Published : 02 May 2025, 02:12 PM
অবশেষে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে খাদি। স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দিত তাঁতী, খাদি কাপড় ব্যবসায়ীসহ কুমিল্লাবাসী। একইসঙ্গে তাঁতের খাদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবি করছেন তারা।
দীর্ঘদিন পরে হলেও খাদি নিজেদের পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছেন এ কাপড় বোনার কারিগর কুমিল্লার দেবিদ্বার গ্রামের সত্তোরোর্ধ তাঁতী চিন্তাহরণ দেবনাথ।
তিনি বলেন, ‘যতকিছুই হোক কুমিল্লার হাতেবোনা খাদির বিশেষত্ব আলাদা। তাঁতে কাপড় বুনে সেটা থেকে পোশাক তৈরি করে পরলে যে আরাম, তা অতুলনীয়। তবে আসল খাদি বাঁচিয়ে রাখতে তাঁতিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
জানা গেছে, খাদি হাতে বোনা এক ধরনের বিশেষ কাপড়। যে তুলা দিয়ে এই মোটা কাপড় তৈরি হয়, সেই সুতাও হাতে তৈরি হয়। কার্পাস তুলা থেকে হাতে কাটা সুতা দিয়ে এই কাপড় বোনা হয়।
মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ১৯২১ সালে এই উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় খাদি জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়। এ কাপড়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ‘স্বদেশি পণ্য গ্রহণ করো আর বিদেশি পণ্য বর্জন করো’ এই স্লোগানের ওপর ভিত্তি করেই তখন খাদিশিল্পের বিকাশ হয়।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক এ স্মারকের স্বীকৃতি নিয়ে কুমিল্লা জেলা থেকে দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসলেও এতদিন তা অপূর্ণ ছিল।
বুধবার কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদিসহ আরও ২৪টি পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ দিয়েছে সরকার। এদিন ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর আয়োজিত বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস-২০২৫ এর আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্টদের এসব সনদ হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছিল কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী রসমালাই।
খাদি ব্যবসায়ীরা জানান, খাদি কাপড়ের বিশেষত্ব হলো এটি হাতে তৈরি, পরিবেশবান্ধব এবং আরামদায়ক। কুমি কারিগররা তাদের অনন্য দক্ষতার মাধ্যমে খাদিকে একটি শিল্পে রূপান্তরিত করেছেন।
তবে কালের আবর্তনে তুলা এবং কর্মী সঙ্কটে খাদি হ্যান্ডলুম (তাঁত) থেকে মেশিন লুমের প্রাধান্যে চলে যায়।
কুমিল্লার চান্দিনা, দেবিদ্বারের তাঁতীরাও ছেড়ে দেন চরকায় সুতা কাটা আর তাঁতে কাপড় বোন। এখনো এসব গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে আলাদা তাঁতের ঘর রয়েছে। অলস পড়ে আছে তাঁত।
এদিকে প্রায় কাছাকাছি মানের হওয়ায় মেশিনলুমের খাদিও দখল করেছে বাজার। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলার কারখানায় এখন মেশিনেই তৈরি হয় বেশিরভাগ খাদি। তারপর কিছু কিছু হ্যান্ডলুমের খাদি বাজারে মেলে এখন।
দেশে বিদেশে যাচ্ছে এসব কাপড়, চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন।
তবে মেশিনের খাদি আর তাঁতের খাদির অনেক তফাত উল্লেখ করে চিন্তাহরণ আরও বলেন, ‘এক সময় আমাদের দেবিদ্বার, চান্দিনা গ্রামে শত শত তাঁত থাকলেও তুলা আর কর্মীর অভাবে এখন প্রায় সব বন্ধ। যেসব তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে- কাঁচামাল, তুলা, ভর্তুকি দিয়ে হলেও তাঁতিদের জাগাতে হবে। ”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চিন্তাহরণ দেবনাথ বলেন, ‘খাদি আমাদের। দাদা-বাবাদের পরম্পরায় ৭০/৮০ বছর এই কাপড় তৈরি করেছি। খাদি এখন আমাদের (জিআই) স্বীকৃতি পেয়েছে আমি খুব খুশি হয়েছি। তাঁতের শেষ বয়সে এসে খাদির এই স্বীকৃতি মিললো।’
খাদি কাপড়ের নামকরণ নিয়ে রয়েছে মতবাদ। দেশে যখন খাদি কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষের কাপড়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য মাটির নিচে গর্ত করে পায়ে চালানো প্যাডল দ্বারা এ কাপড় তৈরি হতো। খাদ থেকে তৈরি হতো বলে এর নাম হয় খদ্দর বা খাদি। আবার অনেকে বলে থাকে খদ্দর শব্দটি গুজরাট শব্দ। এই শব্দ থেকে খাদি বা খদ্দর হচ্ছে।
কুমিল্লার খাদিঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, পৃথিবীর যেখানে বাঙালি আছে, সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটেছে। কুমিল্লায় বিদেশিরা আসেন, তারাও খাদির কাপড় কিনছেন। এটা হাতে তৈরি কাপড় হওয়ায় পরে ন্যাচারাল ফিল পাওয়া যায়।”
তিনি বলেন, এ স্বীকৃতির ফলে কুমিল্লার খাদি পণ্যের বিপণন ও রপ্তানির সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে। দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও কুমিল্লার খাদি পণ্য নতুন মাত্রা পাবে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারিগরদের জীবনমান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনাও তৈরি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
একই এলাকার খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, “কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ খাদির এমন স্বীকৃতিতে আনন্দিত। শত বছর পার হলেও এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা।”
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, “জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লার খাদি ও বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের জিআই স্বীকৃতির জন্য তখন থেকেই কাজ শুরু হয়।
“কুমিল্লার ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত তিনটি পণ্যের মধ্যে দুটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। যে একটি বাকি আছে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি পাবে বলে আশাবাদী।”