নিজেদের কিডনি বেচে তারা এখন কিডনি বেচা-কেনার চক্রে

দরিদ্র মানুষের ঋণ আর অভাবকে পুঁজি করে নাটোরের গুরুদাসপুরে গড়ে উঠেছে ‘কিডনি বাণিজ্যের’ চক্র।

তারিকুল হাসান নাটোর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2023, 07:33 PM
Updated : 6 June 2023, 07:33 PM

এক যুগ আগে জয়পুরহাটে কিডনি বেচা-কেনার চক্রের সন্ধানে তোলপাড় উঠেছিল প্রশাসনে। পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অনেকে, মামলাও হয়েছিল বেশ কয়েকটি।

সেই ঘটনা প্রায় চাপা পড়ে গেলেও বেআইনিভাবে অঙ্গ বিক্রি থেমে নেই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে, জয়পুরহাটের কাছের জেলা নাটোরের গুরুদাসপুরে দাঁড়িয়ে গেছে তেমন একটি চক্র। দরিদ্র মানুষের ঋণ আর অভাবকে পুঁজি করে সেখানে চলছে ‘কিডনি বাণিজ্য’। সেখানে কেউ কেউ অভাবের তাড়নায় কিডনি বিক্রি করে এখন নিজেরাই অবৈধ এই অঙ্গ-বাণিজ্যের জাল বিস্তারে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।     

কিডনি বিক্রেতা, কিডনি গ্রহীতা, মধ্যস্থতাকারী এবং তাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুরুদাসপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম থেকে এক দশকে অন্তত ৫০ জন মানুষ তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। অভাবি মানুষেরা অর্থের লোভে নিজেরাই দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের কিডনি বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছেন। 

দালাল খুব গোপনে প্রথমে কিডনি দাতাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এখানে দাতার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, দাতা ও গ্রহীতার রক্ত সম্পর্কের কাগজপত্র তৈরি করা হয়। পরে তাদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই কিডনি প্রতিস্থাপনের মূল কাজটি হয় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। কারণ দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে এভাবে কিডনি দেওয়া যায় না।

গুরুদাসপুরের গাড়িষাপাড়া, আনন্দনগর, শিকারপুর-সাহাপুর, নাজিরপুর, চাঁচকৈড় বাজার, মধ্যমপাড়া, বামনকোলা, জুমাইনগর, খলিফাপাড়ায় অনুসন্ধান চালিয়ে গত এক মাসে পাঁচজন দাতা, দুজন গ্রহীতা এবং কিডনি দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন এমন একজনসহ ৯-১০ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। এই চক্রের ভেতরকার খবর পেতে কিডনি দাতা পরিচয় দিয়ে চলে এই অনুসন্ধান।

একজন গ্রহীতা জানিয়েছেন, তিন বছর আগে কিডনি প্রতিস্থাপনের সব কাজ শেষ করতে তার মোট ৪৪ লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে। আর গুরুদাসপুরের যে ব্যক্তি এই কিডনি দান করেছেন তিনি জানিয়েছেন, এ বাবদ তিনি মাত্র চার-সাড়ে চার লাখ টাকা পেয়েছেন। বাকি টাকা দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে গেছে।

কিডনি দানের পর এখন আর দাতারা ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না; যদিও সবাই নিজেদের সুস্থ বলে দাবি করেছেন। তবে যে অভাবের কারণে তারা কিডনি বিক্রি করেছিলেন, টাকা পেয়ে সেই অভাব হয়ত সাময়িকভাবে তাদের গিয়েছিল। কিন্তু অনেকেই আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, যারা এখন স্ত্রীর কিডনি বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছেন ঋণ থেকে মুক্তির আশায়।

তবে গুরুদাসপুরের চার থেকে পাঁচটি চক্রের কেউ, ঢাকায় কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি। দেশের বাইরে কারা এই চক্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের বিষয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯’ এ উল্লেখ আছে, ‘নিকটাত্মীয়’ অর্থাৎ পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুপু, মামা, খালা ও স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও শরীরের অঙ্গ নেওয়া যাবে না।

আইনে বলা আছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা উপহারের বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোনোপ্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোভাবে প্রচার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বেই উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে কিডনিজনিত সমস্যা। আর বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকলের শিকার হন।

