‘আমার স্বামীর কোনো অপরাধ ছিল না, অযথাই মাইরা ফেললো’

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাজলের সঙ্গে বেশি খাতির ছিল তার বড় মেয়ে নুসরাতের। গত ১২ জানুয়ারি বাবার জন্মদিনে বাসায় উদযাপন করে মেয়ে।

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Feb 2023, 04:53 AM
Updated : 8 Feb 2023, 04:53 AM

আছরের নামাজ শেষ হতেই মসজিদের মাইকে ভেসে আসে শোক সংবাদ। এই সংবাদ শুনতে চান না আসমা জামান; তাই দুই হাতে কান চেপে ধরে আছেন। পাশে বড় মেয়ে নুসরাত জাহান শ্রাবণও বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। আর ছোট মেয়ে তাসনিয়া তারান্নুম ইকরা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গুলিতে নিহত নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ার ‘সুলতান ভাই কাচ্চি’ রেস্তোরাঁর মহাব্যবস্থাপক শফিউল আলম কাজলের বাড়িতে মঙ্গলবার এমন শোকাবহ পরিবেশ দেখা যায়।

সোমবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আসমা জামানের স্বামী ৪৭ বছর বয়সী কাজল। পানি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ নিয়ে রেস্তোরাঁ মালিক ও ভবন মালিকের দ্বন্দ্বে রোববার রাতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

নিহত কাজলের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কুশিয়ারা গ্রামে। পৈত্রিক ভিটার উপর একতলা ভবনের এক ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন তিনি। বড় মেয়ে নুসরাত জাহান শ্রাবণ (১৮) নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। আর ছোট মেয়ে ১১ বছরের তাসনিয়া তারান্নুম ইকরা কুশিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।

কাজলের বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেলো, আত্মীয়-স্বজনরা আসমা জামানকে ঘিরে রয়েছেন। কিন্তু তাদের কোনো সান্ত্বনাই ধরে রাখতে পারছিলো না সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে অকূল-পাথারে পড়া আসমাকে। মেঝেতে পাতা বিছানার উপর বসে অনবরত কেঁদেই চলছিলেন তিনি।

কিছুটা শান্ত হবার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আসমা বলেন, “পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল আমার স্বামী। রেস্টুরেন্টে অনেকবছর ধরে কাজ করলেও বেতনটা মাত্র বেড়েছিল। সামনে সুখের দিন ছিল। কত স্বপ্ন ছিল; কত আশা ছিল, সব শেষ। দুইটা মেয়েরে নিয়ে আমি কী করবো, কিছুই ভাবতে পারছি না।”

কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে দুই কন্যার এ জননীর। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলেন, “সাজানো গোছানো সংসার ছিল আমার। আমার স্বামী পরিবারভক্ত মানুষ ছিলেন। স্ত্রী-কন্যারা কী খাইবো, কী পরবো সেইটা নিয়াই সবসময় পইড়া থাকতো। মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারেও সবসময় খোঁজখবর রাখতো।

“আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও কোনকিছুর কমতি রাখতো না। জীবনটা যে কী হইয়া গেল!”

স্বামী হত্যার বিচার দাবি করে তিনি আরও বলেন, “আমার স্বামীর সাথে তো কারও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল না। কোনো অপরাধও ছিল না তার। অযথাই তারে গুলি কইরা মাইরা ফেললো। একটা মানুষ না, খুন হয়েছে পুরো পরিবার। এখন আমার একটাই অনুরোধ, যে লোক আমার স্বামীকে গুলি করে মারছে তার যেন ফাঁসি হয়।”

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাজলের সঙ্গে বেশি খাতির ছিল তার বড় মেয়ে নুসরাতের। গত ১২ জানুয়ারি কাজলের জন্মদিনে বাসায় উদযাপনের আয়োজন করে মেয়ে। সেদিন কাজল আনন্দে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন। সেই আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই বাবা চিরদিনের মত ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। এ যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না নুসরাত।

বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই চোখ বেয়ে অঝরে জল গড়িয়ে পড়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া এ তরুণীর। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাবা আমাদের দুই বোনকে খুবই আদর করতেন। রাতে ঘুমানোর সময় ঠিকমতো কম্বল গায়ে দিয়েছি কিনা দেখতেন। না দিলে গায়ে জড়িয়ে দিতো। রাতে কাজে থাকলে আমাকে ফোন দিয়ে কথা বলতে কখনই ভোলেননি। সেই বাবা নেই আমি বিশ্বাস করতে পারতেছি না। নিজেকে খুবই হেল্পলেস (অসহায়) মনে হচ্ছে।”

কথা বলতে বলতেই ঢুকরে কেঁদে ওঠেন নুসরাত। কিছুটা সামলে আবার বলেন, “রোববার দুপুরেও বাবা যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখনও আমাকে পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা না করার জন্য অভয় দেন। এখন রেজাল্ট আসলে কাকে জানবো সেই কথা?”

ময়নাতদন্তের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে মঙ্গলবার বিকালে কাজলের লাশ নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় তার কর্মস্থল সুলতান ভাই কাচ্চি রেস্তোরাঁর সামনে নেওয়া হয়। রেস্তোরাঁর সামনে নবাব সলিমউল্লাহ সড়কে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করেন তার সহকর্মী ও স্বজনরা। তারা কাজলের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। এই সময় সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়।

প্রত্যক্ষদর্শী রেস্তোঁরার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, পানি ও বিদ্যুতের বিল নিয়ে যে ভবনে রেস্তোরাঁটি অবস্থিত তার মালিকের সঙ্গে তাদের মালিকের দ্বন্দ্ব চলছিল। গত রোববার রাতে এ নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে ভবনের মালিক আজহার তালুকদার হাতে একটি পিস্তল ও একটি শটগান নিয়ে আসেন।

পরে ওই পিস্তল ও শটগান দিয়ে একাধিক গুলি ছোড়েন। এই সময় গুলিবিদ্ধ হন কাজল। প্রথমে তাকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে নেওয় হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ ঘটনায় সোমবার সকালে রেস্তোরাঁ মালিক শুক্কুর আলী বাদী হয়ে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার আজহার তালুকদার ও তার ছেলে আরিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুইদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

নায়ারণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আনিচুর রহমান মোল্লা জানান, আজহার তালুকদার ও তার ছেলে আরিফ তালুকদারকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলাটি হত্যার চেষ্টার অভিযোগে করা হলেও যেহেতু ভিক্টিম মারা গেছেন, এটি এখন হত্যা মামলা হিসেবেই তদন্ত করা হবে।

আজহার তালুকদারের নামে লাইসেন্স করা একটি পিস্তল ও একটি বন্দুক রয়েছে। অস্ত্র দুটি পুলিশ জব্দ করেছে বলেও জানান ওসি।