কোম্পানীগঞ্জে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
Published : 03 Aug 2024, 11:13 PM
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন বলে আন্দোলনকারীরা দাবি করেছে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।
শনিবার দুপুর থেকে চৌহাট্টায় বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের সঙ্গে অনেক সাধারণ মানুষও যোগ দেন। বিকালে সংঘর্ষ শুরু হলে নগরীর চৌহাট্টা, দরগাগেইট, মিরবক্সটুলা ও জিন্দাবাজার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
বিকাল ৫টার দিকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হলে জবাবে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদুনে গ্যাস ও বাবার বুলেট ছোড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে নগরীর জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, দরগাগেইট ও মিরবক্সটলা এলাকায় দফায়-দফায় সংঘর্ষ চলে।
এ সময় আন্দোলনকারীরা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষার্থী, পুলিশ, সাংবাদিক ও পথচারী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সন্ধ্যায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল হোসেন বলেন, “শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পুলিশ বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। ছাত্রলীগ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থানা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে।”
রাত পৌনে ৯টার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী বলেন, “বর্তমানে নগরীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। একটু আগে ক্লিয়ার হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি। পুলিশের ওপর আক্রমণ করলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ চেষ্টা করেছে। আমাদের পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।”
কোম্পানীগঞ্জে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
সন্ধ্যায় কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ বদিউজ্জামান বলেন, শনিবার দুপুরের দিকে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
তবে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক কবির আহমদ ও সোহরাব হোসেন আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সিলেট-ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে বিক্ষোভ মিছিলটি উপজেলা পরিষদের ফটকের সামনে যায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তখন আন্দোলনকারীরা সেখানে সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে থানা বাজারের দিকে যেতে থাকলে উপজেলা পরিষদের ফটকের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন।
এ সময় তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। পরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপজেলা পরিষদের ফটকের সামনে অবস্থান করে সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ
দুপুর ১২টায় নগরীর টুকেরবাজার তেমুখী পয়েন্টে ও মদিনা মার্কেট এলাকায় আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করে।
দেশব্যাপী ‘বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে’ এই শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সদর উপজেলা, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে এই সমাবেশ হয়।
এতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, “বিএনপি-জামায়াত সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ওপর ভর করে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখছে।
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটার দাবি মেনে নিয়েছেন। অন্যান্য দাবিগুলোও পূরণ করা হবে। তাদের দাবির প্রতিফলন হোক আমরাও চাই।”
তিনি বলেন, “আমরা কোনো ধরনের সংঘাত চাই না। একটা মৃত্যুও কাম্য নয়। তবে বিএনপি-জামায়াত সুযোগ নিয়ে যদি সারাদেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাহলে আমরা জনগণের পক্ষে আছি এবং তা শক্তহাতে প্রতিহত করা হবে।”
তেমুখী পয়েন্টে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিজাম উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক হিরণ মিয়ার পরিচালনায় শান্তি সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দীন খান, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদ, অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিক, অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, নূরে আলম সিরাজী, মকসুদ আহমদ, শাহবুদ্দিন লাল, নেফাজ উদ্দিন, আফতাব সিরাজী।
অপরদিকে মদিনা মার্কেট এলাকায় মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কাউন্সিলর জগদীশ চন্দ্র দাসের সভাপতিত্বে এবং সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ শামীম আহমদ ও জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক জগলু চৌধুরীর পরিচালনায় বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শাহ ফরিদ আহমদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক মখলিছুর রহমান কামরান, ৯ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি কামাল আহমদ, ৮ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম নজু।
‘সন্তানদের বন্দুকের মুখে রেখে আমরা সুখনিদ্রায় যেতে পারি না’
শিক্ষার্থীদের সব যৌক্তিক দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সকাল ১১টায় আয়োজন করা হয় সংক্ষুব্ধ নাগরিক সমাবেশ। সমাবেশে শতাধিক অভিভাবক ও নাগরিক অংশগ্রহণ করেন।
সিলেটের নাগরিক প্ল্যাটফর্ম সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম। স্বাগত বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুদীপ্ত অর্জুন। সমাবেশের সঞ্চালনা করেন যুব সংগঠক মতিউর রাফু।
আব্দুল করিম কিম বলেন, “কোটা সংস্কারের একটি নির্দোষ দাবিকে অসহনীয় পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার দায় সরকারের। আরিচা রোডের ট্রাক ড্রাইভারের মত বেপোরোয়া রাষ্ট্র পরিচালনার খেসারত আজ দেশবাসীকে দিতে হচ্ছে। দেশ আজ বিপন্ন।
“আমাদের সন্তানেরা বন্দুকের মুখে বুক পেতে দাঁড়াচ্ছে। যারা বন্দুক নিয়ে তাদের রুখে দিতে চাইছে ওরাও আমাদের ভাই, আমাদের সন্তান। এই অসহ্য পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছি না। রাষ্ট্রের সংস্কার প্রয়োজন।”
স্বাগত বক্তব্যে সুদীপ্ত অর্জুন বলেন, “চলমান ছাত্র আন্দোলনে সুস্পষ্ট অভিযোগ ছাড়া অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ও মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের আটক করা হয়েছে। তাদেরকে অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে। প্রশাসনকে মানুষের আবেগ ও সংবেদনশীলতা বুঝতে হবে। একজন সাধারণ ছাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো সমাজের মননে এর প্রতিক্রিয়া হয়। আর দুর্বৃত্তরা এর সুযোগ নেয়।”
আরও বক্তব্য দেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ আনসার খান, সাংস্কৃতিক সংগঠক মনির হেলাল, রাজনৈতিক সংগঠক উজ্জ্বল রায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন, পলিটিক্যাল স্ট্যাডিজের অধ্যাপক ড. দিলারা রহমান, সাবেক ছাত্রনেতা মাহবুবুর রহমান ওয়েছ ও রেজাউল কিবরিয়া, রোটারিয়ান সামসুল হক দিপু, অভিভাবকদের পক্ষে ওয়াসিকুজ্জামান চৌধুরী অনি, অ্যাডভোকেট জাকিয়া জালাল, রুহুল কুদ্দদু মাসুম, মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান চৌধুরী, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক কর্মকর্তা রোমেনা বেগম রোজী, শিশু কিশোর সংগঠন উষা’র পরিচালক নিগাত সাদিয়া।