চিকিৎসকরা জানান, চাহিদার তুলনায় দাতা কম বলে কিডনির বাজারমূল্যও উচ্চ। কিডনি রোগীদের বেঁচে থাকতে হয় ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে; যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল ও জটিল।

ঋণগ্রস্ত আর অভাবিরাই লক্ষ্য

স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার ছিল উপজেলার আনন্দনগরের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম আরিফের। মাঠে জমি ছিল, বাজারে ছিল দোকান। হঠাৎ করেই তার দুটো কিডনি অকেজো হয়ে যায়। রাজশাহী গিয়ে সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হত অন্তত ১০ হাজার টাকা। চিকিৎসার খরচ জোগাতে জমি, দোকান, স্ত্রীর গহনা, সবশেষ বসতভিটাও বিক্রি করে দেন। বড় বোন কিডনি দিতে চেয়েছিলেন, ম্যাচও করেছিল; কিন্তু বয়স বেশি হওয়ায় দিতে পারেননি।  

আরিফের বড় ভাই চাঁচকৈড় বাজারের কাপড় বিক্রেতা জাহিদুল ইসলাম জাহিদ এসব তথ্য যখন দিচ্ছিলেন তখন তার সজল চোখ; বলেছিলেন, “বড় আপা চেষ্টা করেও ভাইটাকে বাঁচাতে পারেনি।

“অন্যজনের কিডনি নেওয়ার আইন তো বাংলাদেশে নাই। আর কিডনি ব্যবসায়ীদের কাছে কিডনি নিয়ে ধরা পড়লে জেল-জরিমানার ভয়ে সে পথে আগাইনি আমরা। তারপর তো ভাই চলে গেল।”

আরিফুল ইসলাম আরিফ ‘রক্ত-সম্পর্কের’ বাইরে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে না পারলেও অন্যের কিডনি নিয়ে জীবন বাঁচাতে পেরেছেন উপজেলার নাজিরপুরের বেড়গঙ্গারামপুরের চল্লিশোর্ধ্ব মোকসেদ মিয়া (ছদ্মনাম)। তাকে কিডনি দিয়েছেন নাজিরপুর সামাদের মোড় এলাকার ভ্যান-রিকশা মেকানিক মো. কাসেম (ছদ্মনাম)। মোকসেদ মিয়ার সঙ্গে মো.কাসেমের রক্ত সম্পর্কের কোনো আত্মীয়তা নেই।

কাসেম স্বীকার করলেও মোকসেদ মিয়া তার কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, তিনি এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিডনি নিয়েছেন।

মোকসেদ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই কষ্টের বর্ণনা দেওয়া যাবে না। আমি বেঁচে আসছি। এখন আমি ভালো আছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।”

তিনি জানান, তার মোট ৪৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

মোকসেদ মিয়া ও মো. কাসেম উভয়েই ঢাকায় কিডনি প্রতিস্থাপনের দাবি করলেও প্রতিবেশী কয়েকজন বলেছেন, ভারতে গিয়েই তারা এ কাজ করেছেন।

তারা আরও বলেছেন, এ এলাকায় এ কাজের হোতা হচ্ছেন গাড়িষাপাড়ার আব্বাস মিয়া। অভাবে পড়ে তিনিও নিজের একটি কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে নিজেই এই ব্যবসায় হাত পাকান। এলাকায় যারা কিডনি বিক্রি করেন তাদের প্রায় সবাই আব্বাসের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছেন। এ ব্যবসা করে আব্বাস বেশ পয়সা কামিয়েছেন। উপজেলার খলিফাপাড়া পার্কের পেছনে নিজের বাড়ি বানিয়েছেন বলেও জানান এলাকাবাসী।

মো. কাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে স্বীকার করেন, তিনি অভাবে পড়েই নিজের কিডনি বিক্রি করেছেন। পরে আরও দুইডা কিডনি বিক্রির ব্যাপারে মধ্যস্ততা করেছেন। এখন নিজের স্ত্রীরটা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন।

শরীর কেমন আছে জানতে চাইলে কাসেম তার পেটের কাটা অংশ দেখিয়ে বলেন, “আমি আগেও যিরম আছিনু এখনও তাই আছি, আমার কুনো সমস্যা হয়নি। যারা দিছে, আমি কুতা কইছি, সমস্যা হয় না। আমি এখন ভ্যান চালাচ্চি, মাটি কাটতিছি, চুরাত পাট দিচ্চি, কুনাডাই বাদ নাই। আমার কুনো পবলেম হয়নি, মালিকের ওপর ভরসা করতে হয়।”

