তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে কারখানার সব মালামাল ও ভবনটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। সেদিনের পর থেকে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও পুড়ে যাওয়া আটতলা ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটনার আশঙ্কা আশেপাশের বাসিন্দাদের।
Published : 24 Nov 2023, 04:47 PM
ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল, তাতে যারা প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন তাদের জীবন কাটছে শরীর-মনের যন্ত্রণা নিয়ে।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ওই অগ্নিকাণ্ডে ১১১ পোশাক শ্রমিক নিহত হন। আর আহত হন শতাধিক শ্রমিক; যাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। যারা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জীবন আরও বিষাদময়। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও অনেকের ভাগ্যে আর চাকরি জোটেনি।
তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ১১ বছর পূর্তির দিনে শুক্রবার সকালে নিহতদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের স্মরণ করেছে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ শ্রমিকরা।
তাজরীন ফ্যাশনের সামনে ফুল দিয়ে নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তারা। এ সময় নিহতের স্বজন, আহত শ্রমিক ও ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে এবং তাদের পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
অগ্নিকাণ্ডে তাজরীন ফ্যাশনস কারখানার সব মালামাল ও সম্পূর্ণ ভবনটি পুড়ে যায়; যার ছাপ এখনও স্পষ্ট। সেদিনের পর থেকে ভবনটির কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলেও জরাজীর্ণ আটতলা ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। ফলে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটার আতঙ্কে রয়েছেন ভবনটির আশেপাশের বাসিন্দারা।
তাজরীনের শ্রমিক নাসিমা আক্তার সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরে দুর্বিসহ যন্ত্রণা তার নিত্য সঙ্গী।
নাসিমা বলেন, “আমার মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙা। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচতে হবে। বর্তমানে আমি একটি ঝুটের গোডাউনে দিনে দৈনিক ২০০ টাকায় কাজ করি। সেখানে যেতে আমি বাধ্য হয়েছি, কারণ আমার চাকরি হচ্ছিল না। আমি অনেক ফ্যাক্টরির সামনে গিয়েছি। কেউ আমাকে চাকরি দেয় নাই।”
আরেক শ্রমিক রেহেনা আক্তার সেদিন আগুন থেকে বাঁচতে লাফ দিলে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। নাসিমার মত কোথাও কাজ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তিনিও।
রেহেনা বলেন, “আমি কোনো কাজ করতে পারি না। ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। আমরা আহত, তাই কেউ চাকরিতে নেয় না। আমার চিকিৎসার টাকার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়। তাই আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হতো।”
তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনায় এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক মহসীন উজ্জামান খান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন, যাতে দেলোয়ার ও তার স্ত্রীসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়।
বাকি আসামিরা হলেন- প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, কারখানা ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, কোয়ালিটি ম্যানেজার শহিদুজ্জামান দুলাল, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল।
সেই ঘটনার ১১ বছর হতে চললেও বিচার শেষ হয়নি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন বলেন, “১১ বছর পার হলেও কোনো বিচার হয়নি বরং পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, মালিক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতির পদ দেওয়া হয়েছে। এটা এক ধরনের পুরষ্কার।”
“বিভিন্ন সময়ে বলা হচ্ছে সাক্ষীর অভাবে মামলা শেষ করা যাচ্ছে না। অথচ আহত শ্রমিক, স্থানীয়সহ সবাই সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত। এটি বিচার না করার অজুহাত।”
ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স (ইউএফজিডব্লিউ) এর সাভার আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. ইমন শিকদার বলেন, “তাজরীন ট্রাজেডির ১১ বছর পার হয়ে গেলো। এখনও এই ঘটনায় খুনি দেলোয়ারসহ জড়িতদের শাস্তি হয়নি। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হোক।”
বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. কবির হোসেন বলেন, “তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার আহত শ্রমিক অনেকেই অসুস্থ অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। এখনও অসুস্থতা নিয়ে অনেক শ্রমিক কষ্টে দিন পার করছে।”
১১ বছরেরও কেনো বিচার শেষ হয়নি জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, “তাজরিনের ঘটনাটি বেদনাদায়ক। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। বিচারকাজ যাতে তরান্বিত হয়, সেদিকে আমরা নজর রাখছি। আমাদের সব রকমের প্রচেষ্টা থাকবে।”