“আমাদের জেলায় রেল গাড়ি আইব। এডা কখনও চিন্তা করি নাই। দেখলেও ভালো লাগে।”
Published : 25 Jun 2024, 09:59 PM
যে স্বপ্ন ধারণ করে গড়ে উঠেছিল পদ্মা সেতু, সেই স্বপ্ন এখন বিপুল গতিতে বইছে পদ্মার বুক। সেতুর দুই তীরে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্র, শিল্প স্থাপন এবং সহজ যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে মানুষের জীবনযাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা সড়কপথে যুক্ত হয় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে। পরদিন ২৬ জুন থেকে চলছে যানবাহন।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত পরিচালক আমিরুল হায়দার চৌধুরী বলেন, দুই বছরে সেতুতে ১ কোটি ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৯৫ যান পারাপার হয়েছে। এতে ১ হাজার ৬৪৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার ১৫০ টাকার টোল আদায় হয়েছে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পাল্টেছে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার চিত্র। পর্যটন, শিল্পায়ন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষির আধুনিকায়ন ও কৃষিপণ্যের ‘ন্যায্যমূল্য’ পাওয়াসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল পাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এক সময়ের গ্রামীণ সড়কের দুইপাশে এখন একের পর এক কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। গত দুই বছরে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের অন্যতম ‘আকর্ষণীয় স্পট’ এখন পদ্মার দুইপাড়। গ্রামের সঙ্গে শহুরে মানুষের যোগাযোগ বেড়েছে।
সেতু সচিব মঞ্জুর হোসেন বলেন, “সেতুর সুফল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। দুইপারের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে।”
পদ্মা সেতু ও ঢাকা-ভাঙ্গা মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে চালুর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ খুব সহজে রাজধানীতে অফিস-আদালতে যাতায়াত করতে এবং জরুরি কাজকর্ম সারতে পারছেন। একটা সময় ছিল যখন মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। কখনও কখনও সে অপেক্ষার প্রহর ২-৩ দিনেও গড়াত। তার উপর ঘন কুয়াশা, নাব্য সংকট, মাঝ পদ্মায় ফেরি বিকল ছিল নিত্যদিনের ভোগান্তি।
দুর্ভোগের যাতায়াত এই পথ এখন ‘স্বপ্নের যাত্রাপথ’। পদ্মা সেতু চালুর পর গত দুই বছরে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী গ্রামের মানুষগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যখন মন চাচ্ছে ছুটে যাচ্ছেন বাড়ির পথে কোনো ভোগান্তি ছাড়াই।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হলদিয়ার কৃষক আসলাম শেখ বলেন, “আমাদের প্রচুর সবজি হয়। এখন আমাগো জেলায় পদ্মা সেতু হইছে, ট্রেন চলতাছে। আমরা কম খরচে ঢাকায় গিয়ে এসব সবজি বিক্রি করতে পারি।”
কনকসারের আকরাম বলেন, “এখন আমরা সহজেই ঢাকা গিয়ে অফিস করে ফিরতে পারি। পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারি।”
শ্রীনগরের সেলামতির সুমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এখন খুব সহজেই তিনি নানা প্রয়োজনে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারেন বলে জানান।
তিনি বলেন, “সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করে বিকালের আগেই বাসায় পৌঁছাতে পারি। সব মিলিয়ে ভাবা যায় না।”
রাঢ়িখালের রমিজ বলছিলেন, “আমাদের জেলায় রেলগাড়ি আইব। এডা কখনও চিন্তা করি নাই। দেখলেও ভালো লাগে।”
মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশে প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছেন। ফলে গত দুই বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। আর পদ্মা সেতু চালু হবার পর তো রেলপথ চালু হওয়ায় আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পুরোপুরি পরিবর্তন হয়েছে।
“পদ্মা সেতুকে ঘিরে এসব এলাকায় জমির দাম এখন ‘আকাশচুম্বী’। অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার অভিজাত এলাকার জমির দামকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “পদ্মা বহুমুখী সেতুর কারেণে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে যাচ্ছে। কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে।শিল্প কারখানা গড়ে ওঠায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে এই সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।”
এই প্রকল্পে যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ।
তিনি বলেন, “যেকোনো কাজেই চ্যালেঞ্জ আছে। ছোট কাজে ছোট চ্যালেঞ্জ, বড় কাজে বড়। পদ্মা সেতুর মতো এত বড় প্রজেক্টে প্রথমেই আমাদের কাছে যেটা চ্যালেঞ্জ ছিল সেটা হল অর্থায়ন। বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করবেন। প্রথমেই সেই চ্যালেঞ্জটার মুখোমুখি হই আমরা। সরকার আমাদের সাপোর্ট দিয়েছে।
“দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিল টেকনিক্যাল। আমাদের ম্যানেজম্যান্ট দিয়ে এটা করতে পারব কি-না বা আমাদের ম্যানেজমেন্টে বিদেশি ঠিকাদার আসবে কি-না। এদিকে বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে কি দেবে না, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। তাছাড়া আমরা যে নেতৃত্ব দেব সেটি পারবো কি-না। এ সমস্ত বহু চ্যালেঞ্জে পড়ি।”
সেতু প্রকল্পের পরিচালক বলেন, “আমরা একটা আনুমানিক জরিপ করেছি। এতে ধারণা পেয়েছি, ২০-২৫ বছরের মধ্যে নির্মাণের ব্যয়ের টাকা উঠে আসবে। সেতু চালু হলে পদ্মার ওপারের বিশাল জনগোষ্ঠী নির্বিঘ্নে যাতায়াত করবে। কাচাঁমাল, সবজি বা অন্যান্য সবকিছু দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থানান্তর করা যাবে। এতে তৃণমূলের লোকজন সুবিধা পাবে বেশি ।
“পদ্মা সেতু শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় পুরো বিশ্বের জন্যই এক রোল মডেল। প্রবল স্রোতের এই পদ্মায় সেতুটি তৈরি করতে আমাদের অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। সবকিছুতেই আধুনিক মানের সব ব্যবহার হয়েছে। পাঁচটি বিশ্বরেকর্ডও করেছে এই সেতু। সর্বাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে এটির নির্মাণে।”
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া প্রান্তে তুলনামূলক কম প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে শিমুলিয়া ঘাটের রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ছোট-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ২৫টি রেস্তোরাঁ আছে এখানে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকছে। প্রায় ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে সেখানে।
পদ্মা সেতু দেখতে এসে শিমুলিয়া ঘাটে খেতে আসছেন দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। রেস্তোরাঁগুলো অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো। কোনো কোনো রেস্তোরাঁ দুই হাজার থেকে তিন হাজার বর্গফুটের।
ইলিশ মাছ রেস্তোরাঁগুলোর প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে রয়েছে ইলিশের লেজ ভর্তা, পেঁয়াজ ভর্তা। রেস্তোরাঁর ফ্রিজে রাখা গোটা ইলিশ কিনে ওখানেই ক্রেতার সামনে কাটাকুটি করে পরিবেশন করা হয়। এখানে সাধারণ দলবেঁধে, বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আসে।
স্থানীয় অনেক তরুণ বিদেশে না গিয়ে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নেমেছেন। তারা বেশ ভালোই আছেন বলে জানান।
রূপালী ইলিশের শামিম শেখ, মাওয়া কুটুমবাড়ির রাসেল আলম রাজু, ইলিশ আড্ডার বিটু ও শখের গাড়ির মাসুম আহমেদ পিন্টুর ভাষ্য, বিদেশে না গিয়ে এখানে তারা বেশ আছেন।