তিনি আরও বলেন, “আমি দুই-তিনডি লি গেছি, তারা অখুশি হয়নি। দুইডি লোক আমার সাথে আছে, আমি কাজ কুরাচ্চি। ঈদ (ঈদুল ফিতর) পরেই যাবো।

“ভালো মানুষ মরি যায় না। হায়াত যতক্ষণ আছে চাকুদি, হাতুড়দি বাড়িলে কি মরবি? এক সেকেন্ড হায়াত থাকলে জান বাড়াবিলে। আল্লার ওপর ভরসা রাকতে হবি।”

কাসেমের মতই অভাবে পড়ে ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করে এসেছেন সাহাপুরের মো. আতিক (ছদ্মনাম)। তবে কত টাকা পেয়েছেন তা জানাননি। এখন নিজেই ‘লোক জোগাড়’ করেন। তার তথ্য মতে, শুধু গাড়িষাপাড়াতেই ১৫ থেকে ২০ জন মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন আব্বাসের মাধ্যমে। প্রতিজন চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা করে পেয়েছেন।

একটি কিডনি দিয়ে চলতে কোনো সমস্যা হয় না বলেও জানান মো. আতিক। তিনি বলেন, “কুনো সমস্যাই হয় না, চলতিছি-ফিরতিছি। সমস্যা হয়; ভারি জিনিস তুলতে লাগলে একটু সমস্যা হয়।

পেটে কাটার দাগ দেখিয়ে বলেন, “ওইডি থাকলোল্যানি। ওইঠে একটা মুলাম (মলম) পাওয়া যায়, উরা যদি বড়ডা কিনি দিত, আমি ছুটোডা কিনছিনু, এই দাগ থাকতোই না।”  

আতিক এখন আবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, তাই স্ত্রীর কিডনি বিক্রির চেষ্টা করছেন বলেও জানান। বলেন, “আমি লাখ দুয়েক-আড়াইয়েক টিকা ঋণ হয়্যা গেছি। যতদুর সুম্বাব (সম্ভব) তোমার ভাবিক আমি কুরাবো; উইও কইছে, তুমি দেকো। কাগজপাতিও দিয়্যা দিছি। মানুষের ঋণ-পান হলে মানষেও খারাপ কয়, নিজেও নিজের কাছে খারাপ লাগে।”

চাঁচকৈড় মধ্যমপাড়া এলাকার সোহরাব (ছদ্মনাম) অভাবের তাড়নায় এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। এসময় তার সঙ্গে আব্বাসের পরিচয় হয়। পরে তার মাধ্যমেই কিডনি বিক্রির চেষ্টা করেন। প্রথমে ঢাকায় এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীকে কিডনি দেওয়ার চেষ্টা করেন; সব মিলেও যায়। কিন্তু পরে রোগী মারা গেলে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। কিন্তু তিনি আশা ছাড়েননি।  

সোহরাবের ভাষ্য মতে, “পাঁচ-ছয় মাস পরে আবার এইডি যোগাযোগ করি দিলো। যাকে দিছি, এইডি ঢাকায় হাসপাতালের ডাক্তার। দিল্লি লিয়া গেছিলো। দালাল যাওয়া লাগে না তো।

সব মিলিয়ে ১০-১১ মাস সময় লাগছে জানিয়ে সোহরাব বলেন, “এই দ্যাশের চিকআপের দাম নাই, ওই দ্যাশে লিয়া যায়ে ১২ দিনের মধ্যে আবার সব চিকআপ করে। আমার জিনিসটার সাইজ মিলি গেছিলো। ওর ২২ বাই ৪৪ সাইজ; আমারও ২২ বাই ৪৪ সাইজ ছিলো। ও একবারে সুস্থ আছে, হাসপাতালে ডাক্তারি করে। আমাকও আল্লাহ সুস্থই রাখছে।”

কিডনি বিক্রি করে কত টাকা পেয়েছেন তা না জানালেও সোহরাব বলেন, “ঋণের টাকা শোধ করতে বলছিলাম, চার লাখ ৭২ হাজার টাকা হইছিলো। অনেকে ১০ লাক, অনেকে ৮ লাকও দেয়।”

তবে অনেক সময় কিডনি দাতা প্রতিশ্রুতি মত টাকা পায় না বলেও জানান সোহরাব। বলেন, “যারা রোগী তারা টাকা মার দেয় না, অনেকের টাকা মার যায় দালালের কারণে।”

সোহরাবের কিছু টাকাও প্রথমে দালাল মেরে দিয়েছিল। পরে তিনি উদ্ধার করতে পেরেছেন বলে জানান।

সোহরাবের কিডনি বেচার খবর জানেন এলাকার প্রায় সবাই।

মধ্যমপাড়ার এক মুদি দোকানি বলেন, “সোহরাব আমারে কাছে আসি গল্প করিচে কিডনি বিচার কুতা। ইরা অভাবে পড়িই কিডনি বেচিছে। বেচিটেচি ঋণটিন শোদ করি এখন আবার ঋণে পড়িছে। ইরা সব আব্বাসের লাইনে বেচছে।”

জুয়া খেলে ঋণ, তারপর কিডনি বেচার উদ্যোগ

জুয়া খেলতে গিয়েই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন উপজেলার সাহাপুর-বামনকোলা এলাকার সামাদ (ছদ্মনাম)। তিনি তখন ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করতেন। অভাবের কারণে সংসারে অশান্তি দেখা দেয়। একপর্যায়ে নিজের কিডনি বিক্রির উদ্যোগ নেন।

এজন্য তিনি দালালের মাধ্যমে অনেকটা পথ হাঁটেন, পরীক্ষা-নীরিক্ষাও করান। চার লাখ টাকায় আপসরফা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্রুপ ও অন্যান্য বিষয় না মেলায় আর কিডনি বিক্রি করতে পারেননি। তবে এখনও আশা ছাড়েননি সামাদ।

তিনি বলেন, “আমি ঋণপাতি হইছি। বউ-ছয়ালেক পুশাক-আশাক দিতে পারতিছি না, ভালোমুন্দ বাজার-সুদায় করতে পারতিছি না। বউ নানান কুতা কয়। তখন ভাবি আমিও কাজটা করি আসি। ত্যালে বউ-ছয়ালের মুকেও হাসি ফুটাতে পারতিছে, ঋণ থাকলেও দিতে পারতিছে।

“আর দুই লাখ টিকা দিয়ে যদি দোকান দিয়ে বসি তার ভবিষৎ চলি যাবি ২০ বছর। এরম স্বপ্ন দেকি এই কাজগুলি করে।” 

নিজের কিডনি কেন বিক্রি করতে পারলেন না- জানতে চাইলে সামাদ বলেন, “পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিনু, বি নেকেটিপ হইছিলো। তবু সেট খায়নি। আমার শ্বশুর মাঝে কিছু টিকা-পয়সা দিয়্যা হেল্প করি আমাক বাঁচায় লিয়া আসলো।”

‘ম্যাচ’ না হওয়ায় ফিরে এসেছেন মধ্যমপাড়ার গৃহবধূ ফেরদৌসি (ছদ্মনাম)। তবে একই সময় কাজল (ছদ্মনাম) নামে একজনের ‘ম্যাচ’ হয়েছে এবং তিনি কিডনি দিতে ঢাকায় আছেন (কয়েক সপ্তাহ আগে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়) বলেও জানান সামাদ। কাজল এর আগে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কিডনি বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী ভয় পেয়ে ঢাকা থেকে চলে আসেন। পরে কাজলই কিডনি বিক্রি করেন।

শিকারপুর-সাহাপুর এলাকার একটি মিলের শ্রমিক মো. আতিকুল (ছদ্মনাম) স্বীকার করেন তিনি চরম অর্থাভাবে পড়েই ভারতে গিয়ে কিডনি বিক্রি করেন। তবে এখন কিডনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না বলে জানান।

আতিকুলের বাড়ি গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কথা বলার সময় তার স্ত্রী ও মেয়ে এ নিয়ে কথা না বলার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কথা বলতে দিতে চাইছিলেন না তারা, পরে বোঝালে তারা শান্ত হন। 

একপর্যায়ে আতিকুল নিজের জামা খুলে পেটের কাটা দাগ দেখান। তবে এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেন তিনি। বিশেষ করে দালাল আব্বাসের বিষয়ে কথা বললে বিপদ হতে পারেও গল্পছলে হুমকি দেন তিনি।

