চলে গেলেন রণেশ মৈত্র

রণেশ মৈত্র ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারে।

পাবনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2022, 05:37 AM
Updated : 26 Sept 2022, 05:37 AM

ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও কলামিস্টের মত বহু পরিচয়ে পরিচিত রণেশ মৈত্র আর নেই।

সোমবার ভোর পৌনে ৪টার দিকে রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে পাবনা প্রেসক্লাবের সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদ জানিয়েছেন।

একুশে পদকপ্রাপ্ত এই বর্ষীয়ান সাংবাদিকের বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তার মৃত্যুতে পাবনার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

ভাষা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রণেশ মৈত্রের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এক শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, “আজীবন সংগ্রামী এ গুণী সাংবাদিক তার স্বীয় কর্মের মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

প্রধানমন্ত্রী রণেশ মৈত্র'র আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

পরিবারের সদস্যরা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে অসুস্থ ছিলেন রণেশ মৈত্র। জ্বর বাড়লে তাকে শুক্রবার ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রোববার রাতে তার অবস্থার অবনতি হয়। 

রণেশ মৈত্রর স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি। তাদের তিন মেয়ে, দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে থাকেন অষ্ট্রেলিয়ায়। তিনি দেশে পৌঁছানোরে পর শেষকৃত্য হবে বলে পরিবারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

রণেশ মৈত্রর জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর, রাজশাহী জেলার নহাটা গ্রামে। তার পৈত্রিক বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়ায়। বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

১৯৫০ সালে পাবনা জিসিআই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন রণেশ মৈত্র। ১৯৫৫ সালে সেখান থেকে এইচএসসি এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক শেষ করেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে রণেশ মৈত্র ছিলেন অগ্রণীদের কাতারে। ষাটের দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেল খেটেছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাবনায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে সেই কমিটির সদস্য ছিলেন রণেশ মৈত্র।

রণেশ মৈত্রর রাজনীতিতে হাতেখড়ি সেই ছাত্রজীবনে, ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে যোগ দিয়ে। ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তির পর তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দুবছর পর ৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর ন্যাপে যোদ দেন। ১৯৬৭ সালে যান মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপে।

রণেশ মৈত্র দীর্ঘদিন ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৩ সালে তিনি কামাল হোসেনের সঙ্গে গণফোরামে যোগ দেন। পরে ২০১৩ সালে যোগ দেন ঐক্য-ন্যাপে।

১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে রণেশ মৈত্রর সাংবাদিকতা শুরু। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর কাজ করে ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে।

এরপর ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ৬৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত টানা ২৫ বছর দৈনিক অবজারভারের হয়েও কাজ করেন তিনি। এছাড়া দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক এবং ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।

চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে গেছেন রণেশ মৈত্র। দীর্ঘদিন পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।

রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদারে রণেশ মৈত্র পাবনায় বাংলাদেশ অবজারভারের পাবনা প্রতিনিধি আব্দুল মতিন, প্রয়াত কামাল লোহানীসহ সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘শিখা সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সেখানে একটি পাঠাগারও গড়েন। ওই সংগঠন থেকে তিনি ‘শিখা’ নামে পত্রিকা বের করতেন। 

‘রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ’, তার জীবনীমূলক বই ‘নিঃসঙ্গ পথিক’, ‘আঁধার ঘোচানো বঙ্গবন্ধু’ রণেশ মৈত্রের লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

একজন আইনজীবী হিসেবেও নিজের শহরে তার পরিচিত রয়েছে।