জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, এখন পর্যন্ত হাওরে গড়ে ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
Published : 03 Mar 2024, 12:05 PM
নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। বাঁধ নির্মাণকাজের নির্ধারিত সময় ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। এ অবস্থায় আরও এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় পাগনা, হালি, মহালিয়া হাওরসহ একাধিক হাওর ঘুরে এই চিত্র দেখা যায়, মাটির কাজের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে বাঁশ, বস্তা, জিওটেক্স, কমপেকশন বাকি রয়েছে।
একই চিত্র শাল্লা, দিরাই, ধর্মপাশা, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, বিশ্বম্ভরপুরসহ সব হাওরেই।
এবার হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। যথাসময়ে বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় কৃষকরা।
এ বাঁধ রক্ষার কাজ আদৌ সম্পন্ন করা হবে কি-না; তা নিয়েও সন্দিহান স্থানীয়রা। সরজমিনে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, কাজ এখনও ৪০ ভাগের মত বাকি রয়েছে। তবে কাজ শেষ হয়নি স্বীকার করে এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর আবেদন করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর পওর বিভাগ-১ কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার ৩৭টি ছোট-বড় হাওরের ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে ৭৩৩ পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করা হয়।
১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ১ মার্চ পর্যন্ত ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করেছে পাউবো।
২০১৭ সাল থেকে কাবিটা প্রকল্পে (কাজের বিনিময়ে টাকা) হাওরের কৃষকদের মাধ্যমে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করে ফসল রক্ষাবাঁধের কাজ হচ্ছে।
তবে নীতিমালা অনুযায়ী কাজ না করে অকৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা কাজ বাগিয়ে নেন এমন অভিযোগও রয়েছে।
জেলা কাবিটা মনিটরিং কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী এবং পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার সদস্যসচিব হিসেবে নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে প্রকল্প গঠন ও অনুমোদন দেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হালির হাওরের ৪০ নম্বর প্রকল্পের ৪০ ভাগ কাজ এখনও বাকি রয়েছে। ১১ নম্বর থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত বাঁধগুলোর কাজেরও একই অবস্থা।
এর মধ্যে ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রকল্পে অর্ধেকের কাজ বাকি। ২০ ও ২১ নম্বর প্রকল্পে নামকাওয়াস্তে মাটি ফেললেও কমপেকশন ও দুর্বাঘাস লাগানো হয়নি।
২৪ নম্বর প্রকল্পে কেবল ক্লোজারে মাটি ফেললেও প্রকল্পের অন্য অংশে এখনও মাটি ফেলা হয়নি। ২৫ ও ২৬ নম্বর প্রকল্পের কাজও অসমাপ্ত রয়েছে।
একই উপজেলার মহালিয়া হাওরের ৬ নম্বর প্রকল্পে হিজলা ও নোয়াপাড়ার মধ্যখানে মাটি পড়েনি। এই হাওরের ৭ নম্বর প্রকল্পেও একই অবস্থা। কাজ সমাপ্ত হয়নি।
৬ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি জীবন কৃষ্ণ সরকার বলেন, “আমরা দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি। এক্সাভেটর পেতে সমস্যা হওয়ার কারণে মাটি ফেলায় সমস্যা হচ্ছে। তবে কাজটি এই সপ্তাহেই শেষ করব আশা করি।”
জামালগঞ্জ পাউবোর সেকশন কর্মকর্তা (এসও) জাহিদুল ইসলাম জনি বলেন, “হালির হাওরের পাঁচটি বাঁধের কাজ বাকি আছে। আশা করি তিন দিনের মধ্যেই প্রকল্পগুলোর মাটির কাজ শেষ হয়ে যাবে।
“তবে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে আরও ৮-১০ দিন লাগতে পারে। প্রতিদিনই আমরা হাওর ঘুরে ঘুরে কাজ দেখছি ও কাজ শেষ করতে নির্দেশনা দিচ্ছি।”
তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত শনির হাওরের ১ নম্বর প্রকল্পটি বৌলাই নদীর তীর ঘেঁষে নেওয়া হয়েছে। নদীর তীরে থাকায় বাঁধটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এই বাঁধে মাটি ফেললেও কমপেকশন ও দুর্বাঘাস লাগানো হয়নি। প্রকল্পে জিওটেক্স দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও দেওয়া হয়নি। শনির হাওরের ৩ নম্বর নান্টুখালি প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি।
এই প্রকল্পের সভাপতি জিয়া উদ্দিন বলেন, “আমরা মাটির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তবে এখনও ঘাস ও জিওটেক্স লাগানো যায়নি। জিওটেক্স আমরা পাইনি।”
জামালগঞ্জের পাগনার হাওরের ৩৩ নম্বর প্রকল্পেও কেবল দায়সারা মাটি ফেলা হয়েছে। ৪১ ও ৪২ নম্বর প্রকল্পে এই হাওরের সবচেয়ে বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার রয়েছে।
বোগলাখাড়া এলাকায় বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পগুলোতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এই ক্লোজারে এখনও কমপেকশন করা হয়নি। দুর্বাঘাস, বাঁশ, বস্তা, জিওটেক্স দেওয়া হয়নি।
দিরাই উপজেলার টাংনির হাওরের ২৭ ও ২৮ নম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এই ছুতোয় আরও পাঁচটি প্রকল্প বাড়ানোর তোড়জোর শুরু করা হয়েছে। কালিয়াগুটা হাওরের ২৭ ও ২৮ নম্বর প্রকল্পে এখনও অর্ধেক কাজ বাকি রয়েছে।
৬৬ ও ৬৭ নম্বর প্রকল্পে দুরমুশ করা হয়নি, লাগানো হয়নি ঘাস। ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরের ৫২ নম্বর প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়নি।
এই উপজেলার গোরাডুবা ও গুরমার হাওরের বাঁধগুলোর কাজও শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
হালি ও মহালিয়া হাওরের কৃষক গোপীনাথ নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দা রমেন্দ্র দাস বলেন, “আমাদের এই দুটি হাওরের বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। কিছু মাটি ফেলা হলেও দুরমুশ করা হয়নি। ঘাস, বাঁশ ও জিওটেক্স দেওয়া হয়নি।
“পাহাড়ি এলাকার বাঁধ হিসেবে এগুলোর কাজ আগে শেষ করা উচিত ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে এবং কাজের মানও সন্তোষজনক নয়।”
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, “হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ হলো ক্লোজার। ১৫৯টি ক্লোজারের মাটির কাজ এখনও শেষ হয়নি। দুরমুশকরণ, দুর্বাঘাস লাগানো, জিওটেক্স, বাঁশ-চাঁটাই দেওয়া হয়নি। কাজে বিলম্ব ও যথাযথভাবে কাজ সম্পন্ন না করায় পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকিতে আছে বাঁধগুলো।”
নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধের কাজ শেষ হয়নি স্বীকার করে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, “গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর জন্য আমরা আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা গড়ে ৯০ ভাগ কাজ শেষ করেছি।”