“আমার ছেলে মাহবুব হত্যার বিচার চাইয়া থানায় মামলা করছি। আমার ছেলে কোনো অপরাধ করে নাই। কেন তারে গাড়ি চাপা দিয়া মারলো।”
Published : 21 Aug 2024, 09:29 AM
“আমার ছেলে তো কোনো অপরাধ করে নাই। কেন তারে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির চালক চাপা দিয়ে মারল।” এভাবেই প্রলাপ করছিলেন শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষের সময় গাড়ি চাপায় নিহত মাহবুব আলমের মা মাফুজা খাতুন।
গত ৪ অগাস্ট বিকালে শেরপুর শহরের নতুন আইডিয়াল স্কুলের সামনের সড়কে মিছিলে গুলি চালানো হয়। তখন আন্দোলনকারীরা ভয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। সেসময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বহনকারী একটি সাদা পিকআপভ্যান দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে চলে যাওয়ার সময় চাপা পড়ে নিহত হন মাহবুব বলে খবরে এসেছে।
ঘটনার ১৩ দিন পর শনিবার বিকালে মাহবুবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তার মায়ের কান্না থামেনি। এখনও ছেলের শোকে তিনি বিলাপ করছেন। অভিযোগও করেন ওই গাড়ি চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো নিয়ে।
“আমি আমার প্রাণের টুকরা ছেলের হত্যার বিচার চাই,” বলে অনবরত কেঁদে চলেছেন তিনি। স্বজনরাও আহাজারি করছেন।
শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের তারাগড় কান্দাপাড়া গ্রামের মিরাজ আলী ও মাফুজা খাতুন দম্পতির ছেলে মাহবুব পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। মাহবুবের বড় দুই বোন মিলিনা ও সেলিনার বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর ছোট বোন মারিয়া চলতি ২০২৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
মাহবুবের বাবা ১৭-১৮ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। তার মা গৃহিণী। তারাগড় কান্দাপাড়া গ্রামে ৮ শতাংশ জমির বসতভিটা ছাড়া আর কোন ফসলি জমি নেই তাদের। পরিবারের সদস্যরা জানান, বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় ছেলে জানাজার নামাজেও শরিক হননি।
মাফুজা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “অনেক কষ্ট কইরা পোলাপানগরে মানুষ করছি। স্বামী থাকলেও মানসিক ভারসাম্যহীন। আমি প্রথমে তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। পরে বিড়ি বাইন্দা, হাঁস-মুরগি ও গরু পাইল্লা পোলাপান গরে ডাঙর কইরা এই পর্যন্ত আইছি। বাড়িতে একটি মাত্র টিনের ঘরেই আমাদের বসবাস।
“মাহবুব পড়ালেখার পাশাপাশি কম্পিউটার ট্রেনিং করাইয়া, টিউশিনি কইরা নিজের খরচ চালাইত এবং সংসারের খরচ দিত। ছেলেডা মরার কিছুদিন আগে আমারে কইছে আমরা অহন বড় অইছি। কামাই রোজগার করতাছি। তোমার আর গরু পাইল্লা কষ্ট করুন লাগবো না। মা তোমারে একটা ঘর কইরা দিমু।”
চোখের জল মুছতে মুছতে মাফুজা খাতুন ছেলের সঙ্গে পুরানো কথপোকথনের ঝাঁপি খোলেন। বলেন, “একমাস আগে ঘর করার লাইগা সাড়ে চার হাজার ইট কিইনা আইনা বাড়িত রাখছে। কিন্তু তার মনের আশা আর পূরণ হইল না। আন্দোলন করতে গিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির তলে পইড়া ছেলেটা মইরা গেল।
“আমি আমার ছেলে মাহবুব হত্যার বিচার চাইয়া বাদী হইয়া থানায় মামলা করছি। আমার ছেলে কোন অপরাধ করে নাই। কেন তারে গাড়ি চাপা দিয়া মারলো। যারা আমার ছেলেরে মারছে, আমি তাদের বিচার ও শাস্তি চাই।”
নিহত মাহবুবের বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম জানান, তার ভাই তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ছিলেন। এইচএসসি পাসের পর গড়ে তুলেছিল আইটি ল্যাব এডুকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মাহবুব শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। আইটি ল্যাব এডুকেশন নামের ওই প্রতিষ্ঠানে সে বেসিক কম্পিউটার এবং গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ শেখাতো।
তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের হার পাওয়ার প্রকল্পের শেরপুর জেলার কো-অর্ডিনেটর ও প্রশিক্ষক ছিল সে। একই সঙ্গে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ডেটা এন্ট্রির কাজ করতো। পাশাপাশি টিউশনি করতো। এই দিয়ে পরিবারের হাল ধরেছিল মাহবুব।
তিনি বলেন, “মাহবুবের উপার্জন এবং আমার ফলের দোকান আয় রোজগার দিয়েই আমাদের সংসারটা চলছিল। আমার সংসারে ওর অর্থনৈতিক সাপোর্টটাই বেশি ছিল। আমি আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”