পিটিয়ে চারজনকে হত্যা: বিচার নিয়ে ‘সন্দিহান’ স্বজনরা

এর মধ্যে ‘সামাজিক বাধার কারণে’ একজনের লাশও নিতে আসেননি পরিবারের সদস্যরা।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2024, 04:18 PM
Updated : 19 March 2024, 04:18 PM

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে চারজনকে হত্যার ঘটনায় বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন স্বজনরা। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ অপরাধী হলেই তাকে এভাবে পিটিয়ে ফেলা হবে কেন?

এর মধ্যে ‘সামাজিক বাধার কারণে’ একজনের লাশও নিতে আসেননি পরিবারের সদস্যরা।

এদিকে রোববার রাতের এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় আসামির সংখ্যা উল্লেখ না করে অজ্ঞাত ‘উত্তেজিত অনেক গ্রামবাসীকে’ আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সোনারগাঁ থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান।

মঙ্গলবার সকালে থানার এসআই মামুন খান বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। তবে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানান ওসি।

রোববার রাতে সোনারগাঁ উপজেলার বাঘরী বড়বিলে ডাকাত সন্দেহে পাঁচজনকে গণপিটুনি দেয় আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ। এর আগে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্রামবাসীদের একত্র করা হয়।

এতে চারজন মারা যায় এবং একজন আহত অবস্থায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন।

নিহতরা হলেন- সোনারগাঁ উপজেলার রাজাপুর শেখেরহাট গ্রামের আমান উল্লাহর ছেলে জাকির হোসেন (৩৬), আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের শামসুল হকের ছেলে আব্দুর রহিম (৪৮), একই উপজেলার জালাকান্দী গ্রামের মজিদ হোসেনের ছেলে নবী হোসেন (৩৫) এবং একই উপজেলার মর্দাসাদী গ্রামের প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে শের আলী (৩৩)।

দুপুরে নিহত আব্দুর রহিমের ছোট ভাই আব্দুর রহমান এবং নবী হোসেনের বড় বোন নাজম বেগম দুজনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে বুঝে নেন।

পেশায় মাছবিক্রেতা আব্দুর রহমান বলেন, তাদের গ্রামের বাড়ি আড়াইহাজার উপজেলার কালাপাহাড়িয়ায় হলেও রহিম ১৫ বছর যাবৎ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকতেন সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে। তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।

“আমার এই বয়সে আমি কখনও শুনি নাই যে, কেউ রাত ৯টা বাজে ডাকাতি করতে যায়। এই সময় তো মানুষজন এমনিতেই জাগনা (জেগে) থাকে। তার উপর এখন রমজান মাস। ডাকাতি করতে গেলেও তো পুলিশ আছে, এমনে পিটাইয়া কেউ কাউরে মারে না। পুলিশে তো দিতে পারতো তারা।”

কাঁদতে কাঁদতে আব্দুর রহমান বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। আমরা জানি না কীভাবে কী করমু? সব গ্রামের লোকজন মিইল্লা মারছে, কার বিরুদ্ধে মামলা করমু? কী হইবো জানি না, কিন্তু আমরা ভাই হত্যার বিচারটা খালি চাই। বিচার পামু কিনা তাও তো জানি না।”

নবী হোসেনের বোন নাজমা বেগম বলেন, “মানলাম, আমার ভাই অপরাধী। কিন্তু তার তো এমন মরণ হইতে পারে না। কতগুলা মানুষরে মারছে! এই দেশে কী আইন-আদালত বলতে কিছু নাই? সব কী উইঠা গেছে?”

নবী হোসেন আড়াইহাজারে একটি কার্টন তৈরির কারখানায় চাকরি করতেন বলে জানান তার স্বজনরা। তার নয় মাসের একটি সন্তান রয়েছে। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে একটু পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন বলে জানান তারা।

লাশ নিতে সামাজিক বাধা

এদিকে সোমবার রাত পর্যন্ত শের আলীর মরদেহ অজ্ঞাত হিসেবে মর্গে ছিল। মঙ্গলবার তার পরিচয় পাওয়া যায়।

সোনারগাঁ থানা পুলিশ জানায়, শের আলীর বিরুদ্ধে ডাকাতি ও অস্ত্রসহ অন্তত আটটি মামলা রয়েছে। ছয় মাস আগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার জামিনে ছাড়া পান। এর দুইদিন পরই গণপিটুনিতে নিহত হলেন তিনি।

সোনারগাঁও থানার ওসি কামরুজ্জামান বলেন, শের আলীর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো সাড়া দেননি। রাতের মধ্যে মরদেহ তারা গ্রহণ না করলে আঞ্জুমানে মফিদুলের মাধ্যমে নিহতের মরদেহ দাফন করা হবে।

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে শের আলীর ভাতিজা পরিচয় দিয়ে জুয়েল রানা বলেন, “শের আলীর বাবা-মা বেঁচে নেই। দুই বিয়ে করলেও স্ত্রীদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। স্বজন বলতে দুই ভাই ও দুই বোন রয়েছে।

“আমরা সোমবারই ফেইসবুকে তার ছবি দেইখা চিনছি। লাশ আনার কথাও ভাবছিলাম। কিন্তু গ্রামবাসী তার লাশ আনতে বাধা দিলে আমরা আর যাইনি।”

মামলায় শাস্তি পায় না কেউ

২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পুরিন্দা বাজারের একটি চালের আড়তে ডাকাতি চেষ্টার অভিযোগে আটজনকে পিটিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় গ্রামবাসী। আহত অবস্থায় আরও চারজনকে উদ্ধার করা হয়; যাদের পরবর্তীতে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

ওই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আড়াইহাজার থানার এসআই আব্দুল্লাহ আল মামুন বাদী হয়ে একটি হত্যা দায়ের মামলা করেন। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে ১০০০-১২০০ জনকে আসামি করা হয়। যদিও এই মামলায় কোনো আসামিকেই শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ জানায়, মামলাটির তদন্ত করেন আড়াইহাজার থানার এসআই মো. সেলিম মিয়া। তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০২১ সালের মে মাসে এই মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে আদালতে তা গৃহীত হয়।

তবে, একই ঘটনায় ‘ভাই ভাই ট্রেডার্স’ নামে প্রতিষ্ঠানের মালিক গফুর ভূঁইয়া বাদী হয়ে গণপিটুনির ঘটনায় আহত হওয়া চারজন ব্যক্তিসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগে একটি মামলা করেন।

এই মামলাটির তদন্ত করেন ওই থানার এসআই ফিরোজ আহম্মেদ। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে এই মামলায় এজাহারভুক্ত চারজনসহ মোট নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। মামলাটি অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

আরও পড়ুন:

Also Read: ‘মসজিদের মাইকে লোক ডেকে’ চারজনকে পিটিয়ে হত্যা

Also Read: নারায়ণগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে ৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা