বন্ধ থাকে। ফলে পানিপ্রবাহও বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে একটু বৃষ্টি হলেই নগরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।
পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় ময়ূরের তলদেশ পলি জমে ভরাট হতে থাকে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় শুরু হয় দখলের উৎসব। ময়ূরের দুই পাড় দখল করে গড়ে উঠতে থাকে প্রভাবশালীদের নানা স্থাপনা।
একে তো পানিপ্রবাহ নেই, তার ওপর নগরীর ২২টি বেশি নালার মুখ ময়ূরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, এই নদ হয়ে ওঠে আবর্জনা ফেলার ‘আদর্শ স্থান’।
স্থানীয় প্রবীণ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলতেই উঠে এল ময়ূরের ভরা যৌবনের কথা।
তেমনই একজন মোতাহার হোসেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বর্ষায় ময়ূর ছিল তাদের মাছ ধরার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। এর পানি ছিল স্বচ্ছ, গোসল-গৃহস্থালীর কাজ সবই চলত তা দিয়ে। নৌকা ছিল নিয়মিত বাহন।
তিনিও ময়ূরের মৃত্যুর জন্য আশির দশকের জলকপাট নির্মাণের কথা বলেন। সেইসঙ্গে প্রভাবশালীদের দখল নিয়েও আক্ষেপ করলেন।
সরজমিনে দেখা গেল, স্থানীয় বাসাবাড়ি থেকে নিয়মিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এই নদে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই তাদের কাছে। প্রশাসন থেকেও কখনও কিছু বলা হয়নি।
যদিও খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, “অবৈধভাবে কেউ নদী দখল-দূষণ করলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকেই ময়ূর দূষণের মূল কারণ হিসেবে বললেন পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক আরেফিন বাদল।
দখল-দূষণের কবলে থাকা ময়ূর বাঁচাতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান, খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ময়ূর নদকে বাঁচাতে খনন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে নদের দুইপাড় বাঁধাই করে ওয়াকওয়ে, দুইপাড়ের মাঝেমধ্যে সংযোগ সেতু, বিনোদনের জন্য নৌকা চালানোর ব্যবস্থা, পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।”
নকশা অনুযায়ীই নদ খনন করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “খননে কোনো গাফিলতি ও বাধা সহ্য করা হবে না।”
অবশ্য এর আগেও ময়ূর খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয় করে নদ খনন করা হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ কাজে আসেনি।
এবার প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ে গত ডিসেম্বরে আবারও ময়ূর নদ খননের কাজ শুরু করেছে খুলনা সিটি করপোরেশন। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, সঠিকভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে নদের প্রাণ ফেরার পাশাপাশি খুলনার জলাবদ্ধতা কমবে।
তবে গত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে খুলনার নাগরিক নেতারা বলছেন, এবার খননের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, পানিপ্রবাহ আর আগের মতো নেই, সেইসঙ্গে খননে অনিয়ম, পরিবেশ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা আর জবাবদিহিতার অভাবের মতো কারণ তো রয়েছেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, ময়ূর নদের দুইপাড়ের অংশ দখল করে অনেকেই বাড়ি নির্মাণ করেছেন। অবৈধ এসব স্থাপনা উচ্ছেদ ও সীমানা চিহ্নিত না করেই নদটি খনন করা হচ্ছে। খননের মাটি আবার পাড়ে রাখা হচ্ছে। ফলে বর্ষায় ওই মাটি ধুয়ে আবার নদেই মিশবে।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, “একবার এ নদ খননের টাকা পানিতে গেছে। দ্বিতীয়বার খননের আগে সীমানা চিহ্নিত করে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। তাই খনন প্রকল্পের সুফল মিলবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।”
নদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা উদ্ধার করে পিলার দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল বলে জানান খুলনার পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক কুদরত-ই-খুদা।
তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম শুধু নগর এলাকায় থাকা নদের অংশ খনন না করে রূপসার আলুতলা থেকে খনন শুরু করতে। সেটি সম্ভব না হলে সঠিকভাবে জলকপাট পরিচালনার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনায় সেসব দেখা যায়নি। তাই প্রকল্পটি নিয়ে আশাবাদী হওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”