একই এলাকার কয়েকজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এখন আতিকুলের স্ত্রীও নিজের কিডনি বিক্রির চেষ্টা চলাচ্ছেন।

তবে আতিকুল এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

কিডনি ব্যবসা করেই আব্বাসের উত্থান

গুরুদাসপুরের কিডনি বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট যার সঙ্গেই কথা হয়েছে, তারাই মধ্যস্ততাকারী হিসেবে আব্বাসের নাম বলেছেন। এলাকার অনেকেই আব্বাসের এই ব্যবসার কথা জানেন। আব্বাস অন্তত ১৫ বছর আগে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। এখন নিজেই বাণিজ্যে যুক্ত বলে স্থানীয়রা জানান।

গুরুদাসপুরে কিডনি বাণিজ্যের এমন চার থেকে পাঁচটি চক্র আছে বলেও ধারণা দেন সংশ্লিষ্টরা।  

আব্বাস একসময় ভ্যান চালাতেন, দিনমজুরি করতেন। একসময় নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে উপজেলা সদরের ভাতপট্টি এসে ভাড়া বাসায় উঠেন। পরে সেখান থেকে ঢাকায় চলে যান। রাজধানীতে তিনি রিকশা চালাতেন। সেসময়ই তিনি নিজের কিডনি বিক্রি করেন।

এখন তিনি মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ান। উপজেলা সদরে বাড়ি করেছেন। দান-খয়রাতও করেন বলে জানান এলাকাবাসী।

গারিষাপাড়ার এক ধান-চাল ব্যবসায়ী বলেন, “ই ইলাকার সব মানুষই আব্বাসের কিডনি বিচার কুতা জানে। উই যে কিডনি বিবসা করে ইতাও সবগুলা জানে। আমরা তো আব্বাসেরে ছোটবিলা থেকি চিনি, কুনোভাবে দিন গেছে ওরে। ঝই ঝামেলা ল্যাগিই থাকছে। কিডনি বিচার পর থেকি অনেক পরিবর্তন হয়া গেছে। লতুন বাড়িটারিও করছে, খোঁজ লিলেই সব জানা যাবি।”

আনন্দনগরের এক ঠিকাদার বলেন, “আব্বাস আমারে ইলাকার অনেকেকে লিয়া গেছিলো ইন্ডিয়া। কিডনি বেচি খুব ভালো চলে আব্বাসের। উই যে কিডনির বিবসা করে কমবেশি সব মানুষই জানে।“

মধ্যমপাড়ার ইটভাটার এক ম্যানেজার বলেন, “আব্বাসের কুতা যাক ই সুদ (জিজ্ঞাস) করবেন, সম্পর্ক থাকলে সেই কবি, ‘কিডনি বিচা আব্বাস’। অনেকেই দিছে। কিন্তু খয়বার ছিড়া কেউই শিকির খায় না।”

চাঁচকৈড় বাজারের এক মুদি দোকানি বলেন, “গুরুদাসপুর কিডনি বিবসার মূল হচ্চে আব্বাস। নিজে দিয়ার পরে সবগুলাক দিখায় দেকো, আমারতো কুনো সমস্যা হয়নি।”

চাঁচকৈড়ের আরেক পানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “আব্বাসের পরিবর্তন রাতারাতি হয়া গেছে। গারষিপাড়া থেকি এখন আনান্দনগর যায়ে বাড়ি করছে। একেক সময় একেক মোটরসাইকেল লিয়া ঘুরে। উইতি কিডনি বিবসার মূল।”

আব্বাস নিজের কিডনি বিক্রির কথা স্বীকার করলেও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

তিনি মোবাইল ফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বললেও পরে আর সরাসরি কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। নিজের অবস্থানের ভুল তথ্য দিচ্ছিলেন।

ঈদুল ফিতরের পরে (২৫ এপ্রিল) গুরুদাসপুরের আনন্দনগর পার্কের মসজিদে নামাজ শেষে বেরিয়ে আসার পর আব্বাসের সঙ্গে কথা হয়।

আব্বাস তখন এই প্রতিবেদককে চাঁচকৈড় বাজারের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর দোকনে নিয়ে যান। তখন সেখানে আরও অনেকেই আসেন।

আব্বাস বলেন, ২০-২৫ বছর আগে অভাবে পড়ে তিনি কিডনি বিক্রি করেছেন। তবে কিডনি বাণিজ্যের অভিযোগ ‘মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট’।

এ নিয়ে প্রতিবেদন না করতে প্রতিবেদককে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হুমকিও দেন। কৌশলে নিজের জন্য দোয়া চেয়ে বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ হলে তার সম্মানহানি হবে।

অন্ধকারে পুলিশ ও প্রশাসন

গুরুদাসপুরের কিডনি বাণিজ্যের বিরাট একটি চক্র দাঁড়িয়ে গেলেও পুলিশ এবং প্রশাসন এ বিষয়ে কিছু জানে না। এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা খুব সাবধানী এবং গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে তৎপর। পরিচিত মাধ্যম ছাড়া কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতে চান না।  

দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়ের বাইরে গিয়ে কিডনি দান অপরাধ।

নাটোর জজ আদালতের আইনজীবী আতাউর রহমান লিটন বলেন, “কারো নিকটাত্মীয় কেউ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি বা ক্রয় কিংবা সহায়তা ব্যাপারে প্রমাণ হলে সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।”

কিডনি বিকল হতে থাকলে ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিসের চেয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন রোগীর জন্য অনেক সহজ বলে মনে করেন গাড়িষাপাড়া এলাকার বাসিন্দা চিকিৎসক খালিদ হাসান।

রংপুর প্রাইম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের কার্ডিওলোজি বিভাগের এই চিকিৎসক বলেন, “কিডনি রোগ একটি জটিল রোগ এবং চিকিৎসাও খুবই ব্যয়বহুল। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়।

“প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। একজন কিডনি রোগীকে প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিসের পেছনে ব্যয় করতে হয় গড়ে ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা। উচ্চ ব্যয় অস্বচ্ছল রোগী তো দূরের কথা, অনেক ধনাঢ্য পরিবারের রোগীর পক্ষেও আজীবন বহন করা সম্ভব হয়ে উঠে না।

চিকিৎসক বলেন, “অথচ কিডনি অকেজো হয়ে পড়লে একে কৃত্রিমভাবে চালু রাখা বা ডায়ালাইসিসে যে পরিমাণ খরচ হয় তার চাইতে সহজ উপায় কিডনি প্রতিস্থাপন। এ কারণে মানুষ যে কোনো উপায়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের দিকে ঝুঁকে।“

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেজ অ্যান্ড ইউরোলজির পরিচালক অধ্যাপক বাবরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশের আইনে অবৈধভাবে কিডনি প্রতিস্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। যেসব চিকিৎসক কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেন তারা সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন। দাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পর্ক নিশ্চিত করতে হয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গ বেচাকেনা হতে পারে না। এটা আইনসিদ্ধ নয়, মানবিকও নয়।

“এই সুযোগ দিলে যাদের টাকা আছে শুধু তারাই ট্রান্সপ্লান্টের সুবিধা নিবে। তাহলে গরিব রোগীরা কোথায় যাবে? এটা মানবিকভাবেও সম্ভব না। যারা অর্থের বিনিময়ে কিডনি দান করছে তারা সেটা করতে সক্ষম কি না, সেটাও জানে না। এটা করে সেও ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে। এজন্য এসব কাজ ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে যে বিষয়টি বেআইনি।”

তিনি বলেন, “বিশ্বে কিডনি প্রতিস্থাপনের আশি শতাংশের বেশি হয় ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্লান্ট। আইসিইউতে থাকা মুমুর্ষূ রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এই পদ্ধতিটি উৎসাহিত করতে হবে, মানুষকে বোঝাতে হবে।”

কিডনি বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে গুরুদাসপুর থানার ওসি মোহা. মোনায়ারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ব্যাপারে এখনও কিছু জানি না কারণ এ কাজ কেউ করলেও গোপনে করে। এখনও এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেনি। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব।”

গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শ্রাবণী রায় বলেন, “গুরুদাসপুরে কিডনি বিক্রি ও বাণিজ্যের ব্যাপারে আমার জানা নেই। জানলে আমারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব। আমার আওতার মধ্যে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।”

নাটোরের গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, “এ ব্যাপারে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। এ ধরনের তথ্য বা অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে সত্যতা পেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাসের ভুঁঞা বলেন, “বিষয়টা জানতাম না। আমরা এ বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াব